Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিশ্বপরিস্থিতি-সামগ্রিক মূল্যায়ন

ড. মু হা ম্ম দ সি দ্দি ক | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বর্তমান বিশ্বের সর্বশেষ পরিস্থিতির একটি মূল্যায়ন নিচে দেয়া হলো।
উত্তর কোরিয়া : উত্তর কোরিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকটা প্রশমিত হয়েছে উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়ার ভেতর যোগাযোগ স্থাপনের ভেতর দিয়ে। পৃথিবী একটি সাংঘাতিক এমনকি পারমাণবিক একটি সংঘর্ষ থেকে বেঁচে গেছে। এই প্রশমিত অবস্থা এখনই আর খারাপের দিকে নাও যেত পারে।
যুক্তরাষ্ট্র : উত্তর কোরিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নেতাও উগ্র ও বেপরোয়া মতির। তবে ট্রাম্পের সব কিছুই যে মন্দ এটা বলা ঠিক হবে না। ট্রাম্প নির্বাচনের আগে অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি বহির্বিশ্বে মার্কিন সামরিক সংস্পৃক্ততা হ্রাস করবেন। পরবর্তীতে তিনি তা করতে পারেন নাই। কেন পারেন নাই, তা এখন স্পষ্ট। সম্প্রতিক ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে সিরিয়া ও আফগাস্তিান থেকে তিনি মার্কিন সৈন্য সরাবেন। এ ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে-বিদেশে খ্রিষ্ট পাশ্চাত্যে, হৈ হৈ পড়ে গেল। এতে স্পষ্ট হলো যে পাশ্চাত্যে ক্রুসেডাররা এখনও শক্তিশালী। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ম্যাটিস প্রতিবাদ করে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। আইএস (ইসলামিক স্টেট) বিরোধী লড়াই যে মার্কিন বিশেষদূত ব্রেট ম্যাকওর্ক পদত্যাগ করলেন। এমনকি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ পর্যন্ত সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য অপসারণের বিরোধিতা করলেন। আসলে এসব নেতাদের বেশিরভাগই ভেড়ার চামড়ায় ঢাকা নেকড়ে। উল্লেখ্য, যে অতীতে মূল ক্রুসেডার বাহিনী বর্হিগত হয় ফ্রান্স ও জার্মানী থেকে। জেরুজালেমে হুমড়ি খাওয়ার আগে তারা ইউরোপে বসবসকারী ইহুদিদের হত্যা করে হাত পাকা করে নিত। হতভাগা ইহুদিদের তখন আশ্রয় দিতেন ওসমানী (অটোম্যান) সাম্রাজ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম সুলতান বাদশাহরা। এরও পূর্বে মুসলমান শাসকরা পশ্চিম ইউরোপে রাজত্ব সবার সময় সব ধর্মের জনগণকে মুসলমান ইহুদি খ্রিস্টানকে সমান চোখে দেখতেন। এর সাক্ষ্য এখনও যেমন পর্তগাল থেকে গ্রীস পর্যন্ত রয়ে গেছে নানানভাবে। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য এলাকা দখল করে বেইনসাফী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ষড়যন্ত্রমূলক সাইকস-পিকো গোপন চুক্তির মাধ্যমে আরবদের খিলাফতের লোভ দেখিয়ে নিজেরাই আরব ভূমি ভাগাভাগি করে নেয়। সিরিয়ার একটি বড় ভাগ প্রায় ফ্রান্স। ফরাসী জেনারেল দামাস্কাস দখল করে গাজী সালাউদ্দীনের কবরে লাথি মেরে বলে, “সালাউদ্দীন আমরা ফিরে এসেছি।” মুসলমানদের এই বেইজ্জতিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয় আরব নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। সেই থেকে আরবরা পাশ্চাত্যের। ‘হুয়িপিং বয়’ (বলির পাঠা?)। আরবরা তাদের প্রকৃত সম্মান আর ফিরে পায়নি, দালালি করা ছাড়া।
সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে তুরস্ক ও রাশিয়া। তুরস্ক বলেছে যে, তারাই যথেষ্ট আইএসকে দমন করতে। আইএস ইসলামের কথা বললেও তাদের নীতি ও কৌশল ইসলামের সঙ্গে কমই সঙ্গতিপূর্ণ। পররাষ্ট্রনীতিও তারা বোঝে বলে মনে হয় না। কোনো মুসলমান রাষ্ট্রকে তারা বন্ধু বানাতে পারে নাই। অথচ বহু প্রমাণ এসেছে যে প্রথম দিকে ইসরাইল ও সিআইএ তাদের সাহায্য করেছে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। ইসরাইলের শয়তানি কৌশল ছিল ‘কইয়ের তেলে কই মাছ ভাজা’। মুসলমানদের নিজেদের ভেতর কোন্দলে ব্যস্ত দেখে ইহুদি মতলব হাসিল করা। আইএসের সঙ্গে জড়িত সাধারণ মুসলমানরা এই ইহুদি কৌশল বুঝতে পারেনি। উল্লেখ্য যে, আইএস মুসলিম বিশ্বে বহু ঘটনা ঘটালেও ইসরাইলে একটা বোমাও ফাটায়নি।
ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরাতে চান। তারাও বাধা দিচ্ছে পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টীয় উগ্রবাদী যুদ্ধবাজরা। সতর বছর ধরে যুদ্ধ চালাচ্ছে পাশ্চত্য, আর সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণকালটা ধরলে তো প্রায় ত্রিশ বছর ধরে দূর পাশ্চত্য ও নিকট পাশ্চত্য (রাশিয়া) আফগানিস্তানে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনো দেশ হলে আফগানিস্তান বিলীন হয়ে যেত। পাশ্চাত্যে দু’চারজন নিহত হলে হৈ হৈ রব উঠে, অথচ প্রাচ্যে লাখ লাখ লোক নিহত হচ্ছে বছরের পর বছর অথচ একফোঁটা পানি পড়ে না তাদের চোখ থেকে। আফগানরা তাদের মতো থাকতে চায়। এটাতে বাধা দেয়ার কি আছে? যে সরকারকে স্থানীয় জনগণ চায় না, তাকে রক্ষা করতে এত লোকের জান দিতে হবে কেন? এটা তো মানবাধিকার হল না। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হয়েছে, এখন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে। শোনা যায়, রাশিয়া-চীনও নাকি স্থানীয় আফগানদের পেছনে রয়েছে। রাশিয়া তার সম্মান পুনরুদ্ধার করতেই পারে। রাশিয়া আফগানিস্তানে মার্কিন নীতির পূর্ণ সমর্থক নয়। আফগানিস্তানে নতুন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মার্কিন আফগান নীতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। ইমরান নিজেও পাঠান। পাকিস্তান বলে যে মার্কিন নীতির সমর্থন করতে গিয়ে পাকিস্তানের পঁচাত্তর হাজার মানুষ ও সৈনিক নিহত হয়েছে, অর্থনীতিরও ক্ষতি হয়েছে এবং সন্ত্রাসকবলিত হয়েছে। পাকিস্তান আর আফগান যুদ্ধে জড়িত থাকতে চায় না, তারা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়া ও আফগানিস্তানে বাস্তববাদী হতে চাইলেও তিনি সামগ্রিকভাবে মুসলিম নীতি প্রদর্শনে উৎসুক নন। এ ব্যাপারে তার ইহুদি জামাই কুশনারের কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ। জেরুজালেমকে ইসরাইলী রাজধানীর মান্যতা দেয়া হল। ইহুদি পরামর্শে ইরান-বিরাধী কঠোরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইরানবিরোধী নিষেধাজ্ঞা রেড়েছে।
ইসরাইল : মুসলিম অনৈক্য ইসরাইলের হাতে আরব হত্যার হিড়িক পড়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ ইহুদি মাতার পুত্র মিশরীয় প্রেসিডেন্ট সিসি ও অনির্বাচিত সউদী যুবরাজ বিন সালমানের কার্যক্রম। সউদী কর্তৃক ভিন্নমত পোষণকারী খাশোগী হত্যা আরব ও মুসলমান সম্পর্কে খারাপ ‘মেসেজ’ দিয়েছে। ইসলামের একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের নীতি যদি এ রকমের হয়, তাহলে মুসলমানদের লজ্জার সীমা থাকে না।
সউদী আরব-কাতার : কাতার সউদী ষড়যন্ত্র থেকে কোনভাবে রক্ষা পেলেও তার নিজেরও সমস্যা রয়েছে। কাতার মধ্যপ্রাচ্যে তথা পারস্য উপসাগরে বিরাট মার্কিন ঘাঁটির আবাসস্থল। নিকটেই ইরান। কাতার কোন দিকে যাবে?
সউদী আরব তার ‘ইমেজ’ উদ্ধারে হালে মক্কাভিত্তিক ওয়ার্ল্ড মুসলিম লীগের মাধ্যমে ১২৭ দেশের ১২৯৯ জন ধর্মীয় ও একাডেমিক ব্যক্তিত্বের কয়েকদিন সঙ্গী সমাবেশ করল। অন্যতম এজেন্ডা ছিল মুসলিম ঐক্য। তবে অনুষ্ঠানে ইরানের কোনো কণ্ঠস্বর শোনা গেল না। ইসরাইল চায় আরব ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ এই অনৈক্য দূর না হলে কিভাবে মুসলিম ঐক্য হবে?
মিয়ানমার : মিয়ানমার-চীন-ইন্ডিয়ার মুসলিম নীতি একটি স্থানে একই উদ্দেশ্যে মিলিত হয়েছে। এর প্রথম বলি রোহিঙ্গা মুসলমান, দ্বিতীয় বলি আমাদের বাঙলাভাষী মুসলমান। রোহিঙ্গাদের বাঙালী অপবাদ দিয়ে, বিতাড়ন করা হচ্ছে। আসামের মুসলমানেরও সেই একই অপরাধ। অথচ বাংলাদেশ পৃথিবীর সব বাঙালীর রাষ্ট্র নয়। এখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদই সঠিক নীতি। এখানে বাস করা বাঙলী, চাকমা, সাত্ততাল, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সবাই বাংলাদেশী- সবাই বাঙালী নয়। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দেখা যাচ্ছে না। মিয়ানমার চীন ও ইন্ডিয়া সবারই গাছাড়া মনোভাব। রোহিঙ্গাদের তাহলে আপাতত, পার্বত্য চট্টগ্রামের পতিত জমিতে বসবাসের অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
চীন : মার্কিন বেইনসাফীর জন্য চীনের ওপর মুসলিম বিশ্ব কিছুটা আস্থা রেখেছিল। কিন্তু চীনা নীতির কিছু অংশ মুসলমানদের কিছু আশা ভঙ্গ হয়েছে দেশে-বিদেশে। চীনা উইঘুর মুসলমানদের ওপর জুলুম হচ্ছে। চীনের রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি চীনা মুসলিম ও তিব্বতী বৌদ্ধদের নিয়ে। তাই এসব নিয়ে সে গোপন অবস্থান নিতে পারে ইন্ডিয়া ও মিয়ানমারের সাথে। চীন ও ইন্ডিয়া উভয়ই আরকানে অর্থনৈতিক অবস্থানে উদ্গীব যেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাস। বাংলাদেশ চীনকে সম্পূর্ণ পাবে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও সম্পর্কটা ধরে রাখতে হবে। এদিকে বিকল্প ও খুঁজতে হবে। তবে চীন কখনই পাকিস্তানকে কৌশলগত কারণে ছাড়বে না, নিজ দেশে ও মিয়ানমারের মুসলিমদের ওপর বেইনসাফী নীতি গ্রহণ করলেও। এদিকে রাশিয়াও চীনকে ছাড়বে না।
রাশিয়া : সাধারণ ভাষা ও সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে, সেই ইউক্রেনের ভূমি দখল করছে। আরও কিছু প্রতিবেশীর এমনি এলাকা তার কুনজরে। তবে রাশিয়া তার প্রতিবেশী চীন, ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছে মার্কিন ভুলনীতির কারণে।
ইন্ডিয়া : বিজেপিবিরোধী দলগুলো এক হওয়াতে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। তবে বিজেপি যেভাবে হিন্দুত্ববাদী ধর্মীর আদর্শকে ইন্ডিয়ার হিন্দু জনগণের ভেতর ছড়িয়েছে তার প্রভাব থেকেই যাবে। সমাজে উদারতা আনতে অন্যান্য দলসমূহকে কৌশলী হতে হবে।
লেখক: আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি-গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নববর্ষ সংখ্যা

১ জানুয়ারি, ২০১৯
১ জানুয়ারি, ২০১৯
১ জানুয়ারি, ২০১৯
১ জানুয়ারি, ২০১৯
১ জানুয়ারি, ২০১৯
১ জানুয়ারি, ২০১৯
১ জানুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন