Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাবি শিক্ষক হত্যা বিচার দাবিতে উত্তাল ক্যাম্পাস

প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রাবি রিপোর্টার : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে (৬১) হত্যার প্রতিবাদে চতুর্থ দিনের মতো ক্যাম্পাসের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে। বেলা ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে হত্যাকা-ের চার দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত হত্যাকা-ের কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি পুলিশ। কী কারণে কে বা কারা তাকে খুন করল তার কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছে না পুলিশ। অন্ধকারের মধ্যে তদন্ত করে যাচ্ছে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরো দুইজনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের পরিবার আটকের দাবি করলেও পুলিশ তা অস্বীকার করছে।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যার বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। একই দাবিতে বিশ্¦বিদ্যালয় শাখা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি মানববন্ধন করে। এর আগে ইংরেজি বিভাগ, প্রগতিশীল ছাত্র জোট, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী র‌্যালি বের করে।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকা-ের বিচারের দাবিতে প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ইংরেজি বিভাগ, প্রগতিশীল ছাত্র জোট, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে পুরো ক্যাম্পাস ফুঁসে উঠেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হাতে প্লাকার্ড ও বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। ‘আমার শিক্ষক হত্যা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘শিক্ষা, সন্ত্রাসÑএকসাথে চলে না’, ‘শিক্ষক হত্যার বিচার চাই’ ইত্যাদি প্রতিবাদী স্লোগানে র‌্যালি করে। র‌্যালি শেষে শিক্ষার্থীরা সাড়ে ১১টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত প্রধান ফটক অবরোধ করে। দীর্ঘ সময় অবরোধের কারণে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে তীব্র যানজটের কারণে জনসাধারণের মধ্যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। এই অবরোধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১২টার বাস ছেড়ে যায়নি।
চার দিনেও ক্লু মেলেনি
প্রফেসর ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যার ঘটনার চার দিন পার হলেও খুনের মোটিভ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। কী কারণে কে বা কারা তাকে খুন করল তার কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছে না পুলিশ।
হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রেজাউস সাদিক বলেন, এ মামলায় সোমবার কাউকে আটক করা হয়নি। হত্যার মোটিভও পরিষ্কার হতে পারা যায়নি। তবে আমাদের কাছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এসেছে, আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছি। আশা করছি দ্রুত জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে র‌্যাব-৫ রাজশাহীর সহকারী পরিচালক এএসপি শ্যামল চৌধুরী বলেন, চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ঘটনায় র‌্যাব বিভিন্নভাবে কাজ করে থাকে। রেজাউল হত্যার বিষয়ে আমরা তৎপর আছি। তবে এখন পর্যন্ত খুনের মোটিভ উদ্ধার না হওয়া খুনিদেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। খুনে মোটিভ উদ্ধার করা গেলে খুনীদের চিহ্নিত করা সহজ হবে বলে জানান তিনি।
মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন বলেন, ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী ধর্ম নিয়ে ক্লাসে কোনো কিনা, তার মন্তব্য শিক্ষার্থীরা বাইরে প্রচার করেছিলেন কিনা, তার কারণে মৌলবাদীরা রেজাউলের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কিনা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
আরো দুইজন আটক
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার ভোরে বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুইজনকে আটক করা হয়েছে। এরা হলেন বাগমারায় তার নিজ গ্রামের দরগামাড়িয়া জামে মসজিদের ইমাম রায়হান আলী (৩২) ও গোপালপুর মাদ্রাসার শিক্ষক মুনসুর রহমান (৪৮)। রায়হানের বাড়ি বাগমারার তালঘরিয়া ও মুনসুরের বাড়ি একই উপজেলার খাজাপাড়া গ্রামে। এ নিয়ে এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হলো। এর আগে ইসলামী ছাত্র শিবিরের নগরীর এক ওয়ার্ড নেতাকে আটক করা হয়। পুলিশ কমিশনার শামসুদ্দিন বলেন, রেজাউল কমির সিদ্দিকী তার নিজ গ্রাম দরগামাড়িয়ায় একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু তার গ্রামের মসজিদের ইমাম রায়হান আলী গান বাজনা পছন্দ করতেন না। তাই তিনি ওই গানের স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন।
‘এ কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রায়হানকে আটক করে নিয়ে আসা হয়েছে। আর সন্দেহভাজন হিসেবে শিক্ষকের পাশের গ্রাম খাজাপাড়ার বাসিন্দা মাদ্রাসা শিক্ষক মুনসুরকে আটক করা হয়েছে।’
আজ চার ঘণ্টাব্যাপী মহাসড়ক অবরোধের ঘোষণা
হত্যাকারীদের বিচারের দাবি রাস্তা অবরোধ শেষে দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আবারো মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন কর্মসূচি অনুযায়ী আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা ঘোষণা দেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশের পাদদশে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ থেকে এ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
অধিকাংশ বিভাগে ক্লাস পরীক্ষা হয়নি
হত্যার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে তিন দিনের ক্লাস বর্জন কর্মসূচি শেষে মঙ্গলবার থেকে ক্লাসে ফিরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ক্লাস হলেও ১১টার পর বেশির ভাগ বিভাগের শিক্ষার্থীরাই ক্লাসে অংশগ্রহণ করেননি। ফলে এদিন বেলা ১১টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বিভাগে ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়নি।
ছাত্রলীগের নীরব ভূমিকা!
শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে আন্দোলনে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে তেমন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। প্রগতিশীল একজন শিক্ষকের নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনায় জোরালো কোনো কর্মসূচি না থাকায় ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রগতিশীলমনা একজন শিক্ষকের এমন হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে অবশ্যই প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে জোরালো ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল। কিন্তু তাদের নীরব দর্শক হয়ে থাকার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।
এ জঘন্য হত্যাকা-টি দেশ-বিদেশে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে নিন্দা প্রতিবাদ আসছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের নানা জায়গায় এর প্রতিবাদ হচ্ছে। বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু শিক্ষক হত্যার পাঁচ ঘণ্টা পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করলেও পরবর্তীতে আন্দোলনে মাঠে দেখা যায়নি। যদিও দিনের বেলায় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উপস্থিত থাকার পরও তাদের ‘নীরব দর্শক’ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমানে ক্যাম্পাসে বাম ঘরানার বাইরে প্রকাশ্যে একমাত্র ছাত্রলীগ রাজনীতি করে। অথচ শিক্ষক হত্যার ঘটনায় তাদের নীরব দর্শক ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিটিতে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করেছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাহস হারিয়ে ফেলবেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম রাঞ্জু বলেন, ‘ঘটনার দিন আমরা বিক্ষোভ করেছি। পরে শিক্ষক সমিতি দুই দিনের কর্মসূচি দেওয়ায় আমরা আলাদা কোনো কর্মসূচি দেইনি। মঙ্গলবারের আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে অনেক নেতা-কর্মী অংশ নিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে দু-তিনের মধ্যে দৃশ্যত অগ্রগতি না হলে সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, গত শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নগরীর শালবাগান এলাকায় নিজ বাসার সামনে থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। এ ঘটনায় ওইদিনই একটি মামলা দায়ের করা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাবি শিক্ষক হত্যা বিচার দাবিতে উত্তাল ক্যাম্পাস
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ