Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ম্লান মোদি ম্যাজিক এগোচ্ছে কংগ্রেস

টাইমস অব ইন্ডিয়া | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:৪৩ এএম

নির্বাচনী প্রচারণায় একদিকে নরেন্দ্র মোদির কংগ্রেস ‘কি কৌন সি বিধওয়া হ্যায়’ বিদ্রুপ, অন্যদিকে রাহুল গান্ধীর ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান ২০১৯ সালের নির্বাচনের বৃহত্তর ইঙ্গিত বহন করছে। বিজেপির প্রাদেশিক নেতারা প্রচারণায় সোচ্চার ও স্থানীয় সমস্যাগুলোই তারা সামনে আনছেন, তবুও বাস্তবতা হচ্ছে, যে দলটি মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বর্তমানে লোকসভার ৬৫ আসনের মধ্যে যে ৬২টি তারা অধিকার করে আছে, তাদের জন্য রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনী ফলাফল বাতাস যে কোনদিকে বইছে তারই ইঙ্গিত।
মধ্য প্রদেশের ফলাফল থেকে কিছু সুস্পষ্ট প্রবণতার উদ্ভাস পরিলক্ষিত। প্রথমত, এক বছর আগে গুজরাটের সৌরাষ্ট্রের মত কংগ্রেস ভারতের গ্রামাঞ্চলে এগিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস ২০১৩ সালে তার ৫৬টি গ্রামীণ আসন ২০১৮তে ৯৫-তে উন্নীত করে। অন্যদিকে বিজেপি ২০১৩-তে ১২২ থেকে ২০১৮তে ৮২টিতে নেমে আসে। রাজস্থানে কংগ্রেস তার আসন ৪ গুণ বাড়িয়ে ১৮ থেকে ৮৩তে তুলেছে, সেখানে বিজেপি ১৩১ থেকে ৫৭তে নেমে এসেছে। আর ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ৩৫ থেকে ৫৬ আসনে পৌঁছলেও বিজেপি ৪১ থেকে ১৬-এ নেমেছে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ছত্তিশগড় ছাড়া বিজেপি আর কোথাও গ্রামাঞ্চল থেকে নির্মূূল হয়নি। অন্য গ্রামাঞ্চলে তার শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে, কিন্তু গতিপথের পরিবর্তন স্পষ্ট। এ অর্থে কৃষি বিপর্যয় ও তরুণদের বেকারত্ব বিষয়ে রাহুল গান্ধীর বার্তা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী যুদ্ধকে ব্যাপকতর করবে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে বিজেপির ৩ মুখ্যমন্ত্রীর সবাই বহুসংখ্যক কর্মসূচি নিয়ে অনুরূপ রাজ কল্যাণ মডেল অনুসরণ করছে। এটা অনেক বেশি যোগ্য নেতা শিবরাজ সিং চৌহানকে মধ্যপ্রদেশে অবস্থান জোরদারে সাহায্য করেছে।
দ্বিতীয়ত, কংগেস শহর এলাকা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বিজেপির আগের দুর্ভেদ্য দুর্গের গেরুয়া দেয়াল ভেঙে আবার পথ করে নিচ্ছে। শহর আসনগুলোতে রাজস্থানে কংগ্রেস বিজেপির সমপর্যায়ে পৌঁছেছে, মধ্য প্রদেশে প্রবেশ লাভ করেছে এবং ছত্তিশগড়ে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। শহরে এ অগ্রগতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বিজেপিকে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আনা ব্যবসায়ীরাসহ ভোটদাতাদের একটি প্রধান অংশ ভেঙে যাচ্ছে।
নোট বাতিল ঘটনার পর বিজেপি উত্তর প্রদেশে বিশাল বিজয় অর্জন করে। কিন্তু জিএসটিকে নিয়ে পুঞ্জীভূত শ্রমিক অসন্তোষ এবং নোট বাতিল থেকে বাস্তব কোনো ফল না হওয়া এখন দানা বাঁধছে। মধ্যপ্রদেশে শহর এলাকায় কংগ্রেস ২ থেকে ১৭টি আসনে উপনীত হয়েছে, বিজেপি ৪৪টি থেকে ২৯-এ নেমেছে। রাজস্থানে কংগ্রেস নিজেদের ৩ থেকে ১৭-তে টেনে তুলেছে, বিজেপি ৩২ থেকে নেমেছে ১৭-তে। ছত্তিশগড়ের শহর এলাকায় রাজধানী রায়পুরসহ সর্বত্র বিজেপি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, রামায়ণের হনুমানও দলিত ছিল বলে বিতর্কিত মন্তব্য করে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নির্বাচনী প্রচারণায় দলিতদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করলেও এ হিন্দি প্রাণকেন্দ্রে এসসি আসনে পরিষ্কার পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে। ৩টি হিন্দি রাজ্যে মোট ৭৮টি এসসি আসনের মধ্যে বিজেপি তার প্রাপ্ত ৬৮ আসন থেকে ৩২টি এসসি আসনে নেমে এসেছে। এর বিপরীতে কংগ্রেস ২০১৩ সালে মাত্র ৫টি থেকে ৪১টি এসসি আসনে উঠেছে।
এটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংখ্যাগত দিক দিয়ে শক্তিশালী সামাজিক গ্রুপ মেরুকরণ হচ্ছে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিএসপির সাথে না গিয়ে কংগ্রেস একটি ঝুঁকি নিয়েছে কিন্তু এ জুয়ার মূল্য পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
চতুর্থত, এ রাউন্ডের নির্বাচনকে রাহুল গান্ধীকে তৈরী করার নির্বাচন হিসেবে দেখা যেতে পারে। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে তার ব্যর্থতার পর তিনি এবারের নির্বাচনে বড় ধরনের ভ‚মিকা পালন করেছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীদের চেহারা প্রদর্শন করার দাবিতে আটকে না থেকে মধ্য প্রদেশে মোদির ১১টি সমাবেশের জায়গায় নিজে ২১টি করেছেন, ছত্তিশগড়ে মোদির ৫টির জায়গায় নিজে ১৩টি এবং রাজস্থানে মোদির ১৩টির জায়গায় নিজে ১৫টি সমাবেশ করেছেন। তার নির্বাচনী এলাকাগুলোতে তার তৎপরতা ভালো ছিল। হিন্দি প্রাণকেন্দ্রে যদি কংগ্রেস না জিতত তাহলে তার জন্য প্রধান দায়ী করা হত রাহুলকে। তাই এটাই স্বাভাবিক যে, এই বিজয়ের কৃতিত্বও তাকে দেয়া উচিত।
পঞ্চমত, বিজেপি ও উদারপন্থী উভয় কর্তৃকই নির্বাচনের সময় মন্দির প্রীতিকে এক চুনাভি হিন্দু ও সাংস্কৃতিক আত্মসমর্পণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের ভোটাররা তার হিন্দুত্বে প্রত্যাবর্তনকে সমস্যা হিসেবে দেখেননি। বরং এটা তাকে বিজেপি কর্তৃক তিনি হিন্দু বিরোধী বলে দেয়া অভিযোগ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ফলে অনেকেই তার পক্ষ নিয়েছেন। হিন্দুত্ব বিতর্ক দিল্লির অভিজাত সমাজের ড্রয়িংরুমে ‘নমনীয় হিন্দুত্ব’ নিয়ে বিতর্ক চললেও মাঠে মন্দির পরিদর্শনের বিষয়টি যুৎসই নির্বাচনী কৌশল হয়ে থাকতে পারে।
এরপর কী? হিন্দি প্রাণকেন্দ্র রাজ্যগুলোতে বিজেপি বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকার অর্থ সেগুলো তাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। সেগুলোতে এবার প্রচন্ড লড়াই হয়েছে। কর্নাটকের নির্বাচনে মোদি নিজে যতটা লড়েছিলেন, যে কারণে বিজেপি সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং যেমনটি তিনি তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় গুজরাটে জয়ী হন, এ রাজ্যগুলোতে মোদি সেভাবে লড়েননি। তিনি এখনো দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ভোট সংগ্রাহক। তবে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার শেষে সে ক্ষমতায় টান ধরতে পারে।
রাজ্যগুলোতে এ বিজয়ের সাফল্যকে লোকসভার ক্ষেত্রে টেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে, বিশেষ করে মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থানে ভোটের ব্যবধান খুবই সংকীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষিতে। ২০০৮-এ বিজেপি মধ্য প্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে জয়ী হলেও লোকসভা নির্বাচনে জেতেনি। এই নির্বাচন কোন দল লোকসভার কটি আসন পাবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করে না, তবে তা বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রবণতা ও পরিবেশ নির্ধারণ করে। উত্তর ভারতে কংগ্রেসের বিজয় তাকে অধিকতর সুবিধা দিয়েছে যেমন বিজেপি-বিরোধিতার জোয়ার তেলেঙ্গানায় কেসিআরকে বিশাল বিজয় দিয়ে অধিকতর জোট সম্ভাবনার বিষয় উন্মুক্ত করেছে। যাহোক, ২০১৯ সালে হবে গণিত বনাম ব্যক্তিত্বের রাজনীতি।
ক্ষমতায় থাকার বিরোধিতা দমনে সক্ষম নন মোদি ও অমিত শাহ
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের নির্বাচনী ফলাফল প্রধানমন্ত্রী মোদি ও অমিত শাহর জন্য বিপত্তি সৃষ্টি করেছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে এ ফলাফল বন্ধুহীন ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতার ব্যাপারে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। এ কথা এসেছে যে, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও অমিত শাহ তাদের ক্ষমতায় থাকার বিরোধিতা দমন করতে অক্ষম।
এ তিনটি রাজ্যে ৮৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল ৬৩টি ও কংগ্রেস ৬টি। মঙ্গলবারের নির্বাচনের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে বিজেপি ২০ ও কংগ্রেস ৪৬টি আসন পেতে পারে যা মোদির পুনঃনির্বাচনে এক বড় রকমের ধাক্কা হেেত পারে। এ পরাজয় মোদির নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না যদিও তার ও অমিত শাহর বিরুদ্ধে অন্তরালের আলোচনা সে সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। নোট বাতিলসহ মোদি সরকারের কিছু পদক্ষেপ নিয়ে কিছু গুঞ্জন রয়েছে তা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে অন্যরা এ বিষয়ে একমত নন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ