Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি জরুরি

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

দেশের রফতানি বাণিজ্য বিকাশের জন্য বন্দর সুবিধা সব চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরসহ অন্যান্য বন্দর সম্প্রসারণ, উন্নতি ও পুনর্বিন্যাস সাধন করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। শত চেষ্টা সত্তে¡ও দেশে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে বন্দর সুবিধা বেশি বাড়েনি, বরং কমেছে। আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে পণ্য জাহাজীকরণে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই) ২০১৮-এর প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। সার্বিকভাবে বন্দর সুবিধায় ১৩ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
এলপিআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। ২০১৬ সালের এ সূচকে বিশ্বের ১৬০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৮৭তম। অবশ্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৮তম। বন্দর সুবিধায় জার্মানি শীর্ষ স্থানে আছে। দেশটি ১০০ তে ১০০ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষ স্থানে আছে। আর বাংলাদেশ পেয়েছে ৬২ শতাংশ পয়েন্ট। বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দর সব ধরনের বন্দরের সুবিধা নিয়ে প্রতি দুই বছর পর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। মূলত বন্দর ব্যবহারকারীদের ওপর জরিপের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। গতবারের মতো এবারও র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে জার্মানি। শুল্কায়ন, অবকাঠামো, আন্তর্জাতিক জাহাজীকরণ, বিভিন্ন পর্যায়ে আনুষঙ্গিক সুবিধা, পণ্যের চলাচল পর্যবেক্ষণ, পণ্য খালাসে সময়সীমা বাড়ানো এই ছয়টি সূচকের মাধ্যমে র‌্যাঙ্কিং করা হয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আমদানি রফতানি বাণিজ্য যে হারে বাড়ছে, সেই হারে নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে পারছি না। আবার যে অবকাঠামো সুবিধা আছে, ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে সেই সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এটি অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি। কিন্তু প্রকল্পের কাজের দুর্বলতার কারণে এখনই সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মানে হলো, যে ধরনের অবকাঠামো সুবিধা নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে, এর মান ঠিক থাকছে না।
সব ধরনের বন্দর সুবিধায় বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। অথচ দ্রæত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বন্দর সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প নেই। যে ছয়টি সূচকের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন দেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে, সেখানে চারটি সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল হয়েছে। যেমন শুল্কায়ন সূচকে দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮২তম। এবার সেখানে ১২০তম অবস্থানে নেমে গেছে বাংলাদেশ। অবকাঠামো সূচকে পিছিয়েছে ২২ ধাপ। অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। আন্তর্জাতিক জাহাজীকরণে ১৫ ধাপ পিছিয়ে এখন ৯৯তম স্থানে বাংলাদেশ। বিভিন্ন পর্যায়ে আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সুবিধায় ৮০ থেকে ৯৪তম স্থানে নেমে গেছে। শুধু পণ্যের চলাচল পর্যবেক্ষণ ও পণ্য খালাসে সময়সীমা সূচকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পণ্য খালাসে সময়সীমায় এক ধাপ এগিয়ে এখন ১০৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর পণ্যের চলাচল পর্যবেক্ষণ সূচকে ৩ এগিয়ে ৮৯তম স্থানে জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থান সমুদ্র ও বিমানবন্দর সুবিধায় গতবারের মতো এবারও প্রথম স্থানে রয়েছে জার্মানি। জার্মানি শতভাগ পয়েন্ট পেয়ে এই অবস্থান ধরে রেখেছে। এরপরের দুটি স্থানে যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন। বন্দর সুবিধা সবচেয়ে খারাপ সোমালিয়ায়। বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে ১৬৭তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। দুই বছর আগেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অঞ্চলে শীর্ষে রয়েছে ভারত, তবে দেশটির বিশ্ব অবস্থান ৪২তম। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ৯২, পাকিস্তান ৯৫, মালদ্বীপ ৯৭তম অবস্থানে আছে। আর বাংলাদেশের পেছনে থেকে নেপাল ১২১, ভুটান ১৫১ ও আফগানিস্তান ১৬৫তম স্থানে আছে।
বিশ্বব্যাংকের আগের এলপিআই প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে কত সময় লাগে, কী ধরনের আনুষ্ঠানিকতা করতে হয় এসবের চিত্র দেওয়া হয়েছিল। এমনকি রফতানিমুখী পণ্যের চালান রফতানিকারকের কারখানা থেকে সমুদ্রবন্দর কিংবা বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতে কত সময় লাগে, সেই চিত্র ছিল। কিন্তু এবারের প্রতিবেদনে অন্য দেশের এসব চিত্র থাকলেও বাংলাদেশের এ-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালের এলপিআই অনুযায়ী, এ দেশে পণ্য খালাস বা জাহাজীকরণ করতে বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা স¤পন্ন করতে গড়ে দুই দিন সময় লাগে। আর সরেজমিনে পরিদর্শন করা হলে সে ক্ষেত্রে সময় লাগে গড়ে তিন দিন। কারণ, গড়ে ৩৫ শতাংশ চালানের কাগজপত্র ঠিক থাকে না। ৬৫ শতাংশ চালানের ক্ষেত্রে আমদানি-রফতানিকারকেরা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে। এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে চারটি সংস্থার কাছে ৫ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
বন্দর সুবিধা আরো বাড়াতে হবে। এ জন্য যা করতে হবে, তা হলো:
১. বন্দরে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ যতদিন পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাবে না, ততদিন পর্যন্ত বন্দরের উন্নতি পরিকল্পনা অনুযায়ী করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর রাজনৈতিকভাবে এক বা একাধিক চক্রের নিকট বন্ধী। এই বিশেষ চক্র থেকে চট্টগ্রাম বন্দরকে মুক্ত করতে হবে। স্বাধীনভাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে, প্রয়োজন অনুযায়ী ও ভবিষ্যত চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। তবেই বন্দরের উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। রাজনৈতিক চক্রের কারণে বিগত কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতি ও বন্দরের সার্ভিস গ্রাহকগণ পাচ্ছে না। তাই বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উন্নতির পরিবর্তে অবনতি এসেছে।
২. শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতির ওপর আমাদের দেশের বন্দরের সার্ভিস নির্ভর করে না। কারখানা থেকে রফতানি পণ্য বন্দরে আসার জন্য যে সকল ধাপ রয়েছে, সেই সকল ধাপের উন্নতিও বিশ্বমানের করতে হবে। কারখানাগুলোর অবস্থান, দূরত্ব, রাস্তার অবস্থা, কন্টেইনার রাখার স্থান, উঠানামা করার যন্ত্রপাতি প্রভৃতি বিশ্বমানের হতে হবে।
৩. বিশ্বব্যাংক ছয়টি সূচকের ওপর নির্ভর করে মূল্যায়ন করে থাকে। সূচকগুলো হচ্ছে ১. শুল্কায়ন ২. অবকাঠামো, ৩. আন্তর্জাতিক জাহাজীকরণ ৪. পণ্যের চলাচল পর্যবেক্ষণ ৫. বিভিন্ন পর্যায়ে আনুষঙ্গিক সুবিধা ৬. পণ্য খালাসে সময়সীমা। এই সকল সূচকে উন্নতি করা ছাড়া বন্দর উন্নতি দেখার মতো কখনো হবে না।
৪. আমাদের দেশে শুল্কায়ন পদ্ধতি সেকেলে ও ঘুষে ভরা। ঘুষ ছাড়া কোনো আমদানি-রফতানি কাগজ এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে চলাচল করে না। কোন টেবিলে কত ঘুষ দিতে হবে, তা ঠিক করা রয়েছে। আর যদি কোনো ডকুমেন্টে জটিলতা থাকে, তার ঘুষের পরিমাণ উক্ত শুল্কায়ন কর্তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তাই ঘুষের কারণে আমাদের দেশে আমদানি-রফতানি ব্যয় অধিক ও সময়ক্ষেপণ। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য শীর্ষ পর্যায়ে চিন্তার, কর্মের পরিবর্তন আনতে হবে। একজন বা দুইজন সৎ কর্মকর্তা দিয়ে ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত বন্দর কর্তৃপক্ষ তৈরি হবে না। প্রশাসনের সকল স্তরে সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রশাসন তৈরি করা সম্ভব হলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে। অন্যদিকে অন্যায়, অবিচার, ঘুষ, দুর্নীতি হলে তার দ্রæত সময়ের মধ্যে নিরপেক্ষ, বিচার ব্যবস্থা কাযেম করতে হবে। বিচার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ না হলে দুর্নীতি, ঘুষ সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নির্মূল করা যাবে না।
৫. আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধনের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ অপরিহার্য। ক্ষুদ্র সিঙ্গাপুর বন্দর দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমদানি-রফতানিতে সুবিধা লাভ করছে। সরকার গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে গতি খুবই কম। তৎপরতা আমাদের এখনো দৃশ্যমান হয়নি। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, চার লাইন রাস্তা তৈরি যেমন দৃশ্যমান, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজও তেমন দৃশ্যমান হওয়ার দ্রæত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্দর

১৩ জানুয়ারি, ২০২৩
২৪ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন