Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জনভার ও পরিবেশ বিপর্যয়

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

দুশো বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ কোটির মতো। দুশো বছর পরে আজ সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাতশো কোটির উপরে। বিশালাকার জনসংখ্যার এই বৃদ্ধিকেই জনবিস্ফোরণ বলা হয়। জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। দুশো বছর আগে আমাদের পৃথিবী ছিল বনময়। তখন ভূচরের সত্তর শতাংশ ছিল বনাবৃত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কোটি কোটি হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করে বসতবাড়ি, অগণন শিল্প কারখানা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে পৃথিবীর বনভূমির পরিমাণ সেই সত্তর শতাংশ থেকে নেমে আজ দাঁড়িয়েছে ত্রিশ শতাংশে। এই পরিমাণ বনভূমি পৃথিবীর জীবকুলের বেঁচে থাকার জন্য, নিদেনপক্ষে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। আবার এই পরিমাণ বনভূমিও যে কতদিন পৃথিবীতে থাকবে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে।
জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে যে অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে, এসব চলছে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি তথা প্রাকৃতিক গ্যাস, প্রাকৃতিক তেল ও কয়লা পুড়িয়ে। জীবাশ্ম পোড়ানোর ফলে বিশ্বে প্রতিদিন শত শত টন কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো মারাত্মক গ্রিন হাউস গ্যাস বায়ুমন্ডলে মিশছে। কার্বল ডাই-অক্সাইড একটি তাপধারক গ্যাস হওয়ায় দিনে দিনে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে আজ তা বিদপসীমার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আবার এইসব শিল্প-কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন মৌলের কিছু গ্যাসীয় অক্সাইড তৈরি হয়ে বায়ুমন্ডলে গিয়ে মিশছে। ওইসব গ্যাসীয় অক্সাইড বায়ুমন্ডলের জলকণার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে সালফিউরিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরি করছে। এই দুই অ্যাসিড মেঘের সাথে মিশে বৃষ্টির ধারার সাথে পৃথিবীপৃষ্ঠে নেমে আসছে। ফলে ভূস্তরে ও জলস্তর অ্যাসিড যুক্ত অর্থাৎ আ¤িøক হয়ে উঠেছে। আ¤িøক ভূস্তর বনায়ন ও কৃষির জন্য ক্ষতিকর। ফলে বনভূমির বৃদ্ধি ও ফসল উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। আবার অ্যাসিডযুক্ত বৃষ্টির এই পানিধারা নদ-নদী, খাল-বিল, সাগর-মহাসাগরের পানিতে মিশে ওই পানিকেও আ¤িøক করে তুলেছে।
এই আ¤িøক পানি জলজ উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী উভয়ের পক্ষে ক্ষতিকর। ফলে তাদের জীবনধারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বংশধারা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে কৃষিজমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রাসায়নিক দ্রব্যের অব্যবহৃত অংশ বৃষ্টির পানিতে বাহিত হয়ে বিভিন্ন পানিধারায় গিয়ে মিশে এইসব পানিধারার পানিকেও দূষিত করে তুলছ্ েপানিদূষণের আরেকটি কারণ শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য। পৃথিবীতে প্রতি বছর শিল্প-কারখানা থেকে লক্ষ লক্ষ টন দূষিত বর্জ্য খাল-বিল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগরের পানিতে গিয়ে মিশে থাকে। তার সাথে গিয়ে মিশছে ক্রমবর্ধমান শহরাঞ্চলের পয়ঃপ্রণালী ও গৃহস্থালির দূষিত বর্জ্য। এইসব পানিধারের পানি ভূগর্ভের পানির সাথে গিয়ে মিশে ভূগর্ভের পানিকেও দূষিত করে তুলছে। ফলে পৃথিবীতে নিরাপদ পানি আজ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। অথচ নিরাপদ পানি জীবনধারা অক্ষুণœ রাখার অন্যতম শর্ত। এই শর্তের কথা মনে রেখেই বলা হয়ে থাকে- পানির আরেক নাম জীবন। কিন্তু এই জীবনই আজ বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর দুশো কোটির বেশি মানুষ নিরাপদ পানীয় জলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কী ভয়ানক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা! মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে, রেললাইন বসানো হয়েছে। সময়ের দূরত্ব কমিয়ে আনতে এইসব রাস্তাঘাটে নিত্যদিন কোটি কোটি যানবাহন চলছে। এইসব যানবাহনও চলছে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে। ফলে ওই যানবাহন থেকে হাজার হাজার টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস মুক্ত হয়ে ভূ-উষ্ণায়নের মাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে।
আবার শিল্প-কারখানাসহ এসব অগণিত সংখ্যার গাড়িঘোড়া কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের সাথে শত শত টন দূষিত কনা ছড়িয়ে দিচ্ছে বায়ুমন্ডলে। এক সময়ে এই দূষিত কণা বায়ুমন্ডল থেকে ভূস্তরে নেমে আসছে এবং শ্বাসকার্যের সাথে মানুষের দেহে প্রবেশ করে মানুষকে অসুস্থ করে তুলছে। এই অসুস্থতা কখনও কখনও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। এই বিপদ থেকে উদ্ভিদ জসৎও বাদ যাচ্ছে না।
অন্যদিকে, বিশাল সংখ্যাক মানুষের প্রয়োজন মেটাতেই যে শুধু এইসব কল-কারখানা ও গাড়িঘোড়া চলছে, তা কিন্তু নয়। কিছু সংখ্যক কলকারখানা ও গাড়িঘোড়া চলছে এক শ্রেণির মানুষের ভোগবিলাস মেটাতে। তারা নিয়মে অনিয়মে রোজগার করে যাচ্ছে শুধু ভোগবিলাস মেটাবার জন্য। তাদের ভোগবিলাস যে জীবকুলের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সে বিষয়ে ভাববার অবকাশ নেই তাদের। এই আত্মকেন্দ্রিকতা দুঃখের হলেও বাস্তবে তা বিরাজ করেছে আত্মশ্লাঘার বিষয় হয়ে।
আরেকটি কথা প্রায় অনুচ্চারিত থেকে যায় এসব আলোচনায়। মানুষ তার শ্বাসপ্রশ্বাসে অক্সিজেন গ্যাস গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ করে। হিসাব করে দেখা গেছে, একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন প্রায় সোয়া লিটার কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দিচ্ছে। সাতশো কোটি মানুষের ক্ষেত্রে তা দাঁড়াচ্ছে প্রায় হাজার কোটি লিটার। একথা বহু আলোচিত ও প্রমাণিত যে, ভূ-উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। এই গলিত বরফের পানিধারা নদ-নদী বাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশছে। ফলে সমুদ্রের পানিস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সমুদ্রের পানিস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি একাধিক ক্ষেত্রে ভূ-প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলে চলেছে। পানিস্ফীতির কারণে সমুদ্রতীরের অনেক অঞ্চলই পানির তলায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব অঞ্চলের মধ্যে বিশ্বের বেশ কিছু বড় শহর ও বন্দর রয়েছে। পানিস্ফীতির কারণে ভূপৃষ্ঠের পরিসর সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফলে বাসস্থান ও কৃষিক্ষেত্রের পরিসর কমে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানিস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর পানিমগ্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষের পুনর্বাসনের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। আবার সমুদ্রের পানিভাগের বিস্তার ঘটার ফলে বেশি পরিমাণে সমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমন্ডলে গিয়ে মিশছে।
এই বর্ধিত পানীয় বাষ্প ভূ-উষ্ণায়নের মাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে। ভূ-উষ্ণায়নের ফলে আরো বেশি পরিমাণ পানি বাষ্পীভূত হয়ে আরো বেশি করে ভূ-উষ্ণায়ন ঘটাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া চক্রাকারে ঘুরে পৃথিবীকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বরফ ও পানি মূলত একই বস্তু হলেও তাপ ধারণের ক্ষেত্রে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কঠিন বরফ সূর্যের আপতিত তাপরশ্মির প্রায় পুরোটাই মহাকাশে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তরল পানি সূর্যের আপতিত তাপরশ্মির বেশ কিছুটা নিজের গায়ে ধরে রাখে। পুরোটা ফিরিয়ে দেয় না। তাই কঠিন বরফ তরল পানিতে পরিণত হয়ে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ হয়ে উঠছে। ভূ-উষ্ণায়নের ফলে ঝড়ঝঞ্ঝার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে লোকক্ষয় ও সম্পদক্ষয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের দুর্গতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, পৃথিবী থেকে বনভূমি হারিয়ে যেতে বসেছে। ভূ-উষ্ণায়ন বিপদ সীমার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। নিরাপদ পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। হিমবাহ গলছে। সাগর-মহাসাগরের পানিস্তর ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে।
পৃথিবীর অন্য কোনো প্রজাতির প্রাণী পৃথিবীর জন্য দুঃখ বয়ে আনছে না। দুঃখ বয়ে আনছে শুধু মানুষ। মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, মানুষের আত্মশ্লাঘা, তার অহমিকাবোধ পৃথিবীর জীবজগৎকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর পরেও যদি মানুষের চেতনাবোধ ফিরে না-আসে, তাহলে পৃথিবীর জীবকুলকে চরম বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পরিবেশ


আরও
আরও পড়ুন