Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

প্রতিবন্ধীরা কি অনুকম্পা ও করুণার পাত্র?

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

অতীতে প্রতিবন্ধীতাকে পাপের ফল অথবা পূর্বজন্মের কর্মফল হিসেবে দেখানো হয়েছে। আধুনিক সভ্যতার যুগেও প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে আমাদের দেশে অসম্মানজনক ধ্যান-ধারণা চালু আছে। প্রতিবন্ধীরা যুগ যুগ ধরে সমাজের কাছে অনুকম্পা ও করুণার পাত্র হয়ে আছে। তাদের স্থান সমাজের প্রান্তিকতম স্থানে। তাদের অধিকার উপেক্ষিত। জীবনের ন্যূনতম অধিকারগুলো থেকেও তারা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত।
আমাদের সমাজের এই মানসিকতা বা ধারণা বহু বছর আগে থেকেই চলে আসছে। প্রতিবন্ধীদের সমাজে বিভিন্নভাবে অপমানিত ও নিগৃহীত হতে হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি মহিলা হয় তাহলে তার অবস্থা আরও করুণ। জন্মগতভাবে কিছু মানুষ প্রতিবন্ধীতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা সবাই আমাদের সমাজের অংশ। প্রতিবন্ধীতার কারণে তারা অনেক সময় অবজ্ঞা ও করুণার পাত্র হয়ে উঠে, যা নিতান্তই অমানবিক। যে সমাজ তাদের অবহেলার চোখে দেখে সে সমাজ প্রতিবন্ধী।
আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীদের অবস্থা কেমন এবং প্রতিবন্ধী সম্পর্কে রাষ্ট্র তথা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত তা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে, দয়া-দক্ষিণা নয় বরং অধিকারের ভিত্তিতে। প্রতিবন্ধীদের সমাজে বেঁচে থাকতে হলে তাদের অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। সমাজে উঁচু মাথা নিয়ে প্রতিবন্ধীদের বেঁচে থাকার প্রধান এবং একমাত্র হাতিয়ার হলো শিক্ষা। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারলেই প্রতিবন্ধীরা সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক হতে পারবে। আমাদের সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। অনেক সুযোগ-সুবিধার কথাও উল্লেখ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রতিবন্ধীরা সেই সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের যা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা আইনে উল্লেখ করা আছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধীদের কাছে স্বপ্নসম। সরকার শুধু বড় বড় ভাষণ দিয়েই ভাবে কাজ শেষ, প্রকৃত প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের কথা কেউই সিরিয়াসলি ভাবে না। জরমযঃ ঃড় ঊফঁপধঃরড়হ অপঃ এ প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে কিন্তু যখন স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয় তখন দেখা যায় যে, প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো প্রকৃত শিক্ষা কাঠামোর ব্যবস্থা নেই। প্রতিবন্ধীদের বেশির ভাগই গরিব ঘরের সন্তান। তারা যদি শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে সব সুযোগ-সুবিধা ঠিকভাবে না পায় তাহলে পড়াশোনার ব্যাপারে তারা অগ্রসর হবে না। তাই প্রতিবন্ধীরা শিক্ষাঙ্গনে যেন সঠিকভাবে সব সুযোগ-সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাদের মধ্যেও কোনো না কোনো বিষয়ে প্রতিভা রয়েছে যা আমরা স্টিফেন হকিং, হেলেন কেলার, এডিসন প্রমুখকে দেখলেই বুঝতে পারি। সরকার যদি একটু মানবিকতার দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধীদের কথা ভাবে তাহলে তারা অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে।
সবচেয়ে বড়ো কথা হলো প্রতিবন্ধীদের কী কী অধিকার আছে এই ব্যাপারে তারা কেউই অবগত নয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন আছে বলে বসে থাকলে চলবে না। তা যদি ঠিকঠাক ব্যবহার না করা হয় তাহলে এই আইনের কোনো গুরুত্ব নেই। শিক্ষাঙ্গণে গিয়ে প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা সঠিকভাবে বৃত্তি পাচ্ছে না। নতুন সরকার আসে, পুরাতন সরকার চলে যায়। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের কথা ভাবার সময় কারো নেই। প্রতিবন্ধীদের যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তাহলে সামাজিক উন্নয়নে তাদের অবদান যেমন বাড়বে, তেমনি উন্নয়নের গতিও বৃদ্ধি পাবে। কীভাবে তারা বিনা খরচে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে সেই বিষয়টা সরকারকেই ভাবতে হবে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজ নিজ অধিকারের প্রশ্নে সরব হতে থাকে। অবশেষে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘ ১৯৮১ সালকে ‘প্রতিবন্ধী বর্ষ’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ থেকে প্রতিবন্ধীদের জন্য সুন্দর একটি নাম দেওয়া হয়েছে। আজকাল আমরা তাদের প্রতিবন্ধী বলি না। সুন্দর নামটি হল- উরভভবৎবহঃষু অনষবফ চবৎংড়হ বাংলায় তরজমা করলে দাঁড়ায়, ভিন্নরূপে সক্ষম। জাতিসংঘের দাবি সনদে এও বলা হয়েছে যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়ে প্রতিবন্ধীদের সম্পূর্ণ অধিকার থাকবে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য যে নতুন খসড়া তৈরি করেন (২০১৩ সালে) তাতে প্রতিবন্ধীদের সব অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। আঠারো বৎসর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল যা আজ এত বছর পরও দূর অস্ত। বিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ শিশু এখনও নিরক্ষর, যারা স্কুলে যায় তাদের মধ্যেও প্রাক-প্রাথমিক স্তর উত্তীর্ণের সংখ্যা স্বল্প। সর্বশিক্ষা অভিযানে যে গুরুত্ব দেবার ঘোষণা ছিল কার্যত তার কিছুই হয়নি। ফলে অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে।
শিক্ষার বাণিজ্যিকরণের ফলে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশের দরজা প্রায় বন্ধ। শিক্ষার অধিকার আইনে ছয় থেকে চৌদ্দ বছরের প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য পঁচিশ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী পরিকাঠামোর অভাবে তা নিতান্ত কথার কথাই রয়ে গেছে। ছয় বছরের নিচের শিশুদের এই আইনের আওতায় আনা হয়নি। ফলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সব প্রতিবন্ধী ঐক্যবদ্ধভাবে শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমাদের সমাজে যে বুদ্ধিজীবী মহল আছে তারাও যদি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে একটু ভাবে তাহলে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন সম্ভব।
প্রতিবন্ধীদের স্বচ্ছল হওয়ার জন্য বা উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আবার বিভিন্ন স্কিমের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের ঋণ দানেরও ব্যবস্থা করেছে। কৃষি, বাণিজ্য কুটির শিল্প এইসব বিষয়ে এবং এই স্কিমের আওতায় প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা বৃত্তি পেয়ে উপকৃত হচ্ছে। যেসব প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী আর্থিকভাবে দুর্বল তারাও এই ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে দেশে ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, যারা গবেষণা করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য কিছু প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো সম্পর্কে যদি সব প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী অবগত হতো তাহলে তারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে অগ্রসর হতো। প্রতিবন্ধীদের জন্য যেসব প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে তা তৃণমূল স্তরে পৌঁছেনি।
সমাজের সকল অংশের মানুষের জন্য আমাদের সংবিধানের যে মৌলিক নীতিগুলো অর্থাৎ স্বাধীনতা, ন্যায়, সমতা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে তা প্রতিবন্ধীদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু যখন প্রতিবন্ধীরা এই অধিকারগুলো প্রয়োগ করতে যায় তখন দেখা যায় তাদের কোনো অধিকারই নেই। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই স্বজন। সুতরাং অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক ভূমি থেকে তাদের তুলে এনে ¯েœহ দিয়ে, সহায়তা দিয়ে, অধিকার দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে অনুকম্পার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন ভালোবাসা ও উৎসাহ।
একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে ভালোবাসা ও উৎসাহ। তারা অবহেলার পাত্র নয়, তারা আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যে সম্পদকে আমরা উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে সমাজকে সমৃদ্ধশালী করতে পারি। সবচেয়ে বড় কথা, প্রথমে বিকলাঙ্গ হওয়ার কারণগুলোকে অনুসন্ধান করে সরকার এবং জনগণকে এর প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রতিবন্ধী

১৪ মার্চ, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন