Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভারতে ‘গো রক্ষা’র নামে...

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৯ এএম

ধর্মীয় দিক থেকে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দুইটি সমাজ ‘মুসলমান ও হিন্দু’। সুতরাং মুসলমানদের ‘গরু জবাই’ (কোরবানী)কে হিন্দুরা যে ‘গো-হত্যা’ বলে আখ্যায়িত করে থাকে, তা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তারা দেবতার নামে ‘পাঠা-বলী’ দিয়ে থাকে, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু মুসলমানদের ‘পশু কোরবানী’ বা ‘গরু জবাই’ কে ‘হত্যা’ আখ্যায়িত করা হলে সেটা হতে পারে ইসলাম ধর্মের প্রতি অবমাননার নামান্তর। আর তা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে বলা হয়, তবে সেই অবমাননাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রাচীন ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সে কালে বহু হিন্দু গুণী পন্ডিত গরুর গোশত খাওয়া বৈধ মনে করতেন এবং বর্তমান ভারতেও অনেক হিন্দু গরুর গোশত খেয়ে থাকে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং মুসলমানদের ‘পশু কোরবানী’ ও ‘গরু জবাই’কে ‘গো হত্যা’ করা কিংবা ‘বধ করা’ বলা কি অন্যায় ও অসঙ্গত নয়?
কারো ধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষ নয়, প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্য ভারতীয় হিন্দু নেতৃবর্গ উপরোক্ত মর্মে নীতি বাক্য উচ্চারণ করতে অভ্যস্ত, অপরপক্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মাধ্যমে সেখানে রক্তের যে হোলিখেলা চলে তাকে আর যাই হোক ধর্মনিরপেক্ষতা বলার কোনো উপায় নেই। কালের পাতা এরূপ অসংখ্য মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনার জ¦লন্ত সাক্ষী হয়ে বিরাজ করছে। উদাহরণ স্বরূপ ভারতে ‘গো রক্ষা’ বা ‘গরু জবাই’ নিষিদ্ধকরণের ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। এই পুরাতন প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে ভারতে অহরহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে থাকে এবং সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে তার খেসারত দিতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার এরূপ অপূর্ব নজির বিশে^র কোথাও পরিলক্ষিত হয় কিনা সন্দেহ। মুসলমানদের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যে ‘গরু কোরবানী’ একটি ঐতিহ্য বা প্রথা। তাদেরকে এই ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ হতে বঞ্চিত করার জন্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও অহিংসার দাবিদারগণ যে সব অধর্ম ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্ম দিতে সিদ্ধ হস্ত, সেই তাদের ধর্ম গ্রন্থে ‘গো হত্যা’ নিষিদ্ধ বলে কোন প্রমাণ নেই। উপরন্তু তাদের ধর্মগ্রন্থ ‘বেদে’ হিন্দু সমাজ গরুর গোশত খেত বলে প্রমাণ রয়েছে। পÐিত অবিনাশ চন্দ্রদাস, এম এ মহাশয় তার গ্রন্থ ‘ঋগবেদ’ (ইন্ডিয়া ২য় সংস্করণ) ৯৮ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘প্রাচীন আর্যদের মধ্যে গরুর গোশত খাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।’ শ্রী চিন্তামণি রাউভেদী বলেছেন, ‘আদি যুগে ঋষি ব্যক্তিরা গরুর গোশত খেতেন।’ বেদের বহুমন্ত্রে লেখা আছে যে, ‘গরুর গোশত খাওয়া উচিত।’ হিন্দু ধর্মশাস্ত্রগুলি পাঠ করলে ‘গো মাংস ভক্ষণ’ করার অনুরূপ উদাহরণ আরও দেওয়া যেতে পারে। হিন্দু শাস্ত্রেই যেখানে ‘গরু জবাই’ নিষিদ্ধ নয়, সেখানে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সমগ্র ভারতে আইন করে নিষিদ্ধ করতে চায় কেন?
ভারতে গরু জবাই বন্ধ করা তথা ‘গো রক্ষা’র অভিযান নতুন নয়। অতীতে মোগল আমলেও স¤্রাট আকবর তার ‘দ্বীনে এলাহী’ প্রবর্তনের অংশ হিসেবে গরু জবাই বন্ধের যে অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলেন, তাতে স¤্রাট আকবরকে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং খেসারতও দিতে হয়েছিল। ভ্রান্ত লোকদের পরামর্শ নিয়ে স¤্রাট আকবর এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সত্যিকারের উলামা সমাজ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন। এ সময় ইমাম রব্বানী মোজাদ্দেদ আল্ফে সানী (রহ.) লেখনীর মাধ্যমে ‘গো রক্ষা’ অভিযানের বিরোধিতা করতে থাকেন। মোজাদ্দেদ সাহেব এ সম্বন্ধে তাঁর এক পত্রে লেখেন, ‘হিন্দুস্থানে গরু জবাই করাকে ইসলামের একটি বড় রীতি-নীতি এবং ভারতীয় মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে একটি বিরাট পার্থক্য সাধনকারী নিদর্শন হিসেবে গণ্য করতে হবে।’ সুতরাং গরু জবাই করা ভারতীয় মুসলমানদের কেবল ধর্মীয় অধিকারই নয় বরং এটা তাদের একটি ‘তামাদ্দুনিক’ অধিকারও বটে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া কেবল ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যেই গরুর গোশত খাওয়া সীমাবদ্ধ নয়, সেখানকার এক বিপুল সংখ্যক হিন্দু গো-মাংস ভক্ষণ করতে অভ্যস্ত। আবার এসব হিন্দুর সংখ্যাও কম না, যারা তাদের গো-মাতার চামড়া কোন না কোন রকমে ব্যবহার করে থাকে।
খেলাফত আন্দোলনের প্রথম দিকে গরু জবাই বন্ধ করার প্রশ্নটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য কতিপয় মুসলিম নেতা দিল্লীতে এক সম্মেলন আহŸান করেন এবং শেখুল হিন্দ হজরত মওলানা মাহমুদুল হাসানকে দাওয়াত দেন। তিনি অসুস্থতার জন্য উক্ত সম্মেলনে যোগদান করতে না পারায় তার প্রতিনিধি হিসেবে মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীকে প্রেরণ করেন এবং তাকে তাগিদ করে বলে দেন যেন তার পক্ষ হতে সম্মেলনে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়, ‘আমরা হিন্দুস্থানের আজাদী চাই এই জন্য যে, সেখানে ইসলাম ও ইসলামের রীতি-নীতি ও আচার অনুষ্ঠান স্বাধীনভাবে পালন করা যাবে, আর যে আজাদী ইসলামের রীতি-নীতি বর্জিত হবে, তার প্রতি আমরা অভিসম্পাত করছি।’ মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী ভারতীয় মুসলমানদের গরু কোরবানী করা সম্পর্কে বলেছেন, ‘যখন কোন সরকার ধর্মের দিক হতে বৈধ কাজ নিষেধ করে, তখন সেই কাজ হতে বিরত থাকাই হবে পাপ।’
ভারতের উগ্রপন্থীরা ‘গো হত্যা’ বন্ধের জন্য মানুষ হত্যাকেও অন্যায় মনে করে বলে মনে হয় না। এই মনোভাবের পিছনেও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অতীতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, ভারতের হিন্দু নেতৃবর্গ বরাবরই মুসলমানদের গরু জবাই করার বিরুদ্ধে চরম ও কড়া মনোভাব পোষণ করেছেন, যার ফলে উগ্রপন্থীরা তার সদ্ব্যবহার করতে কসুর করেনি। মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর তাঁর বিখ্যাত পত্রিকা ‘হামদর্দে’ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধে তিনি বিস্তারিতভাবে এই ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন যে, প্রখ্যাত নেতা শ্রী নওয়াস আইনস্কর কলিকাতা কংগ্রেস কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠান করেন এবং সেখানে ‘গরু জবাই’ সমস্যার একটি অত্যন্ত সুচিন্তিত সমাধান পেশ করেন। তাঁর সমাধান অনুযায়ী, মুসলমানদেরকে ‘গরু জবাই’ করার সাধারণ অনুমতি প্রদান করা হবে। এটা ছিল প্রস্তাবের সার কথা। কিন্তু এই সভায় মহাসভার দুইজন সদস্য হৈ চৈ করতে থাকেন। বোম্বাই এর অধিবেশনে ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদনের পর এই প্রস্তাব বিষয় কমিটিতে পেশ হবে; এমন সময় গান্ধীজী আবির্ভূত হলেন এবং ডক্টর আনসারীকে ডেকে বললেন, ‘আমি উপস্থিত হয়ে ছিলাম তোমাদের কিছু সাহায্য করতে এবং হিন্দু-মুসলিম ঝগড়া বিবাদের চ‚ড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে। কিন্তু ‘গো হত্যা’র অনুমতি সংক্রান্ত প্রস্তাব দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি। প্রস্তাবের এই অংশের প্রতি আমারও সমর্থন নেই এবং অপর কোন হিন্দুও এতে রাজী হতে পারে না। এই প্রস্তাব আমাদের ধর্মীয় কর্তব্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর কারণে সারারাত্রি আমার ঘুম হয়নি। অবস্থা এই যে, আমি তোমাদের সাহায্য করার পরিবর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াব’ (সীরাতে মোহাম্মদ আলী)।
মদনমোহন মালব্যজী ১৯২৯ সালে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে কয়েকটি ভুল কাজ করেছে, সেগুলোর মধ্যে একটি ভুল হচ্ছে এই যে, গো হত্যা চালু রেখেছে।’ মালব্যজী প্রত্যেক ভারতবাসীকে তাগিদ করেন যে, ‘তারা স্বরাজ কায়েম করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন, যেন তারা গো হত্যা বন্ধ করার যোগ্য হতে পারেন’ (ইনকিলাব, ১৮ই জুন, ১৯২৯ খৃ:)। পাঞ্জাব কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ডক্টর সত্যপাল কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে ১৯৩৭ সালের ২০ আগস্ট নি¤েœাক্ত বিবৃতি দান করে বলেন যে, ‘হিন্দুদের জন্য গো অতি সম্মানের। তাই কংগ্রেস কিছুতেই বরদাশত করবে না যে, প্রকাশ্যে গো জবাই রীতি চালু থাকবে, যার ফলে হিন্দুরা ক্ষুণœ হবেই’ (আজ পত্রিকা, ২৯ শে আগস্ট, ১৯৩৮ খৃ:)। কংগ্রেস সভাপতি সুভাস চন্দ্র বোস ১৯২৭ সালে কলিকাতার ঐক্য সম্মেলনে মুসলমানদের জন্য কোরবানী করার অনুমতি দেয়া উচিত, এই প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করেন। (সীরাতে মোহাম্মদ আলী)।
গরু জবাইকে কেন্দ্র করে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা অহরহ হয়ে থাকে। তবে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কোন হাঙ্গামা হয়েছিল বলে ইতিহাস পাঠে জানা যায় না। অথচ ‘গরু কোরবানী’ সে সময়ও হত এবং সকল লোকই গরুর গোশত খেত। ১৮৯৩ খৃস্টাব্দে ‘আজমগড়ে’ গরু কোরবানীকে উপলক্ষ করে বিরাট হাঙ্গামা হয়ে যায়। সম্ভবত এই শ্রেণীর এটি ছিল প্রথম হাঙ্গামা। এই ঘটনার পরপরই প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা মি. তিলক কর্তৃক ‘গো জবাই’ বিরোধী সমিতি গঠন করা হয়। অতঃপর কংগ্রেস নেতৃবর্গ সর্বদা ‘গো রক্ষা’র জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। বিগত শতকের শেষ দিকে মথুরায় একটি ‘গো সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ‘কিষাণগড়’ রাজ্যের উজির আলার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ‘গো হত্যা’ বন্ধের উপায় সম্বন্ধে বহু চিন্তা-ভাবনা করা হয় এবং সেখানে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী একটি প্রতিনিধি দল পÐিত মদন মোহন মালব্যের নেতৃত্বে ভারতের লাট বাহাদুরের সাথে সাক্ষাৎ করে ‘গো হত্যা’ বন্ধের দাবি জানাবে বলে স্থির করা হয়। এই পদ্ধতিতে কামিয়াব না হলে ব্যাপক সত্যাগ্রহের আয়োজন করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে একটি ফান্ডও খোলা হয়। জনৈক উদার হিন্দু তৎক্ষণাৎ ‘পঞ্চাশ হাজার’ টাকা নগদ প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। এসব ঘটনা কি ‘গো জবাই’ বন্ধ করার ব্যাপারে হিন্দু মানসিকতা ও তাদের উগ্রতার পরিচয় বহন করে না? হিন্দুস্থানের বর্তমান পরিস্থিতি উল্লেখিত ঘটনাগুলোর সাথে মিলে যায়। বর্তমান কালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এতদসংক্রান্ত খবরাখবর একত্রিত করা হলে সেখানে মুসলমানদের যে করুণ চিত্র ফুটে উঠবে, সে সম্পর্কে আমরা অধিক কিছু বলতে চাই না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন