Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

| প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব ও পুর্নবাসনের প্রচেষ্টা যখন আশানুরূপ গতি পাচ্ছেনা, তখন জাতিসংঘসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবতা বিরোধি অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবী তুলেছে। প্রায় ৫ দশক ধরে চলা নিপীড়নে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে অর্ধেকের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত সামরিক অভিযানটি ছিল স্পষ্টতই জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যার প্রয়াস। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয়া শিশুদের প্রায় অর্ধেকই তাদের পিতা, পিতা-মাতা হারিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ রিপোর্টে এ তথ্য পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন সম্পর্কিত কমিশনের রিপোর্টেও রোহিঙ্গা সংকটের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। আনান কমিশন শুধু সংঘটিত ঘটনাবলীর চিত্রই তুলে ধরেনি,তারা এ সংকট উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ বা সুপারিশও করেছেন। রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমার সরকারের সৃষ্টি। মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিক উদ্যোগ ছাড়া এ সংকট উত্তরণের কোন সহজ পথ নেই। এ কথা প্রায় সকল পক্ষই স্বীকার করেছেন।
গত ১৮ আগস্ট ৮০ বছর বয়েসে কোফি আনান ইন্তেকাল করেছেন। অনেক বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে রোহিঙ্গা সংকট উত্তরণে কোফি আনানের প্রচেষ্টা স্মরনীয় হয়ে থাকবে। এই কমিশনে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব আছে এবং সুচির সরকার আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করার পরও বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্বের সুরাহা ও নিরাপত্তার স্থায়ী সমাধানের প্রশ্নে মিয়ানমারের ভূমিকা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানানো হচ্ছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার সাথে জড়িত মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের আওতায় আনতে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। তবে কোন চাপ ও হুমকি পরোয়া করছেনা মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নেত্রি অং সান সুচি’র ভূমিকাও সারাবিশ্বে নিন্দিত-সমালোচিত হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সুচি একজন নির্বাচিত নেতা হওয়া সত্বেও তিনি এখন সেখানকার সেনা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বাইরে কিছুই করতে পারছেননা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নেপথে মিয়ানমারে এখনো কার্যত সামরিক বাহিনীর আধিপত্যই বহাল রয়েছে। এহেন বাস্তবতায় এখন রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনার পক্ষে ব্যাপক আন্তর্জাতিক ঐকমত্য গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। গত জুনমাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ৭ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষনা দিয়েছিল। চলতি মাসের মাঝমাঝিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকেও মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর উপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত মানবতা বিরোধি অপরাধ উদঘাটনে গঠিত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির চুড়ান্ত রিপোর্ট পর্যালোচনায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যা চেষ্টার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। গত সোমবার অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ কমিটির সভায় মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসেবে গণ্য করে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ ৬ জেনারেলের পাশাপাশি স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচিও এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারেননা বলে জাতিসংঘ কমিটির সদস্যরা মত দিয়েছেন। ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক ফেইসবুক কর্তৃপক্ষও মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে নিষিদ্ধ করেছে। তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা আন্তর্জাতিক অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞাকে তেমন পরোয়া করে বলে মনে হয়না। চার দশকের বেশী সময় ধরে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা শেষে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর রাখাইনের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিন ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ, ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই ফলপ্রসু হয়নি। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাবিশ্ব ও পরাশক্তিগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত: রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার প্রশ্নে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ ফাইলবন্দি হয়ে থাকলে চলবেনা। এ ধরনের অপরাধের বিচারের প্রশ্নে বিশ্বসম্প্রদায় দায়সারা ভূমিকায় থাকলে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞাই যথেষ্ট নয়। গণহত্যা ও ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাস্তুচ্যুতির জন্য দায়ী মিয়ানমার জেনারেলদের বিচার ও শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সমন্বিত ও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকেও আরো সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন