Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দুটি গল্প: উপসংহার পাঠকদের জন্য

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বাঙালি রাজনীতিপ্রবণ। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। অতএব কারো সাথে কোথাও বসলে রাজনীতির কথা উঠবেই। তেমনই একটি আলোচনায় একজন আলাপকারী টাকা-পয়সার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করছিলেন। একই আলাপে, দুর্নীতি ও লুটপাটের কথাও উঠে এসেছিল। বিশদ বক্তব্য না দিয়ে, তিনি বললেন, ইবরাহিম ভাই, দুটি গল্প শোনেন। ছোটকালে স্কুলে ঈশপের গল্প পড়ে যেমন উপসংহার লিখতেন, এবার আমার দুটি গল্প শুনেও আপনি নিজের মতো করে উপসংহার লিখবেন। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এবং যুগপৎ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি আলহাজ নাজিমুদ্দিনের নিকট থেকে শোনা, একদিন দুপুরে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি, ব্যারিস্টার আন্দালিব পার্থ) এর অন্যতম সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জুলকারনাইনের বাসায়। গল্প শোনার পর পরীক্ষিত প্রবীণ রাজনীতিবিদ সৈয়দ নাজিমুদ্দিনকে আমি বললাম, আপনার এই দুইটি গল্প আমার কাছে এত ভালো লেগেছে যে, এটা বৃহত্তর পরিসরে তথা পত্রিকার পাঠককূলের সঙ্গে এবং অতঃপর ফেসবুকের পাঠককূলের সঙ্গে শেয়ার করতেই হবে। সম্মানিত পাঠকগণের ওপরই আমি এই দুইটি গল্পের নীতিবাক্য বা শিক্ষণীয় বিষয়টি উদ্ধার করার ভার ছেড়ে দিতে চাই। সৈয়দ নাজিমুদ্দিন বললেন, তথাস্তু।
প্রথম গল্প: আগে সাঁতার শিখো, পরে ডাক্তার হও।
ঝড়-বৃষ্টির রাত। আলোবিহীন পল্লী অঞ্চল। কোনো এক বাড়িতে একজন সংকটাপন্ন রোগী। রোগীর আত্মীয়-স্বজন ডাক্তার খুঁজে বাড়িতে আনলেন। ডাক্তারের বাড়ি এবং রোগীর গ্রামের মাঝখানে একটা নদী আছে। ঝড়-বাদলের কারণে নদীতে প্রবাহ এবং ঢেউ বেশি। ডাক্তার যখন রোগীর বাড়িতে আসেন তখন নৌকায় করে নদী পার হয়েছেন। রোগীর আত্মীয়-স্বজন যখন ডাক্তারকে নিয়ে রোগীর বাড়িতে প্রবেশ করলো তখন রোগীর অবস্থা আরও বেশি সংকটাপন্ন; প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এরইমধ্যে, ডাক্তার সাহেব রোগীকে একটু পরীক্ষা করলেন; এখানে-ওখানে হাত দিয়ে ধরে দেখলেন, হালকা-পাতলা চাপ দিয়ে দেখলেন। এরকম অবস্থাতে, ডাক্তারের উপস্থিতিতেই, রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ডাক্তার আফসোস করলেন এবং বললেন, আরেকটু আগে আসতে পারলে হয়তো বা বাঁচানো যেত কিন্তু গভীরভাবে শোকাহত সদ্যমৃত রোগীর অতি ঘনিষ্ট কয়েকজন অত্যন্ত বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে উঠলেন। ওই আবেগপ্রবণ আত্মীয়রা বলা শুরু করলো, রোগী আরও কিছুক্ষণ বাঁচতো, কিন্তু ডাক্তারের টিপাটিপিতে তাড়াতাড়ি মারা গেছে। আবেগপ্রবণ আত্মীয়দের উদ্ভট অভিযোগ ক্রমান্বয়ে আরও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এবং সবাই বলাবলি শুরু করলো, ঠিকইতো! ডাক্তার ছাড়া গত তিনদিন বেঁচে ছিল, কিন্তু ডাক্তার আসা মাত্র মরে গেল! ডাক্তার কুফা, ডাক্তার অলক্ষী, এই ডাক্তার যেখানে যাবে সেখানেই রোগী মরে যাবে। অতএব, এই ডাক্তারকে বন্দি করো এবং কালকে সকালেই তাকে আমরা মেরে ফেলবো। ডাক্তার অনেক অনুনয়বিনয় করলো এবং বোঝাতে চাইলো যে, মৃত্যুটা এইরূপ সংকটাপন্ন রোগীর স্বাভাবিক পরিণতি; তিনি চিকিৎসা করার সুযোগই পাননি। তীব্র বৈরী পরিবেশে ডাক্তার সাহেবের বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা ও জীবনভিক্ষা কেউই কানে তুললো না, কেউই গ্রহণ করলো না। ডাক্তার সাহেবকে বেঁধে রাখা হলো রাতটা পার করার জন্য, সকালেই মেরে ফেলা হবে এই উদ্দেশ্যে। অতঃপর সবাই এদিক-ওদিক গেল, কেউ সুর করে কান্নাকাটি শুরু করলো, কেউ মৃতের গোসলের জন্য চেষ্টা শুরু করলো, কেউ দূরবর্তী অঞ্চলের আত্মীয়দের খবর দেওয়ার কাজে ব্যস্ত হলো। মানুষজনের মনোযোগ অন্যদিকে অনুভব করে ডাক্তার সাহেব বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ডাক্তার বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে অন্ধকার রাত্রিতে নদীর দিকে দৌড় দিলেন। নদীটা পার হতে পারলেই নিজের গ্রাম। বাড়ির মানুষেরা ডাক্তার পালিয়েছে এটা বুঝে গেল কিছুক্ষণ পর। তখন হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে ডাক্তারের পিছে পিছে ছুটলো, ডাক্তারকে ধরার জন্য। ততক্ষণে ডাক্তার নদীর পাড়ে। ঝড়-বাদলের রাত, কোনো নৌকা নেই। যদি অপেক্ষা করে নৌকার জন্য তাহলে পেছনের থেকে যারা ধাওয়া করে আসছে হৈ-হৈ রৈ-রৈ করতে করতে, তারা পুনরায় বন্দি করবে। অপরপক্ষে নদী যদি সাঁতরিয়ে পার হতে হয়, তাহলে আশঙ্কা থাকে ডুবে যাওয়ার। ডাক্তার আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন, কারণ তিনি একজন ভালো সাঁতারু ছিলেন। আল্লাহর নাম নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন সাঁতরিয়ে ওই পারে যাওয়ার জন্য। সোজাসুজি অপর পাড়ে না পৌঁছালেও বেশ কিছু ভাটিতে গিয়ে তিনি অপর পাড়ের মাটি পেলেন। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে পৌঁছালেন। তখনও ভোর হতে বাকি। দেখলেন নিজের ছেলে তখনও পড়ছে। বলে রাখা ভালো, ছেলেও ডাক্তারী পড়ছিলেন; তথা কোনো একটি মেডিক্যাল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। পিতা জিজ্ঞাসা করলেন, এত গভীর রাতে কেন পড়ছো? ছেলে উত্তর দিল, বাবা পরীক্ষা অতি সন্নিকটে। বাবা বললেন, প্রস্তুতি নিচ্ছ ঠিক আছে, কিন্তু বলো তো: তুমি কি সাঁতার পারো? ছেলে উত্তর দিল, না। ডাক্তার সাহেব তথা বাবা বললেন, আগে সাঁতার শিখো, তারপর ডাক্তার হও।
দ্বিতীয় গল্প: রুটি ডালের বিরল মহামিলন
জনবসতি খুবই হালকা-পাতলা এমন একটি অঞ্চল। গল্পের জন্যই মনে করুন পাঁচ বা সাতশত বছর আগে ইরাকের কুফা শহর থেকে বাগদাদের দিকে একজন ব্যক্তি যাচ্ছেন। তৎকালীন বাগদাদ জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল। মুসাফির সারাদিন পথ চলার পর সন্ধ্যায় আশ্রয় খুঁজছেন। একটি বাড়ি দেখতে পেলেন। অতঃপর ওই বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বাড়ির কর্তা মুসাফিরকে দেখে সাদরে গ্রহণ করলেন। কারণ মুসাফিরের খেদমত করার রেওয়াজ ওই অঞ্চলে অতি প্রসিদ্ধ ছিল। রাতে খাওয়ার সময় হলো। মুসাফির ঘরের বারান্দায় বসে আছেন, যেন বাইরের বাতাস উপভোগ করা যায়। তাকে রাতে খাওয়ার জন্য বন্দোবস্ত করা হলো। বাড়ির কর্তা প্রথমে একটি রুটি আনলেন এনে মুসাফিরের সামনে দিলেন; বললেন আমি ডাল নিয়ে আসছি। কিছুক্ষণ পর ওই বাড়ির কর্তা ছোট বাটিতে করে ডাল নিয়ে আসলেন; মুসাফিরের সামনে রাখলেন; কিন্তু দেখলেন রুটি শেষ; এখানে যে একটি রুটি ছিল, তার কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না! বাড়ির কর্তা মুসাফিরকে বললেন, আমি রুটি নিয়ে আসছি। কিছুক্ষণ পর বাড়ির কর্তা আরেকটি রুটি নিয়ে আসলেন এবং মেহমানের সামনে রাখলেন। কিন্তু দেখলেন, রেখে যাওয়া ডালের বাটি পরিষ্কার, ডাল শেষ! বাড়ির কর্তা মেহমাহনকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, আমি আবার ডাল নিয়ে আসছি। কিছুক্ষণ পর বাড়ির কর্তা আবার ডাল নিয়ে আসলেন ছোট একটি বাটিতে, কিন্তু এসে সেই পুরানো দৃশ্যই দেখতে পেলেন; রুটি শেষ! এরকম করে রুটি এবং ডালের মধ্যে লুকোচুরি খেলা চলতে লাগলো; অর্থাৎ বাড়ির কর্তা ডাল আনলে দেখেন রুটি শেষ এবং রুটি আনলে দেখেন ডাল শেষ! এরকম করতে করতে সপ্তমবারে তিনি ডাল এনে দেখলেন যে এখনও রুটিটি আছে! বাড়ির কর্তা খুশি হলেন এবং শান্তিও পেলেন যে, আর রুটি ও ডাল লাগবে না! মনের ভেতর যা-ই থাকুক না কেন, মুসাফিরের নিকট দুঃখ প্রকাশ করলেন একবারে ডাল এবং রুটিকে সামনে উপস্থাপন করতে না পারার জন্য। পরেরদিন অতি ভোরে মুসাফির বিদায় নিবেন। মুসাফির বললেন, এত ভোরে আমি কিছু খাবো না, তাই আপনার কষ্ট করতে হবে না। রাত শেষ হলো, ভোরের লক্ষণ দেখা দিল। মুসাফিরকে বিদায় দেওয়ার জন্য গৃহকর্তা প্রস্তুত। গৃহকর্তা মুসাফিরকে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি বাগদাদ কেন যাচ্ছেন? মুসাফির উত্তর দিলেন, আমার বাড়ি যেই শহরে সেখানে বড় ডাক্তার নেই, বাগদাদে বড় ডাক্তার আছে। আমার চিকিৎসার জন্য যাচ্ছি। বাড়ির কর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কী অসুস্থতা? মুসাফির উত্তর দিলেন, খাওয়া-দাওয়ায় রুচি কমে গিয়েছে, বেশি কিছু খেতে পারছি না এটাই আমার অসুস্থতা। গৃহকর্তা বললেন, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি ভেতর থেকে আসছি, তারপর যাবেন। গৃহকর্তা বাড়ির ভেতরে গেলেন এবং কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে খালি হাতে হাসি মুখে মুসাফিরকে বিদায় দিলেন। কিন্তু মুসাফির কৌতূহলী। মুসাফির জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ভেতরে গেলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসলেন, আমাকে আগে বিদায় দিলেন না, পরে বিদায় দিলেন, এর কারণটা কি বলবেন? কেন গেলেন? কেন দেরিতে বিদায় দিলেন? গৃহকর্তা উত্তর দিলেন: ‘আমি ভেতরে গিয়ে চুপচাপ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া জানালাম যে, তিনি আমার বাড়িতে মেহমান দিয়েছিলেন, আবার এই প্রার্থনাও করলাম যে, ওই মেহমান যেন বাগদাদ থেকে ফেরত যাওয়ার সময় এই পথ দিয়ে না যায়, অন্য রাস্তা দিয়ে যায়, অন্যত্র রাত্রিকালীন আশ্রয় গ্রহণ করে।’ ধন্যবাদ জানিয়ে মেহমান বিদায় নিলেন। কলামের শিরোনাম অনুযায়ী এই গল্পের উপসংহার টানবেন পাঠকগণ।
কলামটি যখন লিখছি, তখন আমার মন বারবার বলছে যে, কিছু বদঅভ্যাস হঠাৎ করে বদলায় না। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে একটি সরকারি বদঅভ্যাস; যথা নির্বাচন খেয়ে ফেলা। জনগণ কর্তৃক ভোট প্রদানের অধিকারকে পদদলিত করে, নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। ভোট কেন্দ্র দখল করা, ব্যালট পেপার দখল করে আগেভাগে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা, প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টদের স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করা ইত্যাদি কাজ এখন সরকারি পক্ষের জন্য পান্তাভাত। নির্বাচন কমিশনকে এখন আর স্বতন্ত্র কোনো সাংবিধানিক সংগঠন বলে মনেই হয় না।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনীতি

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ