Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অতিশয় মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক

| প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

মর্মান্তিক বললেও কম বলা হয়। সহপাঠীদের চোখের সামনে বাসের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজিব ও দিয়া খানম মিম। ঘাতক বাসের চাপায় আহত হয়েছে আরো ১০-১২ জন, যাদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত রোববার রাজধানীর বিমান বন্দর সড়কের রেডিসন বøু হোটেলের উল্টোপাশে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। পত্রপত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায়, মোহাম্মদপুর-আবদুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী দুটি বাস ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে একটি বাস ওভারটেক করে চলে যায়। অন্য বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ওই সময় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা রেডিসন বøু হোটেল সংলগ্ন বাস স্টপেজে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। নিয়ন্ত্রণহারা বাসটি তাদের ওপর উঠে পড়ে। ঘটে এই মর্মন্তক হতাহতের ঘটনা। ঘটনার পর পরই সেখানে সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারি পরিস্থিতি। কান্না আর আর্তনাদ গোটা এলাকায় পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। কলেজের শিক্ষার্থীরা এ খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে অর্ধ শতাধিক গাড়ি ভাংচুর করে। সড়কে সৃষ্টি হয় সাময়িক অচলাবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখেনা, শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তাদের সহপাঠী রাজিব ও মিমকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। ছোট বেলায় বাবা হারা রাজিব খালার বাসায় থেকে পড়ালেখা করতো। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিলো বাস চালক জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে মিমেরও। তাদের সঙ্গে তাদের স্বপ্নও হারিয়ে গেছে। এভাবে প্রতিদিন সড়কে কত মানুষের জীবন ও স্বপ্ন যে হারিয়ে যাচ্ছে, কত পরিবারে যে বেদনা ও হাহাকারের পাহাড় জমছে তার ইয়ত্তা নেই। ঘটনার বিবরণ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, দুই বাসের প্রতিযোগিতা বা দুই ড্রাইভারের রেষারেষিতেই এই অপরিমেয় বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটেছে। এটা মোটেই দুর্ঘটনা নয়, এটা রীতিমত হত্যাকাণ্ড।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রতিদিনই সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ ঝরছে। মানুষ আহত ও পুঙ্গ হচ্ছে। এক খবরে দেখা গেছে, গত ঈদের সময় অর্থাৎ ১২ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৪৮ জন, আহত হয়েছে ৭১৭ জন। অন্য এক তথ্যে জানা গেছে, ঈদের আগে-পরে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে নিহত হয়েছে ৩৩৯ জন। আরেক খবরে জানা গেছে, ৬ মাসে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৩০২৬ জনের। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অদক্ষ, ট্রাফিকবিধি সম্পর্কে অজ্ঞ ও লাইসেন্সবিহীন চালকই দায়ী। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কিছু আগে বলেছেন, চালকদের অর্ধেকই লাইসেন্স বিহীন। পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি আরো জানিয়েছেন, দেশে গাড়ি আছে ৩৫ লাখ। আর চালক আছে ১৮ লাখ ৭০ হাজার। নিহত মিমের বাবা বাস চালক হিসাবে তার অভিজ্ঞতায় বলেছেন, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের হাতে মালিকরা তাদের গাড়ি তুলে দেয়। চালকদের মধ্যে অনেকে আছে নেশাগ্রস্ত। বলা বাহুল্য, অদক্ষ, লাইসেন্সবিহীন ও নেশাগ্রস্ত চালক গাড়ি চালালে তো দুর্ঘটনা ঘটবেই এবং হতাহত হওয়াও স্বাভাবিক। অদক্ষ চালকদের যারা লাইসেন্স দিচ্ছে, সেই কর্তৃপক্ষ, যারা যাচাই-বাছাই না করে যার-তার হাতে গাড়ি তুলে দিচ্ছে, সেই মালিকরা, সড়ক দুঘর্টনা, প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকদের যেমন কিছু হয় না, তেমনি লাইসেন্সদাতা প্রতিষ্ঠান ও মালিকদেরও কিছু হয় না। সংঘশক্তিই এক্ষেত্রে সব কিছু নির্ধারণ করে। সংঘশক্তি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে সরকারেই মন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের জোর দাবি থাকলেও এই সংঘশক্তির প্রভাবে সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে প্যানাল কোডের ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা হয়। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর। কোনো বড় ধরনের প্রাণহানিকর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তা নিয়ে জনপ্রতিক্রিয়া উত্তুঙ্গে উঠলে সংঘশক্তি ঘাতক চালকের পাশে এসে দাঁড়ায়। যানচলাচল বন্ধ করে দিয়ে জনগণকে জিম্মি করে ফেলে। পরে একটা রফা হয়। এই সংস্কৃতিই চলছে। ফলে দুর্ঘটনা আর প্রাণহানি বন্ধ হচ্ছে না। আলোচ্য দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে নৌ পরিবহন মন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নির্বাহী সভাপতি শাহজাহান খান যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দু:খজনক, অনভিপ্রেত এবং বিভিন্ন মহলে তার জোর প্রতিবাদ উঠেছে। দুর্ঘটনার পরপরই সচিবালয়ে সাংবাদিকরা তাকে বলেন, চালকের স্বেচ্ছাচারিতায় সড়কে নিয়মিত প্রাণ ঝরছে। আজও ঢাকার কুর্মিটোলায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, এদের (ড্রাইভার-হেলপার) আপনি প্রশ্রয় দেন। আপনার প্রশ্রয়ে তারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। জবাবে তিনি বলেন, অপরাধ করলে শাস্তি হবে। এই শাস্তির বিরোধিতা করার কারো কোনো সুযোগ নেই। এরপর যা বলেন, তা প্রকান্তরে চালকদের পক্ষেই যায়। বলেন, ভারতের মহারাষ্ট্র এক দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছে। তা নিয়ে কোনো হৈচৈ নেই। অথচ বাংলাদেশে সামান্য কোনো ঘটনা ঘটলেই হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।
দুইজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং ১০/১২ জনের আহত হওয়ার ঘটনা মোটেই সামান্য নয়। সামান্য নয় ৬ মাসে সোয়া তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু। এর আগেও তিনি বাস শ্রমিকদের পক্ষে এমন বক্তব্য রেখেছেন, যাকে অনেকেই মনে করেন, উস্কানিমূলক। তার সর্বশেষ বক্তব্যটিও এর ব্যতিক্রম নয়। সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যমে মানুষ হত্যার অনুমোদন হিসাবে এ বক্তব্য গণ্য হতে পারে। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং মন্ত্রী হিসাবে এ ধরনের বক্তব্য তিনি রাখতে পারেন না, রাখা উচিৎ নয়। হত্যায় উৎসাহ বা প্ররোচনা দেয়া অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তার এহেন বক্তব্যের জন্য সড়ক দুর্ঘটনার সব হত্যার আংশিক দায় তার ওপর গিয়েও বর্তাবে। এই নিবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে তখন বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা অবরোধ সৃষ্টি করেছে। যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে এবং ঘাতক চালকের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে। তারা নৌপরিবহন মন্ত্রীর পদত্যাগ ও বিচারও দাবি করছে। আমরা মনে করি, সংঘশক্তির দাপট ও প্রতাপ শূণ্যে নামিয়ে না আনা পর্যন্ত চালকদের দৌরাত্ম্য ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হবে না, বন্ধ হবে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক ছাড়া কেউ যাতে গাড়ি চালাতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য যে শাস্তি এখন আছে, তা বাড়াতে হবে এবং বাস মালিকদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাস চাপায়

১৬ অক্টোবর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন