Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্ভাবনার নতুন দ্বার

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন

মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, ছাগলনাইয়া (ফেনী) থেকে: | প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

দেশের ২৩তম স্থলবন্দর গড়ে তোলার কাজ এগিয়ে চলছে খাগড়াছড়ির রামগড়ে। এ বন্দর স্থাপনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফেনী নদীর ওপর বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১এর নির্মাণ শুরুর খবরে মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছে। ভারতের মিজোরাম ও দক্ষিণ ত্রিপুরায় ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য খাগড়াছড়ির রামগড়ে স্থলবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। 

বাংলাদেশের রামগড় পৌরসভার মহামুনি ও ভারতের সাব্রুম মহকুমার দোলবাড়ী সীমান্ত সংযোগ ফেনী নদীতে মৈত্রী সেতু-১ নির্মাণে ভারত সরকার তাদের অর্থায়নে কাজ দ্রুত করে যাচ্ছে। ভারত অংশে অ্যাপ্রোচ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৬ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মৈত্রী সেতু-১ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ফেনী নদীর খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম অংশে ১২৮ কোটি ৬৯ লাখ ভারতীয় মুদ্রায় ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতুর নির্মাণকাজ ও বন্দরের কার্যক্রম পরিদর্শনে রামগড় ঘুরে গেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। মৈত্রী সেতুর কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ অংশে স্থলবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণের কথা থাকলেও ভূমির মালিকানা সমস্যায় হাইকোর্টে মামলা চলমান থাকায় আটকে ছিল অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। এতে করে সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড তৈরির জন্য অধিগ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ এখনও পায়নি মালিকরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা।
অন্যদিকে, অধিগ্রহণ আতঙ্ক স্থলবন্দর এলাকার বাসিন্দাদের। ভূমির মালিক মনির হোসেন, মো. বারেক ও ফাতেমা বিবি বলেন, জনৈক ব্যক্তি ভুয়া কাগজ বানিয়ে ভূমির মালিক দাবি করে মামলা দায়ের করেন। এতে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আটকে যাওয়ায় আমরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাইনি। কখন ভূমি অধিগ্রহণ করে সে ভয়ে জমিতে চাষাবাদ করতে পারছি না। এতে করে আর্থিক সঙ্কটে দিন কাটছে তাদের। রামগড় পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাসেম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ভূমির মালিকরা অধিগ্রহণের টাকা এখনো পায়নি। মোস্তাফিজ নামের জনৈক ব্যক্তি ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত যে মামলাটি করেছিলেন। সেটি গত ৯ নভেম্বর হাইকোর্ট খারিজ করে দেন। রামগড় উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল কাদের দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, মৈত্রী সেতুর পাইলিং এর কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ উভয় পক্ষ দ্রুত স্থলবন্দর বাস্তবায়নের কাজ শুরু করায় ব্যবসায়ীসহ সব মহল আশার আলো দেখছে। এই স্থলবন্দর পূর্ণাঙ্গ চালু হলে স্থানীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে। দ্রুত ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রক্রিয়া চালুর দাবি জানিয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, স্থলবন্দরের প্রতিটি কার্যক্রমে রামগড়বাসীকে সম্পৃক্ত করা হলে উপজেলার অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হবে। শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী রামগড়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে স্থলবন্দর প্রভাব ফেলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। হতদরিদ্র থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মনে করছেন রামগড় স্থলবন্দরকে ঘিরে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পাহাড়ি এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনশিল্পেও নতুন গতি আসবে। সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত জানুয়ারি মাসে রামগড়ে এক জনসভায় বলেছেন, মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ফলে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনশিল্পের প্রসার এবং গোটা অঞ্চল উপকৃত হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, সর্বোপরি গোটা এলাকায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। তিনি ওই সময় আরো জানান, রামগড় স্থলবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সড়ক (রামগড়-বারৈয়ারহাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার) উন্নয়নের কাজ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা বাস্তবায়ন করবে। এ জন্য খরচ হবে তিন হাজার কোটি টাকা এবং সড়কটি চার লেনে উন্নীত হবে।
অন্যদিকে, ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪.৮ মিটার প্রস্থ সংযোগ সেতুটির নির্মাণ ভারত করবে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ১৫০ মিটার। খরচ হবে ১১০ কোটি রুপি। নির্মাণ সময় ধরা হয়েছে দুই বছর পাঁচ মাস। পাশাপাশি চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনার কথা হাটহাজারীতে গত জানুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। অন্যদিকে ত্রিপুরার আগরতলা থেকে সাবরুম পর্যন্ত রেললাইনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সড়কপথে রামগড়-চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার এবং সাবরুম-আগরতলা ১৩৩ কিলোমিটার।
জানা যায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল— এই সাত রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনশিল্প সম্প্রসারণে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার বহু আগেই রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর স্থাপনে উদ্যোগী হয়। এ জন্য ভারত সরকার ফেনী নদীর ওপর চার লেন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক মানের একটি সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। অবশ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভারত দীর্ঘ সময় ধরেই সচেষ্ট ছিল। এটা সম্ভব হওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন দুই দেশের ব্যবসায়ীরা।
ত্রিপুরার সাব্রুম প্রেসক্লাবের সভাপতি প্রতাপ বণিক মান্না বলেন, ভারত-বাংলাদেশের এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। জলবায়ু ও সংস্কৃতিরও মিলও রয়েছে। সেই সঙ্গে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ফেনী নদীতে এই মৈত্রী সেতু একটি মাইলফলক হবে। রামগড়ের স্থানীয় সাংবাদিক শ্যামল রুদ্র জানান, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু ও স্থলবন্দর দুদেশের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ। এটি বাস্তবায়িত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যটন শিল্পসহ সর্বোপরী যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমল পরিবর্তন আসবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন হবে। খাগড়াছড়ির সাবেক জেলা প্রশাসক মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, এর ফলে জেলার সাথে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলে যাচ্ছে। সূচিত হবে পার্বত্য অর্থনীতির নতুন যুগ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ