Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

যে সময় আমরা স্কুলে পড়াশোনা করেছি সে এমন কিছু প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা নয়। তখনও প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি উঠে যায়নি, শিক্ষার অধিকার আইন হয়নি, স্যার ক্লাসে কান মলে দিলে তাকে যে ‘কর্পোরাল পানিশমেন্ট’ বলা হয় সেটা জানতামও না। কিন্তু দিব্যি মনে পড়ে, আমাদের স্কুলে পাঠিয়ে বাবা-মায়েরা খুব নিশ্চিন্ত থাকতেন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রবল খুনসুটি-মারপিট হতো, হোমওয়ার্ক না-করে গেলে কিংবা ক্লাসে দুষ্টুমি করলে শিক্ষকরা বকুনি যথেষ্টই দিতেন। বাড়াবাড়ি করে ফেললে চপেটাঘাত বা কানমলাও বিলক্ষণ জুটত। কিন্তু বাপ-মায়েদের ভরসা ছিল, ছেলেমেয়েরা স্কুলে মোটের ওপর যথেষ্টই নিরাপদে থাকবে। অথচ শিক্ষার অধিকার আইন বেশ ক’বছর পূর্ণ করে ফেলার পর, এই ২০১৮ সালে এসে, সে ভরসাও বুঝি আর রইল না। গত কয়েক মাসের মধ্যে স্কুলের বিভিন্ন ঘটনা সামনে আসার পর, স্কুল সম্পর্কে ধারণাটাই ভেঙে চুরে যাওয়ার মুখে।
এই যে সকালে স্কুলবাসে উঠিয়ে হাত নেড়ে টাটা করে এলাম আমার ছেলেকে আগামী কয়েক ঘণ্টা সে সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকবে তো? শহরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর স্কুল গেইটের সামনেই কিংবা এই যে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে এলাম স্কুলের দরজার সামনে, বিকেলে আনতে গিয়ে তাকে সুস্থ, স্বাভাবিক দেখতে পাব তো? বিদ্যালয়, যাকে আমরা এত দিন জেনে এসেছি পরিবারের বাইরে শিশুর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে- সেই জানাটাই কি একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে গেল নিমেষে? গত কয়েকদিন ধরে অভিভাবকদের মুখে ক্রোধ যতটা না তার চেয়ে অনেক বেশি সেই আতঙ্কেরই ছায়া দেখছি যেন- যে বিশ্বাস থেকে, ভরসা থেকে তারা তাঁদের সন্তানকে স্কুলে পাঠান সেই জায়গাটাই একেবারে ভেঙে গেছে। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর থেকে স্কুল-কর্তৃপক্ষ যেভাবে লাগাতার তা অস্বীকার করে গিয়েছেন, বিষয়টিকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করছেন ও নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন, তাতে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ থেকে শুরু করে আমাদের জাতীয় শিশুনীতি, এমনকি শিক্ষার অধিকার আইনেও যে বারবার বলা হয়েছে ‘শিশুর স্বার্থই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ সেসব কি নিছকই কথার কথা?
অথচ এমন নয় যে এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এই প্রথম হলো আমাদের। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এবং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে আপনারাও জানেন, শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি, এমনকি বিদ্যালয়ের পরিসরেও আদৌ সুরক্ষিত নয়। সংবাদপত্রের পাতায় ও অন্যান্য গনমাধ্যমে এ-ধরনের অসংখ্য খবর প্রায় প্রতিনিয়তই আমাদের চোখে পড়ে। তথ্যের খাতিরে এ-ও জানানো যাক, এ ধরনের ঘটনা যে ঘটে শুধু শহরাঞ্চলে বা কেবলমাত্র ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলেই, তেমনটাও নয়। সরকারি বা আধা-সরকারি বিদ্যালয়, কী শহরে, কী প্রত্যন্ত গ্রামে- সর্বত্রই শিশু সুরক্ষার প্রশ্নটি উপেক্ষিত থাকে, কাগজে-কলমে নিয়মকানুন থাকলেও সেসব যথাযথ মেনে চলা প্রায়শই হয় না। সে কারণেই আমাদের শুনতে হয় মিড-ডে মিলের ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়ে শিশু মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা, ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা গণমাধ্যমে হয়তো প্রচার পায় বেশি, কিন্তু তার বাইরেও যে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটে চলে এমন অসংখ্য ঘটনা, তা তো আমরা জানি। নিশ্চয়ই মনে থাকবে সম্প্রতি দক্ষিণ বঙ্গের এক বেসরকারি স্কুলে ইউনিফর্ম না-পরে আসার শাস্তিস্বরূপ ক্লাস ফাইভের এক ছাত্রীকে ছেলেদের টয়লেটের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখার ঘটনা। কিংবা অন্য একটি ঘটনা, যেখানে চার বছরের এক শিশুকে স্কুল ছুটির পর বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল কয়েক মাসের মাইনে বাকি পড়ার কারণে।
শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের তালিকা অন্তহীন লম্বা করা চলতে পারে, কিন্তু তা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। এগুলো ¯্রফে দৃষ্টান্ত, যা ক্রমাগত দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ করে চলে, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি, তাদের মর্যাদারক্ষা ও নিরাপত্তাবিধানের প্রতি স্কুল কর্তৃপক্ষের মানসিকতা এখনও রয়ে গিয়েছে কোন স্তরে। এই মানসিকতার প্রতিফলন মিলে শিশুদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান অপরাধ তালিকা থেকেও। শিশুদের স্বার্থেই সার্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলছে, গত এক দশকে সারা দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৫০০ শতাংশ। এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হলো, শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহ, ধর্ষণ, অপহরণ প্রভৃতি আইনের আওতাধীন অপরাধের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ও অপরাধীরা ছিল শিশুদের পূর্ব পরিচিত। যার সহজ অর্থ, যাঁদের হাতে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব, তাঁদের একটা বড় অংশই শিশু সুরক্ষার প্রতি সম্পূর্ণ অসচেতন, অনির্ভরযোগ্য, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো বা অপরাধমনস্কও।
অথচ এমন নয় যে, এ-বিষয়ে আইনকানুন আদৌ কিছু নেই। স্কুলে শিশুদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে জাতীয় শিশু অধিকার কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশনামা রয়েছে। বিদ্যালয়ে ছাত্র-নিরাপত্তার বিষয়টি আঁটোসাঁটো করার জন্য কর্তৃপক্ষকে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট তালিকাও রয়েছে দেশে। কিন্তু নির্দেশিকা থাকা, আর তা পালন করা কি এক? দেশের বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের মাত্র ১০ শতাংশে রয়েছে, নিজস্ব শিশু সুরক্ষা বিধি। এ থেকেই বোঝা যায়, কী বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী রোজ স্কুলে যাচ্ছে কার্যত নিরাপত্তার আশ্বাস ছাড়াই।
প্রশ্ন হলো, কীভাবে, কোন পথে বিদ্যালয় পরিসরে শিশুর সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা যায়। একটু আগেই যে কথা বলছিলাম, কাগজে-কলমে নির্দেশিকার অভাব না-থাকলেও ভয়ঙ্কর ঘাটতি রয়েছে সেই নির্দেশিকা মেনে চলার সদিচ্ছায় এবং যথাযথ নজরদারির। এ ক্ষেত্রে প্রথম দায়িত্ব যে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। কিন্তু বিদ্যালয়গুলো শিশু সুরক্ষা নির্দেশিকা মেনে চলছে কিনা, তার জন্যও তো চাই নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির প্রক্রিয়া এবং এ বিষয়ের মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে সংশিষ্ট শিক্ষা দফতরকেই। তাছাড়াও শিক্ষার অধিকার আইনে যে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি গড়ে তোলার কথা আছে, সেখানে অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্বের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক জেলাতেই এখনও স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া আশানুরূপ পর্যায়ে নয়।
বিদ্যালয় পরিসরে এবং তার বাইরেও শিশুদের ১০০ শতাংশ সুরক্ষা নিশ্চিত করাকে যদি একটি অবশ্যকর্তব্য আইনের ভাষায়, নন-নেগোশিয়েবল’ হিসাবে দেখতে চাই, তা হলে এ ছাড়া গতি নেই। আর হ্যাঁ এর জন্য অবশ্যই রাখতে হবে যথাযথ অর্থ বরাদ্দও। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি যেখানে শিশু, সেখানে মোট বাজেটের মাত্র ক’ শতাংশ শিশু সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়, আমরা কি এ বিষয়ে যথেষ্ট সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছি?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

Show all comments
  • ফাহিম রানা ২ জুলাই, ২০২০, ৫:০২ পিএম says : 0
    না
    Total Reply(0) Reply
  • ফাহিম রানা ২ জুলাই, ২০২০, ৫:০৩ পিএম says : 0
    হা
    Total Reply(0) Reply
  • ফাহিম রানা ২ জুলাই, ২০২০, ৫:০৬ পিএম says : 0
    খুব ভালো কাজ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরাপত্তা


আরও
আরও পড়ুন