Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সড়কে মৃত্যুর হার বাড়ছেই

| প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি এবং আহত হওয়া অতি সাধারন পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে যাচ্ছে অমূল্য প্রাণ। আহত হয়ে অচল হয়ে পড়ছে মানুষ। গতকালও নরসিংদিতে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়রে ধামরাইয়ে বাসের সঙ্গে মোটর সাইকেলের সংঘর্ষে মোট ৭ জন নিহত হয়েছে। দেখা যায় যে, সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের সব সদস্যও নিহত হয়। অর্থাৎ একটি পরিবারই ধ্বংস হয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা নতুন না হলেও সাম্প্রতিককালে এর হার অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণও অজানা নয়। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, সড়কের নিয়ম-নীতি না মানা, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, ওভার টেকিং, সড়কের বেহাল দশা অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হলেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে না। এর কারণ হচ্ছে, সড়কে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণের পাশাপাশি সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত ট্রাফিক পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায়িত্ব পালনের গাফিলতি। গত শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বাংলাদেশে গত ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। অন্যদিকে পুলিশের হিসাব মতে, ওই বছরে নিহত হয়েছে ২৪৬৩ জন। দেখা যাচ্ছে, পুলিশের হিসাব ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসবাটিই যথার্থ। এমনিতেই প্রতিদিন যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং পত্রপত্রিকায় যে সংখ্যা উল্লেখ করা হচ্ছে, এ থেকেই বোঝা যায়, পুলিশের হিসাবটি যথাযথ নয়। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যক্ষা ও এইডস-এর মতো মরণব্যাধিতে মৃত্যুর চেয়েও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বেশি। বর্তমান বিশ্বে মৃত্যুর অষ্টম কারণ হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনায় অর্ধেকের বেশি মৃত্যুবরণ করে পথচারি, সাইকেল ও মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীরা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হলো ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহার। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এই সমস্যা তুলনামূলক বেশি। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। এখানে সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো বহু আগেই শনাক্ত হয়েছে। তবে শনাক্ত হলেও এর প্রতিকারের যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই। এখনতো প্রধান প্রধান মহাসড়কে মাইলের পর মাইল যানজটে আটকে থাকতে হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকা এসব যানবাহন যখন একটু ফ্রি রাস্তা পায়, তখন সময় বাঁচাতে এর চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে থাকে। এই গতি সামলাতে না পেরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এর উপর রয়েছে, চালক এবং যানবাহনের ফিটনেসের অভাব। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রানহানি ছাড়াও আর্থিক ক্ষতি হয় বিপুল । এক হিসেবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই কর্মক্ষম এবং এদের মধ্যে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও থাকেন, যারা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এমনকি তরুণ শিক্ষিত লোকজনও থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যখন সড়ক দুর্ঘটনায় বেঘোরে প্রাণ হারায়, তখন সেই পরিবারটি মুহূর্তে নিঃস্ব হয়ে যায়। এক সময় সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় এভাবে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। এর জন্য তারা কাউকে দায়ী করতে পারছে না। যাদের দায়ী করবে, তাদের শক্তি অসীম। সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠন থেকে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পর্যন্ত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া চালকদেরই পক্ষাবলম্বন করে। নিহতের পরিবারের কী সাধ্য আছে, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার! তারা নীরবে-নিভৃতেই সীমাহীন দুঃখ-বেদনা ও যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়াস চালায়। রাষ্ট্রকেও তাদের পাশে কখনো দাঁড়াতে দেখা যায় না। অথচ একজন কর্মক্ষম মানুষ যখন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় তার জায়গাটি শূন্য হয়ে যায় এবং এ শূন্যতা রাষ্ট্রের ওপরও বর্তায়।
সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলো চিহ্নিত হওয়ার পরও তার প্রতিকার না হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। প্রতিকার হলে এভাবে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটত না। দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন একটা ভাব পরিলক্ষিত হয়, দুর্ঘটনা ঘটলে কী আর করা! এতে তো কারো হাত নেই! তাদের এ ধরনের শিথিল ও উদাসীন মনোভাবের কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। দুর্ঘটনায় কারও হাত নেই-এ কথাটি তখনই প্রযোজ্য যখন সড়ক-মহাসড়ক যান চলাচলে পুরোপুরি উপযোগী এবং মসৃন থাকে , সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী সচেতন চালকরা গাড়ি চালায় এবং যানবাহনের ফিটনেস শতভাগ ঠিক থাকে। এসব বিষয় নিশ্চিত না করলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবেই এবং দায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সড়ক-মহাসড়কে এখনও নিষিদ্ধ নসিমন, করিমন, ভটভটি, থ্রি হুইলারের মতো ধীরগতির অতি নাজুক যানবাহন চলাচল করছে, অবৈধভাবে বাজার বসছে এবং স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে-এ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তবে সড়ক দুর্ঘটনা কমা বা নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে,যে সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার নির্মাণে জনগণের অর্থের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সেই সড়ক-মহাসড়কেই তাদের বেঘোরে প্রাণ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সড়ক-মহাসড়কে জনগণকে তার অর্থ এবং প্রাণ দুটোই দিতে হচ্ছে। এরকম অরাজকতা আর কোনো দেশে আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, সড়ক-মহাড়ককে চলাচল উপযোগী করে তার সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি। যে কোনো ধরনের অবাঞ্চিত এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুর্ঘটনায় নিহতদের এবং আহতদের পরিবারকে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানিসহ সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে নিহত ও আহতদের পরিবারকে মাসিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি রাস্তায় চলাচল করার ক্ষেত্রে পথচারি এবং যাত্রীদেরও সচেতন হওয়া জরুরি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়কে মৃত্যু
আরও পড়ুন