Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভিকটিম যেখানে জাতি ও জনগণ

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

লজ্জার সীমাবদ্ধতা থাকলেও লজ্জাহীনতার কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। সীমালংঘন শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী, যা সমাজবদ্ধ মানুষ পছন্দ করার পরিবর্তে নিন্দা করে থাকে। কিন্তু অস্ত্রের নিকট মানুষ অসহায় যেমনটি হয়েছিল পাক হানাদারদের সময়ে। এখন আবার তারই পুনরাবৃত্তি চলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখন নির্বাক, নিঃশব্দে নিস্তব্দ হয়ে পড়েছে। কারণ, সাংবিধানিকভাবে যাদের নিকট প্রতিকার পাওয়ার কথা তাদের মিথ্যাবাণীর সীমা এতটাই অতিক্রম করেছে, যার প্রতি সাধারণ মানুষ কোনো প্রকার আস্থা রাখতে পারছে না। শপথ গ্রহণপূর্বক সাংবিধানিক চেয়ারে বসে একজন মানুষ কতটা অসত্য বলতে পারে, এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকতর হতে পারে না। একজন মানুষ যখন শপথ গ্রহণপূর্বক একটি সাংবিধানিক চেয়ারে বসে মিথ্যার পর মিথ্যা বলতে থাকে, তখন সাধারণ মানুষের বিতশ্রদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনাস্থা দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। যদি থাকতো তবে নিশ্চয় জনগণ প্রতিকার পাওয়ার চেষ্টা করতো।
দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে আগাম জামিনের জন্য প্রতিদিন হাইকোর্টে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ হয়। সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের দু’তালায় ১২, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯নং কক্ষগুলিতে দ্বৈত ক্রিমিনাল বেঞ্চ বসে। এ বেঞ্চগুলির বারান্দা দিয়ে লোক সমাবেশের কারণে হাঁটা যায় না। প্রতিদিনের একই চিত্র। একটা মামলায় আগাম জামিন হওয়ার সাথে সাথেই আরেকটি গায়েবি মামলা রুজু হয়। অথচ অসত্য ভাষণে পটয়সী সাংবিধানিক শপথপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন যে, কোনো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হবে না বা কোনো গ্রেফতার হবে না। অথচ প্রতিদিনই মামলা ও গ্রেফতার হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের তা চোখে পড়ে না। 
নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন সময়ে ড. কামাল, মির্জা আলমগীরসহ ঐক্যফ্রন্টের বহু প্রার্থীর গাড়ি আক্রমণ ও ভাংচুর করা হয়েছে। একজন প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে গেছেন। অনেক প্রার্থী ও সমর্থক নাজেহাল হয়েছেন। তারপরও নির্বাচনে সহিংসতা সহনীয় পর্যায়ে আছে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন। বিএনপি বা শরীক দলের কত জনকে হত্যা করলে বা হামলা করলে বা নির্বাচনী প্রচার ক্যাম্প পুড়িয়ে দিলে বা গাড়ি ভাংচুর করলে নির্বাচনী সংহিসতা অসহনীয় পর্যায়ে যাবে তার একটি দিক নির্দেশনা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দেয়া দরকার। মানুষ যখন মূর্খের মতো কথা বলে, তখন অবচেতন মনেই বলতে থাকে। কিন্তু যখন কারো মনোরঞ্জনের জন্য অসত্য বা মিথ্যা বলতে থাকে তখন প্রমাণিত হয় সে একজন জ্ঞানপাপী। জ্ঞানপাপীরাই নিজ স্বার্থে অনায়াসে মিথ্যা বা অসত্য কথা বলতে অভ্যস্থ।
একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, ভয়ভীতিবিহীন জাতীয় নির্বাচন জাতির দীর্ঘদিনের দাবি এবং এ দাবি বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়েই জাতীয় সংকট নিরসন হতে পারে। পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ সরকারি দলকে পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যেই কথা উঠেছে, বর্তমান সরকার পুনরায় ক্ষমতায় না আসলে কারো পিঠের চামড়া থাকবে না। সরকারি ঘরনার কেউ বলছেন এক লক্ষ লোক মারা যাবে, আবার কেউ বলছেন আরো বেশি। সরকারি ঘরনার এই আতঙ্কের পিছনে নিশ্চয় তাদের কৃতকর্ম তাদের নাড়া দিচ্ছে এবং এই নাড়া থেকেই সরকারি ঘরনার ভীতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে যেভাবেই হোক পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবল বাসনা থেকেই পুলিশ, ম্যাজিস্টেট ও জেলা জজদের ক্ষমতার অপব্যবহার নগ্নভাবে করে বিরোধী দলকে মামলা-মোকদ্দমার ভীতিসহ বিভিন্ন প্রকার ভয়ভীতি, গাড়ি বহরে হামলা প্রভৃতি করে আজ দেশব্যাপী একটি ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যেতে না পারে। ভোট কেন্দ্রে যেতে পারলে পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে নিশ্চয় এতো দিনে সরকারের বোধদয় হয়েছে।
জনগণ ভয়ভীতির ঊর্র্ধ্বে থেকে লাইন ধরে যাতে কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে এর বাস্তবসম্মত ভ‚মিকা রাখার জন্যই নির্বাচন কমিশন শপথ নিয়েছিল। কিন্তু সেই শপথ কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা জনগণ অবশ্যই একটি পাল্লায় নিশ্চয় মূল্যায়ন করবে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশ আরো একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে। এও প্রতীয়মান হচ্ছে, এ নির্বাচন হবে আরো রক্তক্ষয়ী। কারণ প্রশাসন, পুলিশ বেপরোয়ারাভাবে সরকারের পক্ষ নিয়েছে, যা তাদের কর্মকাÐে বুঝা যায়।
আমলাদের একমাত্র ভয় গণবিস্ফোরণ, যা এখনো পরিস্ফোটিত হয় নাই। তবে সরকারের বাড়াবাড়ি, বিশেষ করে গায়েবি মামলায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সরকার স্বস্তিতে নাই। সরকার যে গণবিচ্ছিন্ন তা তার হাল নাগাদ কর্মেই প্রকাশ পাচ্ছে। দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীর নামে সরকার উৎখাতের জন্য নাশকতার মামলা হয়েছে। যদি ধরে নেয়া যায় যে, মামলাগুলি সত্য। তবে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, দেশব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ এ সরকারকে চায় না। যদি তাই হয় তবে পুনরায় সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার ভরসা পায় কোথা থেকে? সরকারের একমাত্র ভরসা নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ/ম্যাজিস্ট্রেট যার উপর ভর করে সরকার গায়েবি মামলার ঢালী সাজাচ্ছে। এর কৈফিয়ৎ সরকারকে একদিন না একদিন দিতেই হবে। 
এ নিবন্ধ লেখার সময় (১৮ ডিসেম্বর ২০১৮) ঐক্য ফ্রন্টের ১৪ জন প্রার্থী কারাগারে, প্রায় ৭০ জনের প্রার্থিতা (কম বেশি হতে পারে) বাতিল হয়েছে, প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকাতেই গায়েবি মামলায় শত শত হাজার হাজার নেতাকর্মী অভিযুক্ত। এমতাবস্থায়, ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট প্রতিদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিকট ধর্না দিচ্ছে। প্রার্থীরা ঘুরছে সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় বারান্দায়। 
প্রবাদ আছে যে, নৈতিকতাবিহীন শিক্ষা (উচ্চ ডিগ্রি হলেও) যেমন শিক্ষিত ব্যক্তির মেরুদÐ সোজা রাখতে পারে না, ঠিক অনুরূপ লজ্জা মানুষের ভূষণ কথাটিও স্বতঃসিদ্ধ প্রবাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। লজ্জাহীন একজন নর/নারী যা কিছু করতে বা বলতে পারে। সেখানে মিথ্যা বা অসত্য কথা বলা কোনো কারণেই তাদের বিবেক’কে দংশন করে না। কারণ, স্বার্থটাই তাদের মূল কথা। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ যার চক্ষু লজ্জা রয়েছে সে ততটা মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে না, যতটা পারে একজন লজ্জাহীন মানুষ। যেমন নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন যে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো তৈরি হয় নাই। ইতোপূর্বেও তিনি কমিশনের অনেক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও এটা মাহবুব তালুকদারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
৪৭ বছর হলো জাতি স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এখনো ভোটাধিকার বাস্তবায়নের জন্য জাতিকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কারণ সরকার অর্থাৎ যে যখন সরকারে থাকে তাকে তুষ্ট করার জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যস্ত থাকে, হোক তা সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেম একটি ভিন্ন বিষয়। আলেয়ার পরিচয় যাই হোক তার দেশপ্রেম ছিল যা ছিল না সেনাপ্রধান মীর জাফরের। গোলাম হোসেন একজন নওকর (ভৃত্য) হওয়া স্বত্তে¡ও দেশপ্রেম ছিল, যা ছিল না সিরাজদৌল্লাহর মন্ত্রিসভার অনেক রথী মহারথীদের। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পদমর্যাদার সাথে দেশপ্রেমের কোনো সম্পর্ক নাই। এটা নির্ভর করে মেরুদÐের শক্তির উপর। অন্যদিকে যে নির্লজ্জের মতো, মত প্রকাশ করে তার মেরুদÐ সোজা থাকতে পারে না। ফলে ভিকটিম হয় জাতি ও জনগণ। মিথ্যা যখন সত্যের সাথে পাল্লা দেয় তখন এর পরিণতির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। 
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জনগণ


আরও
আরও পড়ুন