Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

তরল মাটিতে ডুবে যেতে পারে ঢাকার বাড়িঘর

ভূমিকম্পের পর লিকুইফেকশন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ ভূমির গঠনপ্রকৃতি এমন যে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে লিকুইফিকেশনের শিকার হয়ে তরল মাটির নিচে ডুবে যেতে পারে’। এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ড. আফতাব আলম খান। এই লিকুইফিকেশনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ধরুন আপনার পায়ের নীচের যে শক্ত মাটি তার প্রকৃতি হঠাৎ বদলে গেল। এটি তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করলো। যে মাটির ওপর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন সেটিতে ঢেউ খেলতে শুরু করলো। মাটির ওপরের সব বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল, সেতু ভেসে যেতে শুরু করলো। তারপর ধসে গিয়ে ডুবে গেল জল-কাদা-বালির এক সমূদ্রে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এরকম ঘটনা সত্যিই ঘটেছে।
গত সপ্তাহেই ভূমিকম্পের পর ইন্দোনেশিয়ার পালুতে দেখা গেছে এই দৃশ্য। তার আগে অতি স¤প্রতি নিউজিল্যান্ডে, চিলিতে। আরও আগে জাপান এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এমনটি ঘটার আশঙ্কা কতটা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ড. আফতাব আলম খান বলছেন ‘ঢাকার অবস্থা খুবই নাজুক। পুরো ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ ভূমির গঠনপ্রকৃতি এমন যে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে এরকম ঘটনা ঢাকাতেও ঘটতে পারে’।
বিজ্ঞানীরা এ ধরনের ঘটনাকে বলেন ‘লিকুইফেকশন’। সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে, ‘মাটির তরলীকরণ’। অর্থাৎ মাটি যখন তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করে। ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ ভূমিকম্পে লিকুইফেকশনের কারণে বালারোয়ার পালু এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৭শ’ বাড়িঘর কার্যত মাটিতে দেবে গিয়েছিল। স্যাটেলাইট থেকে নেয়া ছবিতে দেখা গেছে, পালুর বিমানবন্দরের দক্ষিণে একটি বিরাট এলাকায় ঘরবাড়ীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই, সব কিছুই যেন মাটিতে মিশে গেছে।
ইন্দোনেশিয়ার গণপূর্তমন্ত্রী বাসুকি হাদিমুলজোনো জানিয়েছেন, সেখানে ধ্বংস এবং মৃত্যুর প্রধান কারণ লিকুইফেকশন। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র সুতপা পারো নাগরোহো জানান, ‘যখন ভূমিকম্প আঘাত হানলো, মাটি যেন ঝুরঝুরে হয়ে গেল, কাদায় পরিণত হলো। এই বিপুল কাদায় পিটোবোর হাউজিং কমপ্লেক্স যেন ডুবে গেল। আমরা অনুমান করি সেখানে কাদায় দেবে আছে ৭৪৪টি বাড়িঘর।’
আর মুজাইর নামে একজন বার্তা সংস্থা এএফপিকে এই ভূমিকম্পের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, ‘আমার বাড়ি যেন কার্যত রাস্তার কয়েক মিটার দূরে সরে গেল। আমার প্রতিবেশিদের বাড়িগুলো একটির ওপর একটি গিয়ে পড়লো’।
এর আগে ২০১০-২০১১ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবারি অঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়, তখনও ঘটেছিল এরকম ঘটনা। সেখানে পলিমাটি আর বালি পানির সঙ্গে মিশে ঢেউয়ের মতো উপরে উঠে এসেছিল। আর তার নীচে চাপা পড়েছিল রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গাড়ি, বাগান, ক্ষেতখামার- সবকিছু।
২০১০ সালে চিলিতে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার এক ভূমিকম্প হয়, যাতে দেশটির মধ্য-দক্ষিণাঞ্চলে নিহত হয় ৮শ’ মানুষ। সেখানে মাটির তরলীকরণ বা লিকুইফেকশনের কারণে ধসে পড়ে ব্রিজ, বন্দর, বাঁধ থেকে অনেক কিছু। প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার জুড়ে চলেছিল এই ধ্বংসকান্ড।
এরকম ঘটনা জাপানে ঘটেছে অনেকবার। ১৯৬৪ সালে নিগাতায় এবং ১৯৯৫ সালে কোবে নগরীতে। কোবে নগরীর বন্দর তৈরি করা হয়েছিল একটি কৃত্রিম দ্বীপের ওপর। তুলনামূলকভাবে আলগা বালি এবং পলির ওপর তৈরি এই বন্দরটি ভূমিকম্পে ধসে পড়ে।
‘বাংলাদেশের যে ভূ-কাঠামো, তাতে এরকম ঘটনা ঘটার ঝুঁকি অনেক। এটা একটা মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশ খুবই নাজুক অবস্থানে’, -বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ড. আফতাব আলম খান।
‘ভূমিকম্প হলেই যে লিকুইফেকশন হবে, ব্যাপারটা তা নয়। কয়েকটি ব্যাপার একসঙ্গে ঘটতে হবে। এটি নির্ভর করবে ভূমিকম্পটি কতটা শক্তিশালী, মাটির কতটা গভীরে এটি ঘটছে এবং সেখানে যে একুইফার বা পানির স্তর আছে, সেটিতে কতটা পানি আছে তার ওপর’।
তার মতে, যদি ভূমিকম্প ছয় মাত্রার কাছাকাছি বা তার চেয়ে শক্তিশালী হয় এবং এর উৎপত্তিস্থল যদি দশ হতে পনের কিলোমিটার গভীরতার মধ্যে হয়, তাহলে লিকুইফেকশনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। লিকুইফেকশন তখনই ঘটে, যখন পলিমাটি বা বালু মাটির নীচে কম গভীরতায় থাকে একুইফার বা পানির স্তর।
ড. আফতাব আলম খান বলেন, যখন ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি জায়গায় কোন ফল্ট লাইন বা ফাটল বা চ্যূতি পরস্পরের সাপেক্ষে নড়াচড়া করে তখন সেটাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘ফল্ট রাপচার’ বল হয়। এই ফল্ট রাপচার নতুন করে হতে পারে, বা আগের রাপচার নতুন করে সক্রিয় হতে পারে। তবে রাপচার যে কারণেই হোক, ফাটল দুটিকে পরস্পরের সাপেক্ষে নড়তে হবে, নইলে লিকুইফেকশন হবে না।
যখন ফল্ট লাইন বা ফাটল রেখাটি নড়াচড়া করে, তখন যে সিসমিক ওয়েভ বা ভূকম্পন তরঙ্গ তৈরি হয় এবং এই তরঙ্গ যখন লিকুইফেকশন জোনে এসে পৌঁছায়, তখন সেখানকার মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ করে।
‘ভূ-কম্পন তরঙ্গ যখন ভূপৃষ্ঠের দুশ’ মিটারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন সেখানে যেসব একুইফার বা পানির স্তর থাকে, সেগুলি যদি পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, তখন উপরের মাটি ধসে যাবে এবং সেই মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ করবে, এটিতে ঢেউ খেলতে দেখা যাবে এবং উপরে যা কিছু আছে, সব ধসে পড়বে বা ভেসে যাবে। বালি এবং পানি মিলে একটি জেলি টাইপের জিনিস তৈরি হয়ে, যেটি উপরে উঠে আসে। আর নীচে একুইফার জোনে একটি ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা তৈরি হয়। তখন সেই শূন্যস্থানে উপরের মাটি ধসে পড়ে। তখন উপরে যত ধরনের স্ট্রাকচার থাকে, সেটা মাটিতে তলিয়ে যায়, মাটিতে ডুবে যায়’।
ড. আফতাব আলম খানের মতে, বাংলাদেশে যদি বর্ষাকালে বড় ভূমিকম্প হয়, তখন লিকুইফেকশনের ঝুঁকি বেশি। কারণ তখন বৃষ্টির পানিতে ভূগর্ভের পানির স্তর থাকে পরিপূর্ণ। সেই তুলনায় শীতকালের ভূমিকম্পে লিকুইফেকশনের ঝুঁকিটা অনেক কম। তার মতে, পুরো বাংলাদেশের বেশিরভাগটাই যেহেতু গড়ে উঠেছে নদী বিধৌত পলিমাটিতে, তাই এরকম লিকুইফেকশনের ঝুঁকি কম বেশি অনেক জায়গাতেই আছে। কেবলমাত্র উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া রাজশাহীর মতো কিছু জেলায় অগভীর মাটিতে শক্ত শিলা বা ‘সলিড ক্রাস্ট’ আছে। যেখানে এর ঝুঁকি নেই। তার মতে, ঢাকা শহরের অন্তত ষাট ভাগ এলাকা এরকম লিকুইফেকশন অঞ্চলে পড়েছে, যেখানে এরকম বিপদ ঘটার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। তিনি এই ঝুঁকির ভিত্তিতে ঢাকাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-পুরনো ঢাকা-মতিঝিল থেকে শ্যামলী পর্যন্ত এলাকা। এরকম ঝুঁকির সমর্থনে তিনি বাংলাদেশ অঞ্চলে অতীতে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে সেগুলোর উদাহারণ দিলেন।
‘ঐ সব ভূমিকম্পে যত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার বেশিরভাগটাই এই লিকুইফেকশনের জন্য। অন্তত আমাদের কাছে যা রেকর্ড আছে, তাতে আমরা সেটাই দেখতে পাই’।
‘১৮৮৫, ১৮৯৭, ১৯১৮ এবং ১৯৩০ সালে যেসব বড় ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে যত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়, তার সবই কিন্তু লিকুইফেকশন সম্পর্কিত’। অতি স¤প্রতি ঘটা আরেকটি ভূমিকম্পের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। ‘২০০৩ সালে রাঙ্গামাটিতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটার মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ১। কিন্তু সেটির উৎপত্তিস্থল ছিল দশ কিলোমিটার বা এগারো কিলোমিটার গভীরে। সে কারণে প্রচন্ড লিকুইফেকশন হয়েছিল এবং কর্ণফুলী নদীর একটি পাড়ের দীর্ঘ একটি অংশ ধসে পড়েছিল। প্রায় দুই তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদীতীর ধসে পড়েছিল’।
ঢাকা শহরে এখন যে নতুন বড় বড় ভবন তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোতে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা থাকছে বলে যেকথা বলা হচ্ছে, লিকুইফেকশন হলে সেটি কতটা কাজ করবে?
ড. আফতাব আলম খান বলছেন, ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাপার ক্ষেত্রে লিকুইফেকশনের ব্যাপারটি দশ বছর আগেও বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে তখন বাংলাদেশের যে সাইসমিক জোনিং করা হয়েছে, সেখানে ঢাকাকে একটা মধ্যম ঝুঁকির সাইসমিক জোনের মধ্যে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পরে যখন মাইক্রোজোনিং করে এই লিকুইফেকশনের ব্যাপারটি বেরিয়ে আসলো, তখন এসব জোনে যেসব দালানকোঠা আগে থেকে গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিটা কতটা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিনি আরও বলছেন, বাংলাদেশের বিল্ডিং কোডে এই লিকুইফেকশনের বিষয়টি কতটা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। সূত্র : বিবিসি।

 



 

Show all comments
  • লাইজু ৫ অক্টোবর, ২০১৮, ২:৫১ এএম says : 0
    বিষয়টি খুবই উদ্বেগের
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ