Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ওকি গাড়িয়াল ভাই...

সৈয়দ শামীম শিরাজী, সিরাজগঞ্জ থেকে | প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাওইয়া গানের জনপ্রিয় শিল্পী আব্দুল আলিমের কণ্ঠে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে...’। জনপ্রিয় ভাওইয়া এই গানের সাথে গরু-মহিষের গাড়ির চাকার একটা সু-সম্পর্ক রয়েছে। বৃহত্তর চলনবিল পাঁচটি জেলা নিয়ে গঠিত। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ , উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত।
এক সময় চলনবিলের যাতায়াত ব্যবস্থা বেহাল ছিল। প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, রাস্তাঘাট না থাকায় গ্রামীণ রাস্তাগুলো মাটি দিয়ে তৈরি করায় শুকনো মৌসুমে গরু-মহিষের গাড়ি আর বর্ষাকালে নৌকায় লোকজন চলাচল ও ফসল পরিবহনে একমাত্র বাহন ছিল। এমনকি চলনবিলের কৃষক পরিবারে বিয়েতেও বর-কনে আনা নেয়া এবং জামাই-ঝিদের চলাচলে ব্যাপকভাবে গরু-মহিষের গাড়ি জনপ্রিয় বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
গরুর গাড়ির চাকার আবিষ্কার নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। তবে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় চলনবিলের মানুষ প্রয়োজনে গরু-মহিষের গাড়ি বেশি ব্যবহার করত। হাজার হাজার কৃষকের প্রয়োজনের তাগিদেই চাকা তৈরির বিষয়টি বিল পাড়ের মানুষের গৃহস্থালী কাজকর্মের একটা অংশ ছিল।
গরু-মহিষের গাড়ির চাকা শিল্পের খোঁজ নিতে যেতে হয়েছে চলনবিল অধ্যুষিত নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গ্রামীণ জনপদ মর্শিন্দা ইউনিয়নের আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত কাছিকাটা বাজারে। সরেজমিনে চাকা তৈরির কারিগরদের সাথে কথা হয়। তারা জানায়, কার্তিক মাসে আমন ধান, রসুন, সরিষা, গমসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আর গ্রীষ্মকালে বোরো ধান বিক্রির জন্য বিভিন্ন হাট-বাজারে পরিবহনে গরু-মহিষের গাড়ি কৃষকদের একটি অপরিহার্য বাহন ছিল।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকেই ধানসহ বিভিন্ন ফসল ও সবজি বিক্রির জন্য হাট-বাজারে নিতে গরু-মহিষের গাড়ি ব্যবহার করা হত। তাই সে সময় চাকা শিল্পের কদর ছিল সর্বত্রই। এ পেশায় নিয়োজিত ছিলো অনেকেই। এ শিল্পের অর্থ থেকে চলতো হাজারো পরিবারের সংসার।
ডিজিটাল যুগে প্রত্যন্ত চলনবিলের বিভিন্ন অংশে শত শত কৃষক এখনো গরু-মহিষের গাড়ি ব্যবহার করছেন। আর এ কারণেই চাকার প্রয়োজনীয়তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। চলনবিলের বস্তুল গ্রামের কৃষক ফণী খন্দকার জানান, রাস্তাঘাটের উন্নয়নের ফলে সময় বাঁচাতে মানুষ এখন যন্ত্রচালিত চাকাযুক্ত যানবাহনে দিনদিন আকৃষ্ট হচ্ছে। এদিকে চলনবিলের বিস্তীর্ন মাঠ থেকে এখনও কৃষকরা মাথায় করে বা গরু-মহিষের গাড়িতে ফসল বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিংবা সময় বাঁচাতে মানুষ এখন রাবারের চাকা যুক্ত যানবাহন পিকআপ, নসিমন, করিমন ও ভটভটিতে ফসল পরিবহণ করে। তারপরও স্বল্প পরিসরে হলেও চলনবিলের বিভিন্ন উপজেলায় প্রয়োজনের তাগিদেই গরু-মহিষের গাড়ির চাকা তৈরি করছেন কারিগররা।
চলনবিলের কাছিকাটা বাজারে কথা হয় চাকা তৈরির কারিগর নজরুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, প্রায় চার যুগ ধরে চলনবিল এলাকায় বিভিন্ন কারখানায় গরু-মহিষের গাড়ির চাকা তৈরি করছেন। কাঠ দিয়ে তৈরি চাকার প্রয়োজন কমলেও এখনো অনেক কৃষক সেই চাকার গাড়ি চালাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। বাবলা কাঠের গুড়ি থেকে পাওয়া শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি চাকা টেকসই হওয়ায় অন্য কাঠ চাকা তৈরিতে ব্যবহার হয়না।
তিনি জানান, বর্তমানে বাবলা কাঠ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আর চাকা তৈরিতে উপার্জন কমে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিশশিম খাচ্ছেন চাকা শিল্পের অনেক কারিগর। চাকা তৈরির কারিগর নজরুল ইসলামের মতে, এই কাজটি পরিশ্রমের। এক জোড়া চাকা তৈরিতে সপ্তাহ লেগে যায়। আর বিক্রি করা যায় ৮-১০ হাজার টাকায়।
অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, প্লাস্টিকের টায়ার গরু-মহিষের গাড়ির চাকা হিসেবে ব্যবহার শুরু হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি চাকার ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। চলনবিলের ৯ উপজেলার হাতে গোনা ৮-১০টি হাট-বাজারে চাকা তৈরির কারিগরদের দেখা মেলে। গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় বাজারের চাকা তৈরির কারিগর নৃপেন্দ্র নাথ বলেন, চাকা তৈরির কাজ কমে আসায় বেশির ভাগ কারিগরই পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। শুধুমাত্র চলনবিলের একেবারেই প্রত্যন্ত এলাকার গৈ গ্রামে কিছু কৃষক গরু-মহিষের গাড়ি ব্যবহার করায় চাকা তৈরির কাজটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
চলনবিলের আত্রাই উপজেলার কৃষক আছালত আলী বলেন, হয়তো অচিরেই চলনবিলের কৃষকের গরু-মহিষের গাড়ি বিলীন হয়ে যাবে। সে সঙ্গে চাকা তৈরি শিল্পের কারিগররাও হারিয়ে যাবেন অন্য পেশায়। ফলে গরু-মহিষের গাড়ির চাকা দেখতে আগামী প্রজন্মকে যেতে হবে মিউজিয়ামে। সুতরাং এ শিল্পকে রক্ষা করতে সহজ কিস্তিতে ঋণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ