Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

থামছে না শ্রমিক বিক্ষোভ

আশুলিয়া ও টঙ্গীতে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও জলকামান ব্যবহার, ২০টি যানবাহন ভাঙচুর  ছাত্রলীগ এলো, সড়ক ছাড়ল পোশাক শ্রমিকরা  পর্যালোচনা কমিটির জরুরি বৈঠক। মিরপুরসহ বিভ

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বেতন কাঠামোতে বৈষম্য দূর করাসহ বিভিন্ন দাবিতে ষষ্ঠ দিনের মতো গতকালও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা। শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর মিরপুর, শেওড়াপাড়া, বাংলা কলেজের সামনের সড়ক, টোলারবাগ এবং সাভার, আশুলিয়া-টঙ্গীর বিভিন্ন সড়কে নেমে পোশাক শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। এতে বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে এরই মধ্যে সাভার, টঙ্গী, গাজীপুর ও রাজধানীর শতাধিক গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিক পক্ষ। দুপুরের পর শ্রমিকরা উঠে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সূত্র জানায়, শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ ও ভাঙচুরের চেষ্টা করলে তাদের পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সকালে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এসব সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গতকাল গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগড়া, কোনাবাড়ী, মোগরখাল এলাকাসহ আশপাশের এলাকার অন্তত ২০টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশ জলকামান ব্যবহার ও লাটিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাভারে বিভিন্ন পোশাক কারখানার সামনে টহল দিচ্ছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মাঠে রয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ন্যূনতম বেতন বাস্তবায়ন ও বৈষম্য দূর করার দাবিতে মিরপুর ১৪ নম্বর সড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজের সামনে ও টোলারবাগেও সকালে বিক্ষোভ করেছে শ্রমিকরা। তারা রাস্তা অবরোধ করে ও বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন। বাংলা কলেজের সামনের সড়কে একটি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেটকার ভাঙচুর করেছে শ্রমিকরা। সোহেল রানা নামে একজন পথচারী বলেন, দারুস সালাম-মিরপুর সড়ক বন্ধ থাকায় যানজট চরম আকার ধারণ করে। এ কারণে যানজট ছড়িয়ে পড়ে শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, আসাদ গেট, ফার্মগেট, বিজয় স্মরণী হয়ে, আগারগাঁও সড়ক পর্যন্ত। ট্রাফিক পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে যানজট ছাড়াতে।
ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন বলেন, শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কিছু সড়কে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
দক্ষিণ খান ও উত্তর খান থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসব এলাকায় শ্রমিকরা গতকাল রাস্তায় বিক্ষোভ না করলেও বেশ কয়েকটি কারখানার কাজ বন্ধ রয়েছে। ভাষানটেকের তামান্না গার্মেন্টসের শ্রমিকরা সকালে সড়কে নেমে বিক্ষোভ করে। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর শ্রমিকরা রাস্তার অবরোধ তুলে নেয়।
ভাষানটেক থানার ওসি মুন্সি সাব্বির আহমেদ বলেন, শ্রমিকরা রাস্তা বন্ধ করার চেষ্টা করে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। শ্রমিকরা বেশি সময় রাস্তায় ছিল না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ছাত্রলীগ এলো, সড়ক ছাড়ল পোশাক শ্রমিকরা
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর এশিয়া সিনেমা হলের কাছে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে ওই এলাকায় কয়েকটি কারখানার পোশাক শ্রমিকরা। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধ দুই ঘণ্টা হওয়ার পরও সেখানে মালিক সংগঠন কিংবা পুলিশের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা ছিল না। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাংলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা সড়কে অবস্থান নিতে যায়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতারা পোশাক শ্রমিকদের মুখোমুখি হওয়ার পর ধাক্কাধাক্কিও হয় সেখানে। পরে দুপুর ১টার দিকে টেকনিক্যাল মোড় থেকে সরে দাঁড়ায় শ্রমিকরা। এতে ওই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়। বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সহ-সভাপতি নাছির নঈম মুহিম, সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ্দাম, সহ-সম্পাদক লাবু, সদস্য মানিক চৌধুরীসহ ছাত্রলীগের ৪০-৫০ জন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে জানান, আশুলিয়ায় টানা ষষ্ঠ দিনের মতো শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল আশুলিয়ার বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর মহাসড়কের জামগড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
শ্রমিকরা জানায়, শনিবার বেলা ১১টার দিকে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকাসহ আশপাশের প্রায় ১৫টি কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়কে নেমে আসে। পরে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে চলমান প্রায় ১০টি যানবাহনের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর চালায়। এতে বিভিন্ন গাড়িতে থাকা প্রায় পাঁচ যাত্রী আহত হন। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ করে ইট পাটকেল ছুড়লে পুলিশ শ্রমিকদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে। পরে টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও জলকামান ব্যবহার করে শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সংঘর্ষের সময় ১০ শ্রমিক আহত হয়।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশের এসপি সানা সামিনুর রহমান বলেন, আশুলিয়া জামগড়া এলাকাসহ আশপাশের প্রায় ২০টি কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়কে নেমে এসে যানবাহনে ভাঙচুর ও অবরোধ করে রাখে। এ সময় তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে জলকামান ব্যবহার করা হয়। পরে দুপুরের দিকে পরিস্থিতি স্বাবাভিক হলে যান চলাচল শুরু হয় বলে তিনি জানান।
গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা সড়কে নেমে এলে কয়েক দফা পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ ও আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানায়, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবির আন্দোলনে শনিবার সকালে গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার টার্গেট ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-গাজীপুর সড়ক অবরোধের চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে লাঠিপেটা করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। এ ছাড়া মোগরখাল এলাকায় বিসিএল কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিলে তাদের সঙ্গে মালিক পক্ষের লোকজনের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। নগরের কোনাবাড়ী বিসিক এলাকায় কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ সৃষ্টি করতে চাইলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগড়া, কোনাবাড়ী, মোগরখাল এলাকাসহ আশপাশের এলাকার অন্তত ২০টি কারখানা ছুটি দেয়া হয়। গাজীপুরের শিল্প এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
পর্যালোচনা কমিটির জরুরি বৈঠক
পোশাক শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য নিরসনে পর্যালোচনা কমিটি শনিবার শ্রম মন্ত্রণালয়ে জরুরি সভা করেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কমিটির আহ্বায়ক আফরোজা খানের সভাপতিত্বে বেলা আড়াইটায় শুরু হয়ে এ সভা চলে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। পোশাক কারখানার মালিক-শ্রমিক ও সরকার ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠকে শনাক্ত করা সমস্যাগুলো নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সভায় শ্রমিকদের ‘পর্যালোচনা কমিটি’র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক আফরোজা খান। শনিবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিনুল হক। তিনি বলেন, বৈঠকে শ্রমিকদের পর্যালোচনা কমিটির ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক আফরোজা খান। জরুরি এই বৈঠকে সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। উল্লেখ্য, বেতন কাঠামোতে বৈষম্য দূর করাসহ বিভিন্ন দাবিতে ৬ জানুয়ারি থেকে আন্দোলন করছে পোশাক শ্রমিকরা। শ্রমিক বিক্ষোভ নিরসনে গত ৮ জানুয়ারি শ্রমভবনে পোশাক শ্রমিক-মালিক ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, গত ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া পোশাক শ্রমিকদের বেতন কাঠামোতে কোনো বৈষম্য বা অসঙ্গতি থেকে থাকলে চলতি জানুয়ারি মাসের মধ্যেই তা সংশোধন করা হবে। ফেব্রুয়ারিতে সংশোধিত গ্রেডিংয়েই বেতন পাবে শ্রমিকরা। বৈঠকে এ সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ কমিটিতে গার্মেন্টস মালিকদের পাঁচজন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের পাঁচজন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব থাকবেন। ওই কমিটি চলতি মাসের মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের জন্য সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামোর কোনো গ্রেডের মধ্যে অসঙ্গতি থাকলে তা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন জমা দেবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পোশাক শিল্প


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ