Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাকস্বাধীনতায় আঘাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : এইচআরডাব্লিউ

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০১ এএম

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, “নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বড় আঘাত। এটি সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করবে।” মঙ্গলবার দেয়া এক প্রতিবেদনে সংগঠনটি এ মন্তব্য করে বলেছে, “বহু সমালোচিত ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট (আইসিটি) পরিবর্তে এই আইন করা হলেও এতে আগের বেশিরভাগ ক্রুটিযুক্ত ধারাগুলো রাখা হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এমন আরো ধারা যুক্ত করা হয়েছে।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, “দেশের সাংবাদিকদের তীব্র বিরোধিতা সত্তে¡ও গত সপ্তাহে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ পাস করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য বড় আঘাত। এই আইন অপব্যবহার করার জন্য উপযুক্ত একটি অস্ত্র এবং মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আন্তজার্তিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের যে বাধ্যবাধকতা আছে তার পরিষ্কার লঙ্ঘন। এতে কমপক্ষে ৫টি বিধান আছে, কী ধরনের মতপ্রকাশ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে তা পরিস্কার করে বলা হয় নি। সমালোচকদের কণ্ঠ দমন করাটাকে বৈধতা দেয়ার জন্যই এই আইন।” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আইনের বেশ কিছু ধারায় মুক্ত মত প্রকাশের আন্তর্জাতিক মানদন্ড লঙ্ঘন করা হয়েছে। আইনের ২১ নম্বর সেকশনে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুদ্ধের চেতনা কিংবা জাতির জনকের বিরুদ্ধে কোনো প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা’ ছড়ালে ১৪ বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রাখা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর)-এর সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এর পর্যবেক্ষক জাতিসংঘের শাখা ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কমিটি বলেছে, ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করলে শাস্তি দেয়ার বিধান কোন ভাবেই মনোভাব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সম্মান দেয়ার প্রতি দায়ত্বশীল একটি রাষ্ট্রের জন্য কোনভাবেই সঙ্গত নয়।
২৫(ক) সেকশনে ‘আগ্রাসী ও ভীতিকর’ (অ্যাগ্রেসিভ অর ফ্রাইটেনিং) তথ্য প্রকাশ করার অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রাখা হয়েছে। এই শব্দ দুটি সম্পর্কে আইনে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয় নি। মত প্রকাশকে সীমাবদ্ধতার যে আইন, সেখানে এটা পরিষ্কার করে বলা উচিত- কোন জাতীয় মত আইন লঙ্ঘন করবে। আইনের এই ওই অস্পষ্ট টার্মের ব্যবহার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি লঙ্ঘন করেছে। এই অস্পষ্টতার সঙ্গে কড়া বড় ধরনের শাস্তির বিধান একসঙ্গে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ বৃদ্ধি করবে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে অথবা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে অথবা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে অথবা বিঘ্ন সৃষ্টি করে অথবা আইন শৃংখলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটায় এমন তথ্য পোস্ট করার কারণে ১০ বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রয়েছে ৩১ নম্বর সেকশনে। তবে সুস্পষ্টভাবে এতে বলা নেই যে, কোন জাতীয় বক্তব্য বা মত আইন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে এই ধারা ব্যবহার করে সরকার যে মত বা বক্তব্যকে পছন্দ করবে না, তাদের বিরুদ্ধে বিচারের সুযোগ পাবে। উপরন্ত সরকারের যেকোনো সমালোচনা অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে এবং জনগণের প্রতিবাদের সম্ভাব্যতা থাকে। আইন শৃংখলার ব্যাঘাত ঘটায় শুধু এমন যুক্তির ভিত্তিতে কোনো সমালোচনাকারীকে শাস্তি দেয়া সরকারের উচিত হবে না।
যেসব বক্তব্য বা বিবৃতি বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ, ঘৃণা অথবা ক্ষোভ সৃষ্টি করে তা রাখা হয়েছে ৩১ নম্বর সেকশনে। যখন আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা প্রতিরোধ করা গুরুত্বপূর্ণ, তখন তা করতে হয় সে উপায়ে যেখানে মত প্রকাশকে যতটা সম্ভব কম বিধিনিষেধের মধ্যে ফেলা হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে সভা সমাবেশের মতো মানবাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে জনগণের মধ্যে বিতর্ককে বিধিনিষেধ দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে না। তাই এই আইনে ‘হেট স্পিস’ বা ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্যের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে খেয়ালখুশিমতো এবং আইনকে নিষ্পেষণমুলকভাবে প্রয়োগের পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। আর তাতে জাতি এবং ধর্মীয় ইস্যুতে আলোচনায় এক অগ্রহণযোগ্য শীতলতা সৃষ্টি করেছে।
আইসিটি আইনের নিষ্পেষণমুলক ধারা ৫৭-এর মতোই এই আইনের ২৯ নম্বর সেকশন। এখানে অনলাইনে মানহানিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আইসিটি ধারার মতো নয়, ২৯ নম্বর সেকশনে ওই সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে মানহানির অভিযোগ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে যারা দন্ডবিধির ক্রিমিনাল মানহানির পর্যায়ে পড়েন। মানহানিকে একটি সিভিল বিষয় হিসেবে দেখা উচিত। একে জেল দিয়ে শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা উচিত নয়।
ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন বক্তব্যের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ২৮ নম্বর সেকশনে। এখানেই আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ, যে মত অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এবং এজন্য ফৌজদারি শাস্তির বিধান রাখা যুক্তিযুক্ত নয়।
নতুন আইনে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এর বলে তারা অনলাইনের তথ্য প্রচারকে বন্ধ করতে পারবে অথবা তা প্রত্যাহার করার ক্ষমতা রাখে। তারা ওয়ারেন্টবিহিন তল্লাশি করতে পারবে এবং জিনিসপত্র জব্দ করতে পারবে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এ আইনের ৩২ নম্বর সেকশনের বিরোধিতা করে আসছেন। এ আইনে সরকার ব্যবহৃত কোনো কম্পিউটার অথবা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের গোপনীয় তথ্য (ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন) সংগ্রহ করা, হাতবদল করা বা সংরক্ষণ করার জন্য ১৪ বছর পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটা করা হলে অন্যায়ভাবে এটি ব্যবহারের আশংকা থাকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ