Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সুনামগঞ্জে তিনশ’ কোটি টাকার বোরো ফসল নষ্ট

বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকের স্বপ্ন চুরমার

প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আজিজুল ইসলাম চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে : সুনামগঞ্জে পানিতে তলিয়ে ও শিলাবৃষ্টিতে তিন শত কোটি টাকার বোরো ফসল হানি হয়েছে। এখনো ফসল ডুবছে। কাঁচা আধা-পাকা ধান পানির নিচে তলাচ্ছে। কৃষকরা অসহায়, তাদের চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে ফসল। হাওর রক্ষা বাঁধ কৃষকদের কোনো কাজেই লাগেনি দুবল বাঁধ নির্মাণের কারণে কৃষকদের সকল স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কৃষকদের খোরাকী নিয়ে হাওর রক্ষা বাঁধ কর্তৃপক্ষ (পানি উন্নয়ন বোর্ড), ঠিকাদার ও পিআইসিরা রীতিমতো ছিনিমিনি খেলেছেন এমন অভিযোগ এ জেলার কৃষকসহ জন প্রতিনিধিদের। সরকারি হিসেবে ইতোমধ্যে শিলাবৃষ্টি ও পানির নিচে তলিয়ে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। তবে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন এ ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি।
জেলার ১১টি উপজেলার অনেক হাওরের ফসল এখন পানির নিচে। কিছু কাঁচা ও আধা-পাকা ধান কাটলেও দ্রুত পানি বাড়ায় শ্রমিক সংকটের কারণে অনেক কৃষক ধান কাটতে পারেননি। তা ছাড়া পানির নিচে কাঁচা ধান শ্রমিকরা কাটতে চায় না। যারা অল্প কেটেছেন তারা ৭ থেকে ৮ শত টাকা রোজ দিয়ে ধান কাটিয়েছেন। তাও কাঁচা ও আধা-পাকা ধান। এ বারের অনেক হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসল ডুুবছে। সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ ঠিকাদার ও পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) বিরুদ্ধে বাঁধ নিয়ে প্রতিবছরই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, এবারও উঠেছে।
তবে এ বারের অভিযোগ অন্যান্য বছরের তুলনায় ছিল বেশি। সময়মতো বাঁধ নির্মাণ না করাসহ বাঁধের কাজে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কৃষকদের এ অভিযোগ শুরুতে সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড কতৃপক্ষ আমলে নেয়নি। কৃষকদের অভিযোগ দুর্বল বাঁধের কারণে বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও পিআইসিদের ধারে কাছেও পাওয়া যায়নি। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, কৃষক ও জন প্রতিনিধিরা বাঁধে পানির সাথে যুদ্ধ করেছেন। কোনো কোনো হাওরের শেষ রক্ষা হয়নি। তা ছাড়া সময়মতো বাঁধে কাজ না করে পানি আসার আগে কাজ করায় বাঁধগুলো ধসে ধসে ভেঙে যায়। বৈশাখ মাস শুরু হতে না হতেই অতি বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল আসায় সব ক’টি নদী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠায় দুর্বল হাওর রক্ষা বাঁধ পানির ধাক্কা সামলাতে পারেনি। অধিকাংশ হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যায়। সুনামগঞ্জ ভাটি এলাকা। এ জেলায় হাওর ও জলাশয়ের সংখ্যা বেশি। অনুরূপ কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্র। এ সকল এলাকা বোরো প্রধান এলাকা। এক ফসলি বোরোর উপরই এ সকল এলাকার মানুষ বেশি নিভরশীল। সুনামগঞ্জের হাওরে সোনা ফলে। এ বোরো ফসলই এ এলাকার কৃষকসহ গৃহস্থদের একমাত্র সম্বল। বিষেশ করে এ অঞ্চলের কৃষকদের সচ্ছলতা ও দুর্বলতা নির্ভর করে এ ফসলের উপর। এ ফসল ঘরে তুলতে পারলে কৃষকরা ধার-দেনা শোধ করার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয়সহ সকল ব্যয় সংকুলান করেন এ ফসল বিক্রি করে। এবার ফসল খোয়া যাওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত। তাদের দুঃশ্চিন্তার যেন শেষ নেই। তাদের চোখের সামনে অন্ধকার। অন্যদিকে, ব্যাংক লোনসহ মহাজনের ধার শোধ করা দায় হয়ে পড়েছে তাদের। তাদের আগামী সকল স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বলতে গেলে তাদের উপর এখন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার তাহিরপুর, ধরমপাশা, জামালগঞ্জ, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার কৃষকরা। কমবেশি সকল হাওরেই ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বেশি ক্ষতির তালিকায় রয়েছে সুনামগঞ্জ সদরের দেখার হাওর, করচার হাওর। তাহিরপুর-জামালগঞ্জের শনির হাওর, গলগলিয়া, গনিয়াকুড়ি, ললিতপুর, নোয়াহাল, সন্ন্যাসীর ডোবা, উলান। ধরমপাশার ধারাম, চন্দ্রসোনার থাল, ডুবাইল, পাথারিয়া-সাথারিয়া, কলমা। জামালগঞ্জের পাকনার হাওর হালির হাওর। অবশ্য এ দুটি হাওরে শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে বেশি। দিরাইয়ের বরাম, চাপতির হাওর ও উদগল, কালিকোটা, কেজাউড়া। জগন্নাথপুরের নুলয়ার হাওর। শাল্লার ছায়ার হাওর। ছাতক-দোয়ারার দেখার হাওরের একাংশ। পানি উন্নয়ন বোর্ড এবার জেলার ৪০টি হাওর রক্ষা বাঁধে কাজ করে। বরাদ্দ হয় ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। কৃষি বিভাগের সূত্রমতে এবার জেলায় বোরো আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৮০৫ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন। এ বিভাগের সূত্রমতে ১১টি উপজেলায় এ রিপোট লেখা পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে গেছে ১৯ হাজার ২ শত ৮২ হেক্টর জমির ফসল এবং শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ১ শত ৩২ হেক্টর জমির ফসল। যার ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ শত ৮৬ কোটি টাকা। তবে কর্মকর্তারা বলেছেন এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে। প্রতিদিন ফসল নষ্ট হচ্ছে তাই ক্ষতির তালিকায় ক্ষতির পরিমাণ যোগ হচ্ছে। কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন সরকারি হিসেব থেকে আরো অনেক বেশি ফসল এবার খোয়া গেছে। সুনামগঞ্জের বিপুল পরিমাণ বোরো ফসল হানির জন্য সিলেটে ও ঢাকায় মানববন্ধন হয়েছে। পৃথক এ মানববন্ধনে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণাসহ যাদের অবহেলার জন্য ফসল হানি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কৃর্তপক্ষের নিকট দাবি জানানো হয়েছে। জেলার ধরমপাশা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আলী আমজাদ বলেন শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসার, ঠিকাদার ও প্রকল্প চেয়ারম্যানদের দোষারুপ করলে হবে না, এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও জন প্রতিনিধিরা দায় এড়াতে পারেন না। সবার উচিত ছিল হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণকালে নজরদারী করা। কিন্তু জোরালোভাবে তা কেউ করেননি। যার কারণে হাওর রক্ষা বাঁধ হাওর রক্ষা করতে পারেনি। ধরমপাশা-তাহিরপুর-জামালগঞ্জ এলাকার সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ইনকিলাবকে বলেন যাদের গাফিলতির কারণে হাওরের বাঁধ ভেঙে ফলল ক্ষতি হয়েছে তাদের বিরুদ্দে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাহেদুল হক ইনকিলাবকে বলেন এবার খুব ভালো বোরো ফসল হয়েছিল। কিন্তু মাঠপর্যায়ে গেলে কৃষকদের আকুতি দেখলে মনে কষ্ট লাগে। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বেশি ফসল নষ্ট হয়েছে পানিবদ্ধতা ও বাঁধ ভেঙে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুনামগঞ্জে তিনশ’ কোটি টাকার বোরো ফসল নষ্ট
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ