Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আত্মীয়তার বন্ধনে আয়ু ও রিজিক বৃদ্ধি

আতিকুর রহমান নগরী | প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ইনকাম সোর্স বাড়নোর পরই কমছেনা সাংসারিক খরচাপাতির টানাপোড়েন। আর নানা প্রকারের চেনা-অচেনা রোগ-বালাইয়ের সম্মুখিন হয়ে শয্যাশায়ী হচ্ছি আমরা। তারপর জীবনের বাতি নিভে যায় নিমিষেই। অনেক আত্মীয়-স্বজনকে কাছ থেকে আর দেখা হলোনা। তাদের সাথে খুশমেজাযে গল্প করার ফুসরত পেলামনা। 

নেক হায়াত আর বরকতময় রিজিক যে মহান আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্য কতো বড় নেয়ামত তা আমরা একেবারে ভুলে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন, পরিজনের আগমনকে কালো চশমায় দেখি। মনের ভেতর শয়তান ওসওসা দেয় সম্পদ কমে যাবার। স্টোর রুমে সংরক্ষিত সপ্তাহিক কিংবা মাসিক বাজারে ঘাটতির ভয় হয়।
যুগ ডিজিটাল হচ্ছে। প্রযুক্তির নিত্য নতুন আবিষ্কারে আমাদের জীবন ভাসছে। সামাজিক আচার অনুষ্টানে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে গ্রামের বাড়ি কিংবা স্বজন-বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতের চেয়ে ঘরে বসে টিভি কিংবা ইন্টারনেটে সময় কাটাতে ভালোবাসেন অনেকেই। এতে শেকড়ের সঙ্গে প্রন্মের বন্ধন দিনদিন যেমন দুর্বল হয়, তেমনি করে তা সামাজিক ক্ষেত্রেও মানুষকে বদলে দিতে সক্ষম হয়। ইট-কংক্রিটের খাঁচায় আবদ্ধ আমাদের নগরজীবন এভাবেই দিনদিন মায়া-মমতাহীন রুক্ষ ও অস্থির হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়তার বন্ধন থেকে আমাদের এমন দূরে সরে যাওয়া সমাজ-সংস্কৃতি তো বটেই, ইসলামের দৃষ্টিতেও নিন্দনীয়। স্বয়ং আল্লাহ প্রাক সূরা নিসার প্রথম আয়াতে আমাদের আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। সূরা ইসরার ২৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ প্রাক আদেশ করেছেন, তোমরা নিকটাত্মীয়দের হক আদায় করো।
সমাজের সবার সঙ্গে মেলামেশা, বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও তাদের সঙ্গে মায়া-মমতা, ভালবাসা আর স¤প্র্রীতির সম্পর্ক চর্চার ক্ষেত্রে নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অপূর্ব ও অতুলনীয়। তিনি নিজে যেমন এব্যাপারে সদা যত্মবান ছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে তাঁর সাহাবিদেরও এব্যাপ্রারে নিয়মিত তাগিদ ও
উৎসাহ দিতেন। বুখারি শরীফের বর্ণনায় হজরত আনাস রা. বলেন, রাসুল সাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেউ যদি চায় যে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং মৃত্যুর পরও তার সুখ্যাতি স্থায়ী হোক, তবে সে যেন তার আত্মীয়দের
সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আত্মীয়তার বন্ধন:
আত্মীয়তার সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে মানবজাতির হেদায়তগ্রন্থ প্রবিত্র কুরআন এবং নবিয়ে করিম সা.’র প্রবিত্র বাণি হাদিস শরিফ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গিকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদেরই জন্য রয়েছে অভিশপ্ত এবং তাদেরই জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস' (সুরা রা'দ/২৫)। মহানবী সা. বলেন, 'তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখো'। (সহীহুল জামে/১০৮)। তিনি আরো বলেন, 'তোমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক আর্দ্র রাখ, যদিও তা সালাম দিয়ে হয়'। (সহীহুল জা'মে/২৮৩৮)।
মানুষ সামাজীক জীব। আত্মীয়তা ছাড়া বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর। যে লোকের সাথে তার আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজনদের সম্পর্ক ভালো নেই তাকে আমরা অনায়াসেই একজন দুঃখী মানুষ বলে চিহ্নিত করতে পারি। সে যতই বড়লোক হোক বা বাইরে থেকে যতই সুখী মনে হোক। একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে, আত্মীয়দের সাথে যতই ঝগড়া, রাগ করুক না কেন একসময় মানুষ তার ভুল বুঝতে প্রারে। বুঝতে পারে 'আপনে তো আপনে হোতে হে'। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাতে সুখ তো আছেই তার সাথে আছে আয়ুবৃদ্ধি এবং রোজিতে বরকত। নবী সা. বলেন, 'যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার রোজি প্রশস্ত হোক এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে' (বুখারী/মুসলীম)। যে সব প্রাপ্র বা গোনাহের শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দেন তার মধ্যে আত্মীয়তার সম্পুর্ক ছিন্ন করাও অন্যতম। আল্লাহর রাসুল সা. বলেন, 'জুলুমবাজী ও (রক্তের) আত্মীয়তা ছিন্ন করা ছাড়া এমন উপযুক্ত আর কোন পাপাচার নেই যার শাস্তি পাপাচারীর জন্য দুনিয়াতেই আল্লাহ অবিলম্বে প্রদান করেন এবং সে সাথে আখেরাতের জন্যও জমা করে রাখেন'। (আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ/৪২১১, হাকেম, সহীহুল জা'মে/৫৭০৪)। তিনি আরো বলেন, 'আল্লাহর আনুগত্য করা হয় এমন আমলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি যে আমলের সওয়াব পাওয়া যায় তা হল আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা। আর যে বদ আমলের শাস্তি সত্বর দেয়া হয়, তা হল বিদ্রোহ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছেদন করা' (বাইহাকী, সহীহুল জা'মে/৫৩৯১)। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবেনা। নবী সা. বলেন, 'ছিন্নকারী জান্নাতে যাবেনা'। (বুখারী/৫৯৮৪; মুসলিম/২৫৫৬, তিরমিযী)
এবং যারা বজায় রাখে ঐ সম্পর্ক, যা বজায় রাখতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন এবং স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করে এবং কঠোর হিসেবের আশঙ্কা রাখে। (সুরা রাদ ১৩:২১। এবং যারা স্বীয় পালনকর্তার সন্তুষ্টির জন্যে সবর করে, নামায প্রতিষ্টা করে আর আমি তাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা মন্দের বিপরীতে ভাল করে, তাদের জন্যে রয়েছে পরকালের শান্তির নিবাস। (সুরা রাদ ১৩:২২)। রাসূলুল্লাহ সা.বলেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জুবাইর ইব্নে মুত্ইম রা.থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি রাসুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারী শরিফ: অধ্যায় আচার ব্যবহার নং ৫৫৫৮)।
আল্লাহর অঙ্গীকারকে দৃঢ় ও পাকা-পোক্ত করার পর তা ভঙ্গ করে। তার জন্য আল্লাহতাআলা কঠিন আযাব ও অভিসপ্ত করেছেন যারা এ সম্পর্ক অটুট রাখে না এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে। এবং যারা আল্লাহর অঙ্গীকারকে দৃঢ় ও পাকা-পোক্ত করার পর তা ভঙ্গ করে, আলাহ্ যে, সম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, ওরা ঐ সমস্ত লোক যাদের জন্যে রয়েছে অভিশপ্ত এবং ওদের জন্যে রয়েছে কঠিন আযাব। (সুরা রাদ ১৩:২৫)
আল্লাহতাআলা বলেন তারাই মুমিন, যারা সন্দেহ পোষণ করে না। তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ। (সূরা আল হুজরাত ৪৯:১৫)। আল-াহতালা বলেছেন রাসূলুল্লাহ সা. হুকুম মান্য করাই আল্লাহরই হুকুম মান্য করা ।
যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আলল্লাহর ই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপ্রনাকে (হে মুহাম্মদ),তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি। (সূরা আন নিসা ৪:৮০)।
আত্মীয়তার হক রাহমানের মূল:
রাসুলল্লাহ সা.বলেছেন যে, আত্মীয়তার হক রাহমানের মূল। আল্লাহতাআলা বলেছেন, আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত: রাসুলল্লাহ সা. বলেছেন, আত্মীয়তার হক রাহমানের মূল। আল্লাহতাআলা বলেছেন, যে তা সজ্জীবিত রাখবে আমি তাকে সজ্জিবিত রাখবো। আর যে তা ছিন্ন করবে, আমি তাকে ছিন্ন করবো। (বুখারী শরিফ: অধ্যায় আচার ব্যবহার নং ৫৫৬৩)।
রিযিক প্র্রশস্তিকরণে আত্মীয়তার সম্পর্ক: রাসুলল্লাহ সা. বলেছেন রিযিক প্রশস্ত আয়ু বৃদ্ধি যে চায় সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখে। আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত: রাসুলল্লাহ সা.বলেছেন, যে ব্যক্তি চায় যে তার রিযিক প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখে। (বুখারী শরিফ:অধ্যায় আচার ব্যবহার নং ৫৫৬০)।
আসুন, আমরা সবাই আত্মীয়তার বন্ধনকে দৃঢ় রাখার মধ্যদিয়ে সুন্দর ও সমৃদ্ধির সমাজ গঠনে ঐক্যবদ্ধ হই।



 

Show all comments
  • Azizul ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ৮:৪৬ এএম says : 0
    Is very very good
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ