Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মনোনয়নপত্র বাতিল এবং ভারসাম্যহীন নির্বাচনের খসড়া

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

নানামাত্রিক আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও দেশে এক প্রকার নির্বাচনী আমেজ দেখা যাচ্ছে। যদিও শুধুমাত্র নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা এবং ঘোষিত তফসিল অনুসারে মনোনয়নপত্র দাখিলের কার্যক্রম ছাড়া ভোটের মাঠে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের পদচারণা এখনো প্রায় অনুপস্থিত। এখনো হুলিয়া, গ্রেফতার, তল্লাশি ও ধরপাকড়ের মধ্যে পলায়নপর জীবনযাত্রা পার করছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা। মামলায় নাকাল, দন্ডিত ও অঘোষিত হুমকির মধ্যে বিরোধিদলের বহু প্রার্থী নির্বাচন থেকে বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সংসদ ও দলীয় মন্ত্রীপরিষদ বহাল রেখে, সরকারের সাজানো প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতিদমন কমিশন ও বিচারাদালতের উপর প্রভাব অক্ষুণœ রেখেই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সংলাপে প্রধানমন্ত্রী যে সব প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাতে আস্থা রেখেছিল তারা। তফশিল ঘোষনার পর থেকে নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামগ্রিক কার্যক্রম দেখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রত্যাশা ইতিমধ্যে মধ্যে উবে যাওয়াই স্বাভাবিক। পাশাপাশি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের গোপন বৈঠকে ফাঁস হওয়া ভিডিও ও তথ্যগুলো থেকে আরেকটি একতরফা বা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। দেশে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কাঙ্খিত পরিবেশ যে নেই তা’ ইতিমধ্যে নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর দেশের প্রশাসন এবং নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। বিএনপি ও বিরোধী জোটের নির্বাচনকালীন সরকারের দাবীকে অগ্রাহ্য করে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা এই বক্তব্যটিই বার বার দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিকার অর্থে স্বাধীন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ না হয়, তারা যদি সরকারের নির্বাহী ক্ষমতার দ্বারা প্রভাবিত হন এবং মন্ত্রী পরিষদ ও সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে কেমন নির্বাচন হয়, তারই এক মহাপরিকল্পনার পরীক্ষণ ও বাস্তবায়ন দেখার জন্য অপেক্ষা করছে দেশের কোটি কোটি মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। দলীয় সরকারের অধীনেও নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে, বিশ্বের বহুদেশে তা হয়ে আসছে, এমন একটা বাস্তব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তিনি বার বার বলেছেন, জনগন ভোট দিলে আছি, না দিলে নাই। গত সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে রফতানী ট্রফি বিতরণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনে কি হবে জানি না। তবে যে সিস্টেম করে রেখেছি তাতে দেশের উন্নয়নে কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। গত ১০ বছরে দেশের অবকাঠামো খাতে বেশ কিছু মাইলফলক উন্নয়ন হয়েছে। পরিসংখ্যানের হিসেবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। যদিও আয়বৈষম্য তথা ধনীর আরো ধনী হওয়া, দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়া, গরীবের আরো গরীব হওয়া এবং অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা এ ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিদ্যুতের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সাফল্য অস্বীকার করা যাবে না। পক্ষান্তরে রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের নামে বিদ্যুত খাতে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, রাষ্ট্রের তথা জনগনের হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি কতিপয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠিকে বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধাদানের অভিযোগ ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে।
উন্নয়নের দাবী এতটাই জোরালো ও পরিব্যাপ্ত যে, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সব মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে আওয়ামীলীগ ও মহাজোটের তৃণমূলের নেতারা পর্যন্ত সহ¯্রমুখে এবং সরকারের অনুগত ও প্রভাবিত সব গণমাধ্যম এই বক্তব্য সাধারণ মানুষের মনে-মগজে প্রোথিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যে কোন দেশের কোন রাজনৈতিক শক্তি তাদের ক্ষমতায় থাকা এবং ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাকে নবায়িত করার উপায় হিসেবে দেশের উন্নয়নের হালচিত্র ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরাই হচ্ছে সবচে কার্যকর অস্ত্র। আওয়ামীলীগ ও মহাজোট সেই কাজটিই করছে। তবে সরকারের কথিত উন্নয়নের দাবীর বাস্তবতা এবং জনগণের আস্থার মধ্যে কোথায় যেন একটা সূ² ফারাক রচিত হয়েছে। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে (বর্তমানে নির্বাচনী আলোচনায় যা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বাক্যবন্ধে বেশ চালু রয়েছে) সদিচ্ছার এমন ঘাটতি থাকার কথা নয়। যেখানে গত তিন দশকে দেশে একটি দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক বৃত্ত গড়ে উঠেছে, সেখানে জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রাপ্তির হারের দিক থেকে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র ভোটের ব্যবধান শতকরা ৪-৫ শতাংশের বেশী নয়। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনগুলোতে তা প্রমাণিত হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় আপাতদৃষ্টিতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করেও অঞ্চলভিত্তিক ভোটের হিসাব, প্রার্থী নির্বাচন এবং প্রশাসনিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ভোটের হিসাবে ৫-১০ ভাগ উল্টে দেয়া অসম্ভব নয়। যেখানে আমাদের নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত সরকারের নির্বাহী বিভাগের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিতই শুধু নয়, প্রশাসন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক পরিচয় ও আনুগত্যের নিরীখে নিয়োগ ও পদায়ন হয়ে থাকে, সেখানে সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন প্রায় অসম্ভব জেনেও বিরোধিদল নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের পুরো দায়ভার ক্ষমতাসীনদের উপর ন্যাস্ত হয়ে গেছে। নির্বাহী ক্ষমতা ও দলীয়করণকৃত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণের সুযোগ বা ক্ষমতার অপব্যবহারে এটাই প্রমাণিত হবে যে, বর্তমান বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অসম্ভব। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি থাক বা না থাক, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম যে ভূমিকাই পালন করুক, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, দেশের ১০ কোটির বেশী ভোটার এই নির্বাচনের মান ও গ্রহণযোগ্যতার প্রত্যক্ষ সাক্ষি হয়ে থাকবে। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের ১১ দফা লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েই আওয়ামীলীগের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে যাওয়াকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে অবাধ,সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবীর অসারতা এবং দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সক্ষমতা প্রমাণের আর কোন সুযোগ সরকারের হাতে নেই। এ ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাইয়ে মামলার অস্ত্র ব্যবহার এবং তুচ্ছ বিষয়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করে প্রথমেই নির্বাচনের মাঠকে ভারসাম্যহীন ও অসমতল করে তোলা হয়েছে।
তফশিল ঘোষণার পর নির্বাচনের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা যেন ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের মধ্য দিয়ে তা পুনরায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। নেত্রিকে জেলে রেখেই নির্বাচনে যাওয়া বিএনপি’র শীর্ষনেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শত শত মনোনয়নপত্র বাতিলের মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্পিরিট ও সাফল্য চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দন্ডিত ও আপীলে যাওয়া প্রার্থীদের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ আদালতে রহিত হওয়া ছাড়াও তুচ্ছ সব বিষয়ে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের ছড়াছড়ি ঐক্যফ্রন্টের জন্য নির্বাচনকে সন্দিহান করে তোলা হয়েছে। যদিও রির্টানিং অফিসারদের মনোনয়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন ও আদালতে আপীলের সুযোগ রয়েছে। তথাপি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে অনেকেই আর ন্যায় বিচার প্রাপ্তির ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারছেনা। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তুচ্ছ বিষয়কে আমলে নিয়ে মনোনয়ন বাতিল করা হবেনা। প্রার্থীতা বাছাইয়ের দিন বিশেষত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির শত শত প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের পর দেখা গেল, আওয়ামীলীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী, শাহ এম এস কিবরিয়ার পুত্র, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড.রেজা কিবরিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের কারণ একটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের বাৎসরিক চার্জ হিসেবে সাড়ে ৫ হাজার টাকা বাকি থাকা। অপমৃত্যুর শিকার হওয়া আওয়ামীলীগের সাবেক অর্থমন্ত্রীর ছেলের পক্ষ ত্যাগ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান এবং ধানের শীষে নির্বাচন করার ঘোষণায় রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছে। রেজা কিবরিয়ার মত একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ও অ্যাকাডেমিসিয়ান দেশের সক্রিয় রাজনীতিতে অবদান রাখার সিদ্ধান্ত নি:সন্দেহে ইতিবাচক বিষয়। কিন্তু তুচ্ছ, তাৎপর্যহীন ও তাৎক্ষনিক সমাধানযোগ্য বিষয়কে আমলে নিয়ে তার মনোনয়নপত্র বাতিলের ঘটনা নির্বাচনী আইন ও অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে নির্বাচন কর্মকর্তাদের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ ধরনের আশঙ্কা সামনে রেখেই বিএনপি একেকটি আসনে দু’তিনজনকে মানোনয়ন দাখিলের চিঠি দিয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামীলীগের এ ধরনের আশঙ্কা না থাকায় তাদের একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের সংখ্যা ছিল খুবই কম। এতকিছুর পরও বাছাইয়ের পর বেশ কয়েকটি আসনে বিএনপির কোন প্রার্থী নেই। অনেক আসনে যোগ্যতম ও হেভিওয়েট প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী নিয়েই নির্বাচন করতে হবে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টকে। হেভিওয়েট, যোগ্যতর, অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রার্থীদের নির্বাচনের বাইরে রেখে সংসদীয় গণতন্ত্রের মানোন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। ট্রেজারি বেঞ্চে ও অপজিশনে যোগ্যতর পার্লামেন্টারিয়ানদের অনুপস্থিতি জাতীয় রাজনীতির জন্য অনেক বড় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়া কে দশম জাতীয় সংসদে দেখা যায়নি। তাদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তসহ কয়েকজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ কয়েকজন একাত্তরের মানবতা বিরোধি অপরাধের বিচারে ফাঁসির দন্ডে মত্যুবরণ করেছেন। পুরনোদের জায়গায় নতুনরা আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হিংসা-হানাহানি ও অপরাজনীতির কারণে দেশের তরুন প্রজন্ম যখন রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ে, তখন দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কার কারণ থেকেই যায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ এখনো প্রবলভাবে সন্দিহান। সন্দিহান এ কারণে যে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। রাজনৈতিক দল ও সরকারের শীর্ষ নেতারা তাদের প্রতিশ্রæতি এবং জন আকাঙ্খার কোন তোয়াক্কা করছেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে খুব শীঘ্রই আরো একটি নির্বাচন হবে। বিরোধিদলের পক্ষ থেকে গত চার বছর ধরেই রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার দাবী জানানো হলেও সরকারী দলের নেতারা বরাবরই তা প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। অবশেষে বিএনপি’র জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া দিয়ে ড.কামাল হোসেনের মত ভ্যাটারান, প্রবীন রাজনৈতিক ব্যক্তির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে প্রধানমন্ত্রী সংলাপে ৭ দফা দাবী না মানলেও বিএনপি নেতাদের হয়রানিমূলক মামলা, গ্রেফতার, খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যাপারে সরকারের নমনীয় অবস্থানের কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো সম্পুর্ন বিপরীত চিত্র। তফশিল ঘোষনার পরও বিএনপির শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশি একজন গুম হওয়ার পর বুড়িগঙ্গায় লাশ পাওয়া গেছে। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পরও বিএনপির একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী গ্রেফতার হয়েছেন। অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। বিএনপি’র শতাধিক মূল প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করে নির্বাচনের বাইরে রেখে, আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করে নির্বাচনের আগেই একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে সরকারীদলের সুবিধাজনক অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের মধ্য দিয়ে রির্টানিং অফিসার এবং নির্বাচন কমিশনের যে পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ পাওয়া গেল তা’ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পর্কে জনমনে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরী করেছে। আরেকটু পেছন থেকে অবলোকন করলে দেখা যাবে, নির্বাচনের রোডম্যাপ চুড়ান্ত করতে সব রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে সংলাপে অংশগ্রহণকারি রাজনৈতিক দলগুলে কমিশনের কাছে কী কী প্রস্তাব রেখেছিল তার অনেকটা গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছিল, রাজনৈতিকদলগুলোর প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের মূল্যায়ণ এবং সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে। রাজনৈতিক দলগুলো জনআকাঙ্খার কথাই তুলে ধরেছিল, তবে নির্বাচন কমিশন সে বিষয়ে কোন স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট অবস্থান জানাতে না পারলেও নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী ও সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে ন্যুনতম কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। নির্বাচন কমিশনের উপর সরকারের যত প্রভাবই থাক না কেন, এই ভ’মিকার জন্য সরকার বা সরকারীদলকে দায়ী করা যায় না। নির্বাচন কমিশনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে দ্বিমত পোষণ ও নোট অব ডিসেন্ট দিতে দেখা গেছে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং স্টেক হোল্ডারদের আস্থা অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনারবৃন্দ সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তিই শুধু নন, সামাজিক অবস্থান, পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং দেশের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে তাদের ভ’মিকা ও দায়বদ্ধতা অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। একজন নির্বাচন কমিশনার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে মত বিনিময়ের সময় বলেছেন, এবারের নির্বাচন জনগনের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগনের আস্থা পুন:প্রতিষ্ঠার নির্বাচন। তার সহকর্মীদের মধ্যে দু’একজন এই স্পিরিটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মতামত প্রকাশ করলেও মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রির্টানিং অফিসারদের ভ’মিকা বিরোধিদল ও জনমনে সন্দেহ ও অনাস্থার আশঙ্কাই বেড়েছে। চুড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচন এবং প্রতীক বরাদ্দ পর্যন্ত আরো অনেক কিছুই দেখার আছে। এই নিবন্ধ লেখার সময় বাতিল হওয়া মনোনয়নপত্রের প্রার্থীদের অনেকে নির্বাচন কমিশনে আপীলে গিয়েছেন। আপীলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা থেকে জনগন কমিশন সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্তে আসতে পারে। চুড়ান্ত ভোটের লড়াইয়ে সরকারী দলের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের ভূমিকা, জননিরাপত্তা ও নির্ভয়ে ভোটদানের পরিবেশ সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দিতার মধ্য দিয়ে ভোটের ফলাফলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার উপর আগামী দিনের বাংলাদেশের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। তবে নির্বাচনের বল এখন প্রায় একচ্ছত্রভাবেই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের কোর্টে। পক্ষপাতিত্ব ও যেনতেন প্রকারের নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া বা কোন পক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়তো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে হেরে যাবে সম্ভাবনার বাংলাদেশ এবং দেশের জনগণ। দেশের মানুষ আর কোনো বিতর্কিত একপাক্ষিক নির্বাচন চায় না।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন