Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করতে হবে

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯, ২:০২ এএম

পবিত্র কোরআন ও হাদিসে মুসলিম উম্মাহকে মানব সমাজে ‘শ্রেষ্ঠ উম্মাহ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই জাতির যেসব শ্রেষ্ঠ গুণ রয়েছে অথবা তাকে যেসব গুণের অধিকারী করা হয়েছে সেগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে সত্য ও ন্যায় পরায়ণতা। এই সত্যের বিপরীত মন্দদিকটি হচ্ছে মিথ্যা প্রবণতা ও অন্যায়ের অনুসরণ। হক ও বাতিল বা ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য-মিথ্যা কখনো এক সাথে চলতে পারে না। সত্যপরায়ণতা যেমন একটি উন্নতর চারিত্রিক গুণ, তেমনি মিথ্যা একটি ঘৃণ্যতম মন্দ চারিত্রিক দোষ। সত্য প্রচারের আবশ্যকতা সম্পর্কে কালাম মজিদে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে একটি মÐলী এরূপ থাকা বিশেষ আবশ্যক, যারা আহবান করতে থাকবে কল্যাণের পানে এবং যারা সঙ্গতের জন্য আদেশ দিতে ও অসঙ্গত হতে বারিত করতে থাকবে। বস্তুতঃ এই যে, লোক সমাজে সফলকাম হতে পারবে এরাই’ (সুরা আলে এমরান আয়াত ১০৩)। মানুষকে কল্যাণের দিকে ডেকে আনা, তাদের সৎকর্মে প্রবৃত্ত ও অসৎ কর্ম হতে নিবৃত্ত করার জন্য একটি উম্মতের একান্ত আবশ্যক। এই উম্মত বা প্রচারকমÐলীর পরিচয় অপর আয়াতে দেওয়া হয়েছে। ‘তোমরা হচ্ছ শ্রেষ্ঠতম উম্মত যাদেরকে আভির্ভূত করা হয়েছে বিশ^ মানবের হিতকল্পে তোমরা সঙ্গতের আদেশ দান করতে, অসঙ্গত হতে নিষেধ করতে থাকবে। বস্তুতঃ আহলে কেতাবগণ ঈমান আনলে তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক হত। তাদের মধ্যে কতেক লোক হচ্ছে মোমিন আর তাদের অধিকাংশই অনাচারী’ [ ফাসেক ] ঐ আয়াত- ১০৯)। এই আয়াতে শ্রেষ্ঠতম উম্মতের দুইটি প্রধান কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। সত্য ও সঙ্গত যা কিছু, তা যাতে সর্বতোভাবে জয়যুক্ত হয়- উপদেশে, প্রচারে-আলোচনায় তার যথাসাধ্য চেষ্টা করা এবং অসত্য ও অসংগত যা কিছু, মানব সমাজকে তা হতে বিরত রাখার যথাসম্ভব প্রয়াস পাওয়া। এই দুইটি সাধনা হবে উম্মত হিসেবে তাদের প্রধান কর্তব্য। এই দুইটি দায়িত্ব পালনের সময় এই উম্মতগণ নিজেদের মন ও মস্তিষ্ককে পরিপূর্ণ করে রাখবে এটাও সঙ্গে সঙ্গে বলে দেওয়া হয়েছে। আদেশ-নিষেধ প্রচারে কর্তব্য পালন করতে যারা যাবে, তারা নিজেরাই যদি আল্লাহতে সত্যিকারভাবে বিশ^াসী না হয় অথবা অসত্য ও সঙ্গত সংস্কার দ্বারা সেই ঈমানকে আড়ষ্ট ও অবসন্ন করে ফেলে তা হলে এই গুরুতর কর্তব্য পালন করা তাদের পক্ষে কখনই সম্ভবপর হবে না। আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন, ‘সকলে তারা সমান নয়, আহলে কিতাব (কেতাবধারীদের মধ্যে) এরূপ একটি ন্যায়নিষ্টমÐলী আছে, যারা আল্লাহর আয়াতগুলির আবৃত্তি করতে থাকে। রাত্রে আল্লাহতা’আলার নিদর্শন সকল ও তারা সেজদা করতে থাকে। তারা বিশেষ করে আল্লাহতে তার পরবর্তী দিন আর সঙ্গতের আদেশ দান ও অসঙ্গত হতে নিষেধ করে থাকে এবং সমস্ত সৎকর্মেই তারা দ্রæত তৎপর হয়, বস্তুত: এরা হচ্ছে সাধুসজ্জনগণের অন্তর্গত’ (আয়াত ১১২-১১৩)।
জগতের বুকে সত্যের সহায়তা ও ন্যায়ের সংগ্রাম করার আবশ্যকতা কোরআনের উদ্ধৃত আয়াত হতে বুঝা যাচ্ছে। এ সম্বন্ধে হজরত রাসুলে করিমের পবিত্র হাদিসেও ঘোষণা করা হয়েছে যে, ইসলাম ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করার নির্দেশ দান করেছে। হুজুর (সা.) বলেছেন, আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করে কোনো মানুষের হুকুম মানা চলবে না। (নাওয়াছ ইবনে ছোমআন কর্তৃক বর্ণিত, হজরত আব্দুল্লাহ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসে হুজুর (সা.) বলেছেন, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত (অপরাধের) দÐ বন্ধ করার জন্য যে ব্যক্তি অনুরোধ করে সে আল্লাহর সঙ্গেই বিরোধ করে। যে ব্যক্তি জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা অন্যায়ের পক্ষে সমর্থন করে, এই কাজ থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত সে আল্লাহর অভিশাপে পরিবেষ্টিত থাকে। আর যে ব্যক্তি কোনো মোমিনের প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করে তওবা না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের মধ্যে শামিল করে রাখেন। (আদুল মোফরাদ) হজরত আলী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, হুকুমদাতা যে কেউই হোক না কেন কোনো পাপকার্যে হুকুম করলে তা মানতে হবে না বরং শুধু সৎকার্যের আদেশই মেনে চলবে। হজরত আবু সাঈদ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে হুজুর (সা.) বলেছেন, অত্যাচারী জালেম শাসকের সামনে সত্য কথা বলাই সর্বোত্তম জেহাদ। অন্যায়ের প্রতিবাদ সম্বন্ধে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আমরা আল্লাহর রাসূলের হাতে বায়আত (শপথ গ্রহণ) করেছি যে সুখে-দুঃখে; সুবিধা-অসুবিধায় আমরা তার হুকুম মেনে চলব। যে ব্যক্তি যে কাজের উপযুক্ত বা যে ব্যক্তির যা প্রাপ্য সে ব্যাপারে আমরা অনর্থক ঝগড়া বিবাদ করে অশান্তি সৃষ্টি করব না। আমরা যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি, ন্যায় ও সত্য কথা বলতে কোনো নিন্দুকের নিন্দায় ভয় করব না। আল্লাহর প্রদত্ত দলিল উপস্থিত থাকতে যদি তার কোনো অমর্যাদা বা কুফরি দেখি সরলভাবে তার প্রতিবাদ করব। হুজুর (সা.) আরও বলেছেন, অন্যায়-অনাচার এবং নাহক বিদ্রোহের দিকে যারা মানুষকে ডাকে তার জন্য সংগ্রাম করে এবং তার উপরই যাদের মৃত্যু হয় তারা আমার উম্মতের শ্রেণিভুক্ত নয়। (হজরত জোবইরে ইবনে মোতামেন কর্তৃক বর্ণিত) ন্যায় ও সত্য কথা বলতে ইসলাম ও তার শিক্ষাকেই বুঝাচ্ছে। হজরত আবু মুসা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মহানবী হজরত রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, লোকদের ইসলামের দিকে আহবান কর এবং তাদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর। সাবধান। তাদের অন্তরে (ইসলামের প্রতি) ভীতি ও ঘৃণার সৃষ্টি করো না। (কানজুল উম্মাল)। হুজুর (সা.) বলেছেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুইটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তা অবলম্বন করতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। প্রথমটি হচ্ছে কোরআন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে হাদিস। (মেশকাত) মজলুম, অত্যাচারিত ব্যক্তির অভিশাপ হতে বেঁচে থাকার এবং তার সাহায্য করার জন্য হুজুর (সা.) স্পষ্ট আদেশ করেছেন, তিনি হজরত মাআজ ইবনে জাবালকে ইয়ামনের শাসনকর্তারূপে প্রেরণের সময় এরশাদ করেন, মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা মজলুম ও আল্লাহর মধ্যবর্তিতায় কোনো অন্তরায় থাকে না। মজলুমের আহাজারি বিনা প্রতিবন্ধকতায় আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। হজরত বারা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, হুজুর (সা.) আমাদেরকে সাতটি জিনিসের হুকুম দিয়েছেন: (১) জানাজার সঙ্গে যাওয়া, (২) রোগীর কাছে গিয়ে তার খবরগিরি করা, (৩) দাওয়াত কবুল করা, (৪) মজলুমের সাহায্য করা, (৫) কসম (শপথ) পূরণ করা, (৬) সালামের উত্তর দেওয়া এবং (৭) হাঁচি দানকারীর উত্তর দেওয়া। অর্থাৎ কেউ হাঁচি দিলে ‘এয়ার হামুকুল্লাহ’ বলা। মোট কথা, এই যে, ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম ও সত্যের সহায়তা এবং অসত্যের প্রতিবাদ জ্ঞাপনের আদেশ বারংবার দেওয়া হয়েছে। বর্ণিত হাদিসগুলি হতে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ধর্মে সত্য কথা গোপনকারীকে বোবা শয়তানের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ সম্বন্ধে হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, আসসুকুতু আনিল হক্কে শয়তানু আখরাছু। অর্থাৎ সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে নীরবতা অবলম্বন করে সে বোবা শয়তান। জেনে-শুনে যারা সত্য গোপন করে অথবা সত্য প্রকাশ-প্রচারে নীরবতা অবলম্বন করে, হাদিসের ভাষায় তারা বোবা শয়তান। সরব শয়তান আর নীরব শয়তানের মধ্যে পার্থক্যের রেখা টানা গেলেও শয়তানী স্বভাবের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। সবাই সত্য প্রচার করলে, সত্য প্রচারে অভ্যস্ত হলে, অসত্য কখনো টিকে থাকতে পারে না। তবে সাময়িকভাবে সত্যকে গোপন রাখা সম্ভব হলেও চিরকাল তা গোপন থাকে না, কোনো না কোনো দিন অসত্য ফাঁস হয়ে যাবেই। কেননা সত্যের কাছে অসত্যের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। ইসলামের মূল্যবোধ দ্বারা মানব চরিত্রকে সুশোভিত করার মধ্যে নিহিত রয়েছে অফুরন্ত কল্যাণ। সমাজে কোনো খারাপ, মন্দ কাজ পরিলক্ষিত হলে তা শক্তিবলে প্রতিহত করা, কিংবা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মন্দ দিকগুলি বুঝিয়ে দিয়ে তা রোধ করার শান্তিপূর্ণ পথ অনুসরণ করা ইসলামের শিক্ষা। যদি এসব কিছুতেই ধর্ম ও সত্য বিরোধী কাজ প্রতিহত করা সম্ভব না হয় তা হলে সে কাজের প্রতি মনে মনে হলেও ঘৃণা প্রকাশ করার কথা ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে। এই দায়িত্বগুলি সকলকেই পালন করতে হবে। অর্থাৎ সমাজের সচেতন ও কর্তব্যপরায়ন ব্যক্তিবর্গের উচিত হবে, অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সমাজ ও জাতীয় জীবন থেকে ঐসব গর্হিত কাজের মূলোৎপাটন করা। যারা এসব পালনে ব্যর্থ হবে আল্লাহর নিকট তাদের অবশ্যই জবাবদিহি হতে হবে। কেননা, অন্যায়-অনাচার ও অপরাধ দেখেও কর্তব্যপরায়ন ব্যক্তি বা মহল যদি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তাহলে তাদের এই আচরণকে শয়তানী আচরণের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কারণ শয়তান প্ররোচণা ও কুমন্ত্রণা দিয়ে মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে। আর যারা এসব দেখে-শুনেও নীরবতা অবলম্বন করে তারা প্রকারন্তরে শয়তানের ভূমিকাকেই সমর্থন করে। ফলে তাদের অপরাধ ও শয়তানের মতই গণ্য হবে।
সমাজ সচেতনতা বা সামাজিক দায়িত্ববোধ ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং সামাজিক অনাচার-পাপাচার রোধ কল্পে সমাজপতিদের দায়িত্ব অপরিসীম। সুস্থ, চরিত্রবান ও আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্য সকল প্রকারের অপরাধ নির্মূল করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এসব দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, কর্মতৎপরতা ও সৎসাহস প্রদর্শন করা একান্ত প্রয়োজন। এ কাজ সম্পাদন করতে গেলে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হতে পারে। তথাপি সত্য প্রতিষ্ঠার খাতিরে আদর্শ সমাজ গঠনে ইসলামের মহান শিক্ষাকে পাথেয় করে অগ্রসর হলে অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জন মোটেই কঠিন নয়। একথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, কেবল বৈষয়িক শিক্ষা নয়, ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে সুন্দর, সফল, কল্যাণকর ও সুখী সমাজ গঠন করার অসংখ্য নজির বিদ্যমান রয়েছে।



 

Show all comments
  • jack ali ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯, ৯:১০ পিএম says : 0
    We read so many article like this: but not a single so called muslim country rule by the Law of Allah''''''Those (Muslim rulers) who, if We give them power in the land, (they) order for Iqamat-as-Salat. [i.e. to perform the five-compulsory congregational Salat (prayers) (the males in mosques)], to pay the Zakat and they enjoin Al-Ma'ruf (i.e. Islamic Monotheism and all that Islam orders one to do), and forbid Al-Munkar (i.e. disbelief, polytheism and all that Islam has forbidden) [i.e. they make the Quran as the law of their country in all the spheres of life]. And with Allah rests the end of (all) matters (of creatures). This is the duty of the muslim scholar to establish the Deen of Allah [SWT] and unite the 57 country under one Ruler----But scholars are divided in many Groups---Allah warns them not to divide--Allah will punish them severely those who create Division In Islam because Allah has given them the knowledge of Qur'an and Sunnah;;;;
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম


আরও
আরও পড়ুন