Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ক্রেডিট ফাঁসে গ্রাহক

সেবায় পিছিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের ৫২ হাজার গ্রাহক, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে বেশি মুনাফা আদায়

হাসান সোহেল : | প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

দৈনন্দিন অধিকাংশ আর্থিক লেনদেনে এখন আর নগদ টাকা নয়, কার্ডের ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন গ্রাহকরা। আর তাই কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিল পরিশোধ- সব ক্ষেত্রেই দিন দিন বাড়ছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যাবহার। এমনকি বিদেশে অবস্থানকালেও বাংলাদেশিরা এখন কার্ড ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছে। বেড়ানো কিংবা চিকিৎসা অথবা ব্যবসার প্রয়োজন- যে কারণেই বিদেশ যাওয়া হোক না কেন, পকেটে করে বিদেশি মুদ্রা নিয়ে যাওয়ার চেয়ে কার্ডেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তাঁরা। অর্থাৎ যে লেনদেন আগে মানুষ নগদে করতেন, সেসব ক্ষেত্রে এখন কার্ডের ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে মানুষ।
সাধ ও সাধ্যের মধ্যে টানাপোড়েনের সমাধান দিতেই ক্রেডিট কার্ডের যাত্রা শুরু। আগামী দিনের চাহিদাকে বর্তমানে মেটানোর এক অনন্য সুযোগ করে দিয়েছে এই কার্ড। ঋণ সুবিধায় ব্যক্তিপর্যায়ে কেনাকাটা ও নগদ অর্থের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটাতে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রেডিট কার্ড। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও চাহিদা বাড়ছে সেবাটির। বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৩২টি বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, এছাড়াও কিছু ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড সেবা দিচ্ছে। যারা এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কিত রিপোর্ট করেনি। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তালিকায় নেই।
তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে দেশে ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং সেবার উপর নির্ভরশীলতা তথা কার্ডভিত্তিক লেনদেন ক্রমান্বয়ে গ্রাহকের নিকট জনপ্রিয় হচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি নির্ভর কার্ড নিয়ে গ্রাহকের সামনে হাজির হচ্ছে ব্যাংকগুলো। বর্তমানে কার্ডের সেবার আওতায় রয়েছে দেশের প্রায় ১০ লাখ গ্রাহক। তবে নানান সুবিধা বিবেচনা করে গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ড নিলেও অসুবিধা কম নয়। অনেকের কাছে এটি এখন আতঙ্কের বিষয়। বিভিন্ন ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে নানান আধুনিক সুবিধা দিলেও দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক ‘ন্যাশনাল ব্যাংক’ এখানে অনেকটা পিছিয়ে। সুদের উচ্চ হার, নামে-বেনামে অদৃশ্য ফি আদায়সহ নানা কারণে ব্যাংকটির গ্রাহকের কাছে এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্রেডিট কার্ড। বছরের পর বছর তারা প্রতারণার শিকার। দেশের প্রথম ব্যাংক হিসেবে চালু করা ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডেও তাই খুব একটা আগ্রহ নেই গ্রাহকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ি, বর্তমানে নেয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (এনএফসি) প্রযুক্তির মাধ্যমে সংঘটিত ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে ব্যাংক। এনএফসি প্রযুক্তিতে ক্রেডিট কার্ডে কন্টাক্টলেস পেমেন্ট সার্ভিস লেনদেন ইতোমধ্যে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক চালু করেছে। অথচ এখনও সেকেলে সেবা দিচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
ব্যাংকটির ধানমন্ডির সীমান্ত স্কয়ারের কার্ড ডিভিশনে গিয়ে একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে ক্রেডিট কার্ড সেবার যাত্রা শুরু হলেও অন্যান্য ব্যাংক থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে ব্যাংকটি। এখন পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫২ হাজার হলেও অধিকাংশ গ্রাহকই বিপাকে।
কার্ড ডিভিশন থেকে জানা যায়, ব্যাংকটির বিপণন ব্যাবস্থা খুবই দুর্বল। বর্তমানে আলাদা বিক্রয় প্রতিনিধি নেই। মাত্র দু’জন বিক্রয় প্রতিনিধি দিয়েই চলছে ক্রেডিট কার্ড ডিভিশন। অন্যান্য ব্যাংকের মতো চুক্তিভিত্তিক কর্মীও নেই। এমনকি ২০ হাজার টাকার কার্ড অনুমোদন দিতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পর্যন্ত যেতে হয়। একটি ক্রেডিট কার্ড পেতেও অনেক সময় ব্যয় হয় গ্রাহকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবেদকে জানান, ‘ভাই ক্রেডিট কার্ড নিয়ে কিছু বলার নেই। গ্রাহকরা আমাদের কার্ড ব্যবহার করে চরম বিরক্ত’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা দুর্বলতায় প্রথম ব্যাংক হিসেবে ক্রেডিট কার্ড সেবা চালু করলেও নানা প্রতিবন্ধকতা এবং সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় গ্রাহক ধরে রাখতে পারছেন না তারা। বিশেষ করে স্থানীয় কার্ডের চাহিদা একেবারেই নেই।’ ওই কর্মকর্তা জানান, অন্যান্য ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে নানা ধরণের ফি নিলেও বিভিন্ন ক্যাম্পেইন (ছাড়) এর মাধ্যমে গ্রাহককে নানা সুবিধা দেয়। একই সঙ্গে কার্ড ব্যবহারকারীরা এক বছর ফ্রি সেবা পায়। যা ন্যাশনাল ব্যাংকে নেই। তিনি ক্ষোভের সাথে জানান, সেবার মানসিকতার পরিবর্তে অতি মুনাফার প্রবণতার কারণেই ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম।
সূত্র আরও জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা পাচ্ছেন না ইএমআই সুবিধা। ইএমআই হলো- গ্রাহক টাকা খরচ করার পর তা নির্দিষ্ট সমান কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারে। যা কোন কোন ব্যাংকে ১৮টি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে কোন ধরণের চার্জ নেওয়া হয় না। অথচ ন্যাশনাল ব্যাংকের এই সুবিধাই নেই।
এদিকে ক্লোন এটিএম কার্ড ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি ও অর্থ জালিয়াতির ঘটনা এড়াতে চিপ-ভিত্তিক এটিএম কার্ড চালু করেছে বিভিন্ন ব্যাংক। যেখানেও পিছিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক। চীপ কার্ডের সুবিধা সম্পর্কে জানা যায়, গ্রাহক ছাড়া অন্য কেউ এই কার্ড ব্যবহার করতে পারবে না।
সূত্র মতে, দেশের ও বিদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে ভিআইপি লাউঞ্জে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা পান। স্বাভাবিক এই সেবাটিও পান না ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহকরা। ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা শুধুমাত্র বাংলাদেশে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই সেবা ভোগ করতে পারেন। এমনকি এটা ছাড়া দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরেও এই সেবা দিতে পারেনি ন্যাশনাল ব্যাংক। তবে ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন কার্ডে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দরপত্রও আহবান করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তারা এনএফসি কার্ড চালু করবে।
এদিকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংক উচ্চ সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে বলে অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। আর তাই সার্ভিস চার্জ গ্রাহকদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেডিট কার্ডের জন্য একটি গাইডলাইন দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড বাদে অন্য সেবাগুলোর মধ্যে যে সেবায় সর্বোচ্চ সুদ বা চার্জ আরোপ করা হয়, তার চেয়ে ৫ শতাংশের বেশি মুনাফ বা চার্জ আদায় করা যাবে না ক্রেডিট কার্ডের ওপর। যেমন- একটি ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদ আদায় করে ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ ২৩ (১৮+৫) শতাংশের বেশি সুদ বা চার্জ আদায় করা যাবে না। গত ১ জানুয়ারি থেকে এ নীতিমালা পরিপালনের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
অথচ গত মে মাসে ব্যাংকগুলোর ঋণ বা বিনিয়োগের সুদ বা মুনাফার হার বিবরণী পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায়, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক এ নির্দেশনা পরিপালন করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ আদায় করে ২৭ শতাংশ। আর অন্য ঋণে সর্বোচ্চ সুদ আদায় করে ১৫ শতাংশ। ফলে এ দুই ঋণের সুদ হারের পার্থক্য ১২ শতাংশ। যদিও ন্যাশনাল ব্যাংকের কার্ড বিভাগের সূত্র অনুযায়ি- সুদের উচ্চ হার, নামে-বেনামে অদৃশ্য ফিসহ ক্রেডিট কার্ডে প্রায় ৩০ শতাংশ সুদ আদায় করছে দেশের প্রথম এই বাণিজ্যিক ব্যাংকটি।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) চৌধুরী মোশতাক আহমেদের সাথে একাধিকবার মুঠো ফোনে কল ও এসএমএস দিলেও তিনি কোনও বক্তব্য দেননি।
উল্লেখ্য, ক্রেডিট কার্ডে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে দেশের ৩২টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী, জনতা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, এবি, এশিয়া, বাংলাদেশ কমার্স, ব্র্যাক, দি সিট, ডাচ-বাংলা, মার্কেন্টাইল, এনআরবি, সোস্যাল ইসলামী, সাউথইস্ট, ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ঢাকা, ইস্টার্ন, এক্সিম, আইএফআইসি, যমুনা, মিডল্যান্ড, মধুমতি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল, এনসিসি, এনআরবি কমার্শিয়াল, ওয়ান, দি প্রিমিয়ার, প্রাইম, স্ট্যান্ডার্ড ও কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন। ##



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্রেডিট কার্ড

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
৩ এপ্রিল, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ