Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চিহ্নিত এক হাজার ২০০ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

পুলিশের অভিযান : শঙ্কায় বহু শিক্ষার্থী

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সদ্য সমাপ্ত আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা শংকায় রয়েছে। ১২শ’ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলো পুলিশের ভাষায় গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা ও অস্থিরতা উস্কে দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে । এখন তাদের ধরার জন্য বাড়ি বাড়ি পুলিশি অভিযান শুরু হয়েছে। তাই অনেক শিক্ষার্থী সরকারের প্রতিশোধ আতঙ্কে ভুগছে। যুক্তরাজ্যের দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় গত শুক্রবার ‘নান উইল বি স্পেয়ার্ডঃ স্টুডেন্টস ফেয়ার রিপ্রাইজালস ওভার বাংলাদেশ আনরেস্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গত শনিবার (৪ আগস্ট) পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছোঁড়া শুরু করে। তখন ফোনে ফোনে একটি তালিকা ছড়িয়ে দেয়া হয়। ওই তালিকায় কিছু নাম, ফোন নম্বর ও ঠিকানা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ‘দয়া করে এই ঠিকানাগুলো আপনার বিশ্বস্ত মানুষকে মোবাইল মেসেজ বা মেজেঞ্জারে পাঠান।’ এক শিক্ষার্থী ওই ঠিকানা শেয়ার করে লেখেন, যদি ঝিগাতলা বা ধানমন্ডির কাছে কারো আশ্রয়ের দরকার হয়, তাহলে আমার বাসায় আসুন। আরেক শিক্ষার্থী লেখেন, ‘অনুগ্রহ করেনিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।’ পরেরদিন শাসক দলের সশস্ত্র সমর্থকরা রাস্তায় নামে। তারা আন্দোলনকারী ও সাংবাদিকদের মারধর করে। এদিন ওই তালিকায় নতুন করে আরো মানুষ তাদের নাম ও ঠিকানা যোগ করে।
এখন পুলিশ তাদের বাড়িতে অভিযান চালানো শুরু করেছে। সদ্য মাধ্যমিকের গন্ডি পার হওয়া শিক্ষার্থী ওয়াজির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার সঙ্গে ফেসবুকে এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর যোগাযোগ ছিল যারা নিজেদের বাড়ির ঠিকানা ওই তালিকায় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব শিক্ষার্থীদের একজন, মাহমুদের সঙ্গে রোববার মধ্যরাতের কিছু পরে হঠাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ফেসবুক ওয়াল থেকে ছবি ও পোস্টগুলো উধাও হতে শুরু করে। কিন্তু কেন সে অনলাইন থেকে উধাও হয়ে গেল? পরে ওই শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আলোচনায় স্থান পায় আতঙ্কগ্রস্ত সব কথা। তাদের একজন লেখেন, সে ভালো কাজ করছে। আমাদেরকে রক্ষা করেছে।
মাহমুদের বন্ধুরা যা আশঙ্কা করছিল তাই সত্যি হয়েছে। রোববার রাতে মাহমুদের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। পুলিশের হাতে পড়ার আগে সে যতটা সম্ভব তার ফেসবুকের পোস্ট মুছে ফেলেছে। পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু গ্রেপ্তার করা হয়নি।
ওয়াজির আরো একজন শিক্ষার্থীর বিষয়ে জানতে পারে, যার বাসায় সোমবার সকালের দিকে অভিযান চালানো হয়েছে। ওই শিক্ষার্থী সরকারের তীব্র সমালোচনা করে পোস্ট দিয়েছিল। পরে সে ফেসবুক থেকে তার পোস্ট ও ছবি সরিয়ে ফেলে। ওয়াজির ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার কাছে জানতে চান, ‘ভাই, আপনি কি ঠিক আছেন? জবাবে হাসির ইমো দিয়ে সে বলে, ‘হ্যাঁ। আপনার কি অবস্থা?’ কিন্তু ওয়াজিরের সন্দেহ, অপরপাশের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নজরদারি করা হচ্ছে।
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর আন্দোলনে বাংলাদেশের রাজধানী টানা ৯ দিন অচল হয়ে ছিল। বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়। পরে তা দুর্নীতি ও সরকারের দায়মুক্তির বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভে রূপ নেয়। গত দু’দিনে আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে। এখন অনেক শিক্ষার্থী সরকারের প্রতিশোধ আতঙ্কে ভুগছে। যে বিষয়টিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভিন্নমতের প্রতি সরকারের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শিক্ষার্থীরা যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সংগঠিত হয়েছে ও আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছে, সেটাই বাংলাদেশের ডিজিটাল যোগাযোগ আইনের অধীনে ডজন ডজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করার জন্য সরকারের কাছে সাক্ষ্য দিতে পারে।
বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছে আমরা তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা রাজনৈতিক নেতা, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তা মুহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, তারা প্রায় ১ হাজার ২০০ অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করেছেন, যেগুলো গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা ও অস্থিরতা উস্কে দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো কাজ শেষ করতে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই ১০-১২ জনের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছি যারা আন্দোলনের সময় ফেসবুক লাইভে এসে গুজব ছড়িয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধেও দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে আন্দোলনকারীদের উজ্জীবিত করা হচ্ছিল, শনিবারের পুলিশি অভিযানের পরে সেগুলো একেবারেই নীরব হয়ে যায়। শুরু থেকেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত এক শিক্ষার্থী স¤প্রতি আন্দোলনের পক্ষে তার দেয়া প‚র্বের পোস্টগুলো সরিয়ে নেন। নতুন একটি পোস্টে লেখেন, ‘ভুয়া তথ্য ছড়ানোর জন্য আমি দুঃখিত। তখন আমি আবেগাক্রান্ত ছিলাম।’ এর কিছুক্ষণ পর সে নিজের অ্যাকাউন্টই নিষ্ক্রিয় করে দেয়। বন্ধুদেরকে জানায়, নিরাপত্তার স্বার্থে সে ঢাকা ছাড়ছে। বন্ধুদের সঙ্গে তার আদান-প্রদানকৃত মেসেজ গার্ডিয়ানের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এতে সে লিখেছে, তারা আমার বাবাকে ফোন করে ভয়ঙ্কর সব হুমকি দিয়েছে। তারা বাবাকে বলেছে, আমরা আপনার সামনেই আপনার মেয়েকে নাজেহাল করবো।’ এতে আতঙ্কিত হয়ে মা এখন আমাকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
যারা আন্দোলন উস্কে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট করেছেন, তাদের একটি তালিকা স¤প্রতি ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘এসব ব্যক্তি গুজব ছড়িয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সহিংসতায় উস্কে দিয়েছেন।’ ছাত্রলীগের নেতারা ‘তথাকথিত’ ছাত্রদের নিয়ে ফেসবুক লাইভে হাজির হচ্ছেন। সেখানে এসব ছাত্ররা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, তারা সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছেন।
ফেসবুক ব্যবহারকারীর দিক দিয়ে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। অন্য সব জায়গার মতো এই শহরেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিন্নমত প্রকাশের বড় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেগুলো মানুষ চায়ের দোকানে বা চার দেয়ালের মধ্যে আলোচনা করতো, এখন অন্যরা সেসব বিষয়ে জানার সুযোগ পেয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সরকার এখন এসব বিষয়ে অতিমাত্রায় কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। অস্থিতিশীলতা উস্কে দেয়া বা ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করার দায়ে সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া আরো সহজ করতে ২০১৩ সালে দেশের ডিজিটাল কমিউনিকেশন আইন সংস্কার করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় থেকেই গ্রেপ্তার ও নাজেহাল করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ আইন অনুযায়ী গত ৫ বছরে ১ হাজার ২৭০টি অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারও স্বীকার করেছে যে, এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এর পরেও তারা আইনটি বাতিল করে নি।
এই আইনে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করে। বলা হয়, আন্দোলনের সময় ফেসবুক পোস্ট ও আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি উস্কানি দিয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ওমর ওয়ারাইচ বলেন, আইনটি এতই অস্পষ্ট যে, এটা দিয়ে সরকারের অপছন্দনীয় যে কোন মন্তব্য বা বিবৃতির দায়ে শাস্তি দেয়া সম্ভব। শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে এই আইনের ব্যবহার করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেসব তরুণরা শান্তিপূর্ণভাবে অনলাইনে তাদের মত প্রকাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধেও একই আইনের প্রয়োগ করা হতে পারে।
এখন ঢাকার অনেক শিক্ষার্থী বিক্ষোভের বিষয়ে অনলাইনে কোন পোস্ট করা বন্ধ করে দিয়েছে। মাহমুদুন্নবী নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, গত সপ্তাহে যারা রাস্তায় নেমেছিল, তাদের অনেকেই এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। ভুয়া তথ্য ছড়ানোর দায়ে পুলিশ মানুষদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করছে। এটা আমাদের সবার জন্য একটি আতঙ্কজনক সময়। অতীতে এত ব্যাপক মাত্রায় এমন ঘটনা কেউ দেখেনি।



 

Show all comments
  • তপন ১২ আগস্ট, ২০১৮, ৩:৩৬ এএম says : 0
    কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি
    Total Reply(0) Reply
  • হাবিব ১২ আগস্ট, ২০১৮, ৩:৩৭ এএম says : 0
    লেবু বেশি চাপলে তেতো হয়ে যায়
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ খায়রুল ইসলাম ১২ আগস্ট, ২০১৮, ২:১১ পিএম says : 0
    বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি
    Total Reply(0) Reply
  • অর্ণব ১২ আগস্ট, ২০১৮, ৮:৪০ পিএম says : 0
    দেশে গনতন্ত্র নাই,তাই বাকস্বাধীনতাও নাই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ