Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আজও নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার

প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলম শামস

কন্যা জায়া জননী, যে নামেই ডাকি না কেন, তারা আমাদের জীবনের অংশ। একজন নারী ছাড়া পুরুষের জীবন অসম্পূর্ণ। তাই নারীদের অবমূল্যায়ন করার মধ্য দিয়ে জীবন সুন্দর হতে পারে না। সমাজ সমৃদ্ধ হতে পারে না। দেশ উন্নত হতে পারে না। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায় বলতে হয় Ñ
‘পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
দিনদিন বাড়ছে নারী শ্রমিকের সংখ্যা। গ্রামে শহরে, কৃষি কাজে, শিল্প কারখানায় সব খানেই নারী শ্রমিকের সরব উপস্থিতি দৃশ্যমান। সব স্তরেই নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা পাচ্ছেন না সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি।
দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ নারী বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হন। নারী শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, এই কর্মজীবী নারীদের বেশিরভাগই ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান না। শহর ও গ্রামভেদে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের বেতন বৈষম্যও বেশ প্রকট।
বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ। মজুরির পাশাপাশি তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ নানা সামাজিক বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখা নারীরাও পাচ্ছেন না শ্রমের সঠিক মজুরি। এমনকি, গৃহস্থালিতে প্রতিদিন শ্রম দেয়া প্রায় সাড়ে ৫ কোটি নারীরও শ্রমের কোন মূল্যায়ন নেই দেশের অর্থনীতিতে।
শ্রমবাজারে নিযুক্ত নারীরা এখনো মজুরি, নিয়োগ, পদোন্নতি এসব বিষয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নিজেদের অধিকার আদায়ে নারীদের ট্রেড ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তিকরণের ওপর জোর দেন তারা।
নিম্নআয়ের কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা হলো, সাবিনা ফার্মগেট এলাকার একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তাকে মাসে খাওয়া-দাওয়াসহ আড়াই হাজার টাকা দেয়া হয় বলে তিনি জানান। কিন্তু একই বাড়িতে কর্মরত নিরাপত্তা প্রহরী দেলোয়াকে দেয়া হয় খাওয়া-দাওয়াসহ মাসে ৬ হাজার টাকা। অথচ সাবিনা বাড়ির যাবতীয় কাজ করেন। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাচ্চাকে স্কুলে, কোচিংয়ে আনানেয়া পর্যন্ত। আর দেলোয়ার শুধু চেয়ার নিয়ে বসে থাকে। আর মাঝে মাঝে একটু গেট খুলে আর বন্ধ করে।
আবার গ্রামাঞ্চলের দিকেও একই দৃশ্য। দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর গ্রামের ফুদুজান বেওয়া পানের বরজে মাটি তোলার কাজ করেন। এখানে তিনি দুইশ’ টাকা দিনমজুরি পান, পুরুষ শ্রমিক পান তিনশ’ টাকা। আবার কোনো বাড়িতে কাজ করলে তাকে একশ’ টাকা দেয়া হয়, পুরুষ শ্রমিককে দেয়া হয় দুইশ’ টাকা। মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বললে একজন মহিলা মালিক বলেন, পুরুষ মানুষ বেশি পরিশ্রম করে। একজন নারী একই সময়ে একজন পুরুষের চেয়ে তুলনামূলক কম কাজ করতে পারে। তাই তাকে কম পারিশ্রমিক দিই। কিন্তু ফুদুজান বলেন তার সঙ্গের পুরুষ শ্রমিকটি সারাদিনে যত ঝুড়ি মাটি টানে তিনিও একই পরিমাণ মাটি টানেন। আবার তিনি এও বলেন, বাড়ির কাজে পুরুষ শ্রমিক দুপুর পর্যন্ত কাজ করে আর আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেও মজুরি কম পাই।
দিনে দিনে ঘরে-বাইরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না তাদের পারিশ্রমিক। প্রয়োজনের তাগিদে ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয় নারী কিন্তু সেই নারীকেই প্রতি পদে হতে হয় হেয়। আবার কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হওয়ার পাশাপাশি ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকেও বঞ্চিত করা হয় তাকে।
পোশাক নির্মাণসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল কারখানা ও নির্মাণ শ্রমিকের নানাবিধ কাজে নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান কাজ করলেও সমান পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে কাজ করে মর্জিনা বেগম।
তিনি ইট ভাঙা ও মাটি টানার কাজ করেন। কিন্তু তাকে পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে কমপক্ষে পঞ্চাশ থেকে একশ’ টাকা কম মজুরি দেয়া হয়।
পোশাক নির্মাণ শিল্পে কর্মরত সাবিনা খাতুন। তিনি বলেন, এখানেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কম বেতনে কাজ করে। প্রতিবাদ করলে সরাসরি মালিক কর্তৃপক্ষ বলে, ‘ভালো লাগলে থাকেন, না লাগলে সোজা রাস্তা মাপেন।’ এভাবেই প্রতিদিন নানা অপমানজনক কথা সহ্য করে আমাদের কাজ করতে হয়।
পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানায় ত্রিশ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন, যার শতকরা হার মোট শ্রমিকের নব্বই ভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শহরাঞ্চলে উৎপাদনমুখী কারখানা, পোশাক শিল্প, রফতানিমুখী শিল্প, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ, খাদ্য ও কোমল পানীয় তৈরির কারখানায় অনেক নারী শ্রমিক কাজ করেন। এসব কারখানায় নারী শ্রমিক নিয়োগের একমাত্র কারণ নারীরা এই কাজগুলোতে দক্ষ। আর তাছাড়া সস্তায় দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ সম্ভব বলেও নারী শ্রমিক বেশি নিয়োগ দেয়া হয়।
শুধু কি কর্মক্ষেত্রে? ব্যবসা ক্ষেত্রেও নারীকে অবমাননার শিকার হতে হয়। একজন মহিলা সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে কম দামে সবজি কিনতে চায়, আবার নারী বলে ন্যক্কারজনক কথা বলতেও ছাড়ে না অনেকে।
বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায়, গত প্রায় দুই দশক ধরে স্থানীয় ও উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে অধিক হারে। খেটে-খাওয়া মানুষের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট আট মিলিয়ন নারীর মধ্যে শতকরা চল্লিশজন গ্রামে বসবাস করে। এদের অধিকাংশই শ্রমজীবী নারী। দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মপরিবেশ ও বেতন দেয়া হচ্ছে না নারী শ্রমিকদের। পোশাক নির্মাণসহ অন্যান্য উৎপাদন কারখানায় মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বেশি।
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে বহু শ্রমিক হতাহত হন।
১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দিবসটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আজো নারী শ্রমিকের উপযুক্ত মূল্যায়ন হচ্ছে না। এভাবে আর কতকাল এ অবলা নারীদের বৈষ্যমের শিকার হতে হবে?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আজও নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার
আরও পড়ুন