Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাড়ে না ইজারামূল্য

সরকার শত কোটি টাকার রাজস্ববঞ্চিত ,কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি সাত হাটে

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বছর বছর নিত্য পণ্যের দাম বাড়লেও বাড়েনা ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী কোরবানির হাটের ইজারামূল্য। বছরের চাকা ঘুরলেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। কখনো কমেছে এমন নজির নেই। বৃদ্ধিই যেন অনিবার্য। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও উল্টো স্রোতে হেঁটেই চলছে রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটের ইজারা। ২০১১ সালে ঢাকা অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের ১৩টি হাটের ইজারামূল্য ছিল সাত কোটি ৩২ লাখ ৫৭ হাজার ২৫১ টাকা। পাঁচ বছর পরে ২০১৬ সালে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের ২২ হাটের ইজারা মূল্য দাঁড়ায় ১৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে ২৩টি হাটের ইজারা মূল ছিল ২৩ কোটি টাকা। চলতি বছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মোট ২০ হাটের দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে প্রথম দফায় দুই কর্পোরেশনের ৬টি করে ১২টি হাটের ইজারামূল্য পাওয়া গেছে ১২ কোটি ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭১২ টাকা।
গত ১৯ জুলাই ছিল দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাকি ৭ হাটের দ্বিতীয় দফা টেন্ডারবক্স খোলার দিন। এ দিনেও ঐ ৭টি হাটের একটিতেও কোন সিডিউল জমা পড়েনি। আর উত্তর সিটির একটি হাটের দ্বিতীয় দফা টেন্ডারবক্স খোলা হবে আগামী ২৪ জুলাই মঙ্গলবার। সে দিন দেখা যাবে এই হাটের ভাগ্যে কি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, সিন্ডিকেট করে এবার হাটের টেন্ডারে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে না ইজারাদারদেরকে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কৌশলে ইজারাদারদের টেন্ডার থেকে বিরত রেখেছেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জনের টার্গেটে এ কাজ করা হচ্ছে।
২০১১ সাল থেকে ২০১৮সাল, এই সাত বছরে বেড়েছে ঢাকা শহরের মানুষের জীবনমান, বেড়েছে চাল, ডাল, তেল, তরি-তরকারিসহ কতকিছুর দাম। ২০১১ সালে অবিভক্ত ডিসিসি’র বাজেট ছিল দেড় হাজার কোটি টাকা। তার ৮ বছর পরে এসে ২০১৮-১৯ সালের অর্থ বছরে শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। শুধু বড় হচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ইজারামূল্যের অংক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাকার অভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে জোড়া তালি দিয়ে। মাস শেষে কর্পোরেশনের কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন-ভাতা দিতে একাউন্ট সেকশন হিমশিম খাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে ঘুরতে হচ্ছে, এই কর্পোরেশন থেকে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা কর্মচারিরা তাদের অবসর সুবিধা আদায় করে নিতে। টাকার অভাবে তাদেরকে যথা সময়ে অবসর সবিধা দিতে পারছে না ডিএসসিসি।
অন্যদিকে, ঢাকার অভিজাত ও ধনী কর্পোরেশন হিসেবে পরিচিত উত্তর সিটি কর্পোরেশনও এবার বাজেট ঘাটতিতে পড়েছে বলে জানা গেছে। টাকার অভাবে তাদের উন্নয়ন কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রাজধানীর অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাটে রাজস্ব ফাঁকির জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন অস্থায়ী ২০ হাটের দরপত্র আহ্বান করলেও আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ১২টির। এর অধিকাংশরই নামমাত্র ইজারামূল্য দিয়েছেন আবেদনকারীরা।
দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরসহ কর্মকর্তা, কর্মচারি ও তাদের সুবিধাভোগী চক্র সেসব আবেদনই অনুমোদন করাতে তৎপরতা চালাচ্ছে। আর বাকি হাটগুলো খাস কালেকশনের শর্তে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বরাদ্দ দেয়ার গোপন তৎপরতাও চলছে। এ অবস্থায় চলতে থাকলে এবার এখান থেকে ন্যূনতম রাজস্বও সরকারি কোষাগারে জমা পড়বে না।
অভিযোগ উঠেছে, জাতীয় নির্বাচনের নিকটবর্তী সময়ে কোরবানি ঈদ আসায় এসব হাট থেকে নির্বাচনী খরচ সংগ্রহ ও নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখতে সরকারদলীয় ব্যক্তিরা তা ইজারা নিতে জোর তৎপর। এ তালিকায় রয়েছে সংসদ সদস্য, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। তাদের সহযোগিতা করছেন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী। সর্বশেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় এর বৈধতা দেবেন ঢাকার দুই মেয়র, যে পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন আওয়ামী লীগের সক্রিয় দুই নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিবছর ঢাকার কোরবানির হাট ইজারায় অংশ নেয়া এক ইজারাদার ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা তাকে ডেকে নিয়ে বলে দিয়েছেন, এ বছর তিনি যেন কোরবানির হাট ইজারায় অংশগ্রহণ না করেন। কারণ সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে অনেক খরচ আছে। তিনি যেন অহেতুক ইজারায় অংশ নিয়ে হাটের দাম না বাড়ান। তিন দফার টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে তারা কর্পোরেশন থেকে খাস আদায়ের শর্তে নাম মাত্র মূল্যে হাটগুলো নিয়ে তাদের নেত-কর্মী দিয়ে পরিচালনা করাবেন। এ থেকে উপার্জিত অর্থ আগামী নির্বাচনে খরচ করা হবে।
অস্থায়ী কোরবানির হাটগুলো থেকে দুই সিটি কর্পোরেশন যেভাবে রাজস্ব হারাচ্ছে। রহমতগঞ্জ হাটের ইজারা মূল্য ছিল ২০১১ সালে পাঁচ লাখ ৬২ হাজার ২৫০ টাকা। সাত বছর পরে এসে ২০১৮ সালে এই হাটের ইজারা মূল্য হয়েছে ১১ লাখ সাত হাজার ১৫০ টাকা। এই সাত বছলে এই হাটের ইজারা মূল্য বেড়েছে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা। এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে এই হাটের ইজারামূল্য ছিল ৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা। ওই বছর হাটে গরু বিক্রি হয় ৪ হাজার ৯৮০টি। গরুর গড় মূল্য অনুযায়ী ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা হাসিল পায় ইজারাদার। ইজারামূল্যের চেয়ে সে বছর ওই পশুর হাট থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেশি হাসিল আদায় হয়। ডিএসসিসি গতবছর এ হাটের ইজারামূল্য নির্ধারণ করে মাত্র ১০ লাখ ৩ হাজার টাকা। এবারও হাট ইজারা একই প্রক্রিয়ায় শুরু করেছে ডিএসসিসি।
ঝিগাতলা হাজারীবাগ অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটের ২০১১ সালের ইজারা মূল্য ছিল ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে এই হাটের ইজারা মূল্য এক কোটি ১৫ লাখ টাকা হয়েছে। অন্য হাটের তুলনায় এ হাটের দর একটু বেশি উঠলেও এ হাট থেকে ইজারাদারেরা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লাভ করে যাচ্ছে। কর্পোরেশন চাইলে এই হাটটি আরও বেশি দরে ইজারা দিতে পারে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে এই হাটের ইজারামূল্য ছিল ৬৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। অথচ সে বছর ওই হাটে গরু বিক্রি হয় ১০ হাজার ৩২০টি ও ছাগল ৪ হাজার ১২০টি। শতকরা ৫ টাকা হিসাবে ইজারাদার গরুতে হাসিল আদায় করে ৩ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ছাগলে ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ৩ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার টাকা। ইজারামূল্য থেকে ইজারাদার ওই বছর সেখান থেকে বেশি পায় ২ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। এসব জানার পরও গতবছর ঝিগাতলা হাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৭০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এবারও একই পথে চলছে ইজারা-প্রক্রিয়া।
ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এবার ২০টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় বসবে ১৩টি, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ৭টি। এসব হাটের ইজারা নিতে প্রথম থেকেই চক্র সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে।
সংশিষ্টরা জানান, ১০ জুলাই দক্ষিণ ও ১২ জুলাই উত্তর সিটির দরপত্র খোলা হয়। এতে দেখা যায়, উত্তরের ৭ হাটের ৬টির জন্য আবেদন জমা পড়েছে। এতে ইজারামূল্য প্রস্তাব এসেছে ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৯২ হাজার ৫৬২ টাকা। অন্যটিতে দরপত্রই জমা পড়েনি। দক্ষিণের ১৩ হাটের মধ্যে আবেদন জমা পড়েছে ৬টির। এতে ২ কোটি ৭০ লাখ ৯৭ হাজার ১৫০ টাকা ইজারামূল্য দেখিয়েছে তারা। ৭টিতে দরপত্রই জমা পড়েনি। যাচাই-বাছাই শেষে এ ১২ হাটের ইজারাদারও চূড়ান্ত করে ফেলেছে দুই সিটি কর্পোরেশন। ১১টিই পাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। অন্যটিও সরকারসংযুক্ত ব্যক্তির। এগুলো এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় দুই মেয়রের টেবিলে রয়েছে বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে রাজধানীর কোরবানি পশুর হাট থেকে প্রতিবার সরকার অন্তত শত কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়। এরপরও গত ২ বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন আরও বেশি রাজস্ব বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়। জমাপড়া দরপত্র বিশ্লেষণ করে সবকিছু ঠিক থাকলে শীর্ষ দরদাতাকে ইজারা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কে কোন দল করে, তা বিবেচ্য না। অবশ্য বিগত বছরের চেয়ে কম দর হলে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হবে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান নীতিমালার কারণে সিটি কর্পোরেশন চাইলেও কোনো হাটের ইজারামূল্য বাড়াতে পারে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে এবার ডিএসসিসির অস্থায়ী কোরবানি হাট ইজারা দেয়া হচ্ছে। সম্পত্তি বিভাগের সঙ্গে কোনো চক্রের সম্পর্ক নেই। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হাট ইজারার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কারা কী অভিযোগ করল, সেটা দেখার বিষয় নয়। ###



 

Show all comments
  • তানিয়া ২১ জুলাই, ২০১৮, ৩:০৯ এএম says : 0
    সব জায়গায়ই সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিটি কর্পোরেশন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ