Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মাদকের মামলা

সাড়ে ৩ লাখের বেশি নিষ্পত্তির অপেক্ষায়, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া

সাখাওয়াত হোসেন/ মালেক মল্লিক | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

মাদক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। বেশির ভাগ মামলাই বছরের পর বছর ধরে ঝুলছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে আসামিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। আবার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে অনেকেই। তবে কেউ কেউ সামান্য পরিমাণ মাদক বহনের কারণে ধরা পড়ে বছরের পর বছর কারাগারে রয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ডসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সারাদেশে মাদক সংক্রান্ত সাড়ে ৩ লাখ মামলার বেশি বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। বছরের পর বছর মামলার বিচারকার্য শেষ না হওয়ায় মামলার বাদি বা তদন্তকারী কর্মকর্তা অবসরে চলে যাওয়ায় তাদের আদালতে হাজির করতেও হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের।
তবে গত ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত মামলা নিস্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন। সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মাদকের মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আগে একটি মামলার শুনানি নিয়ে ছয় মাসের মধ্যে মাদকের মামলার নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা দেশের সব বিচারিক আদালতের প্রতি জারি করতে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে মামলা যথাসময়ে নিষ্পত্তির জন্য সহযোগিতা করতে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো মাদকের মামলার বিচার না হওয়ায় দেশে মাদকের ভয়াবহতা যেমন কমছে না, তেমনি পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দ্রুত বিচার সম্পন্ন হলে জড়িতদের সাজার পাশাপাশি অন্যদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন তারা। যদি বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে দেরি হয় তখন ন্যায় বিচার পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার অন্যতম কারণ আসামি ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য না দেয়া। মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তাও অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। এতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি অভিযুক্তরা জামিনে বেরিয়ে আবার মাদক কারবারে ফিরছে। এ অবস্থায় মাদক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক আদালত স্থাপন বা আদালত সুনির্দিষ্ট করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ৪৪ ধারায় মাদকদ্রব্য অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংশ্লিষ্ট জেলার যে কোনো অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে তার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে বলেও আইনে বলা হয়েছে। মাদক মামলার বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য ইতোমধ্যে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মাদক মামলা নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশাকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাদক মামলা নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ণ করতে হবে। এছাড়াও মাদক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রকৃত দোষীকে সাজা দিতে হবে। অন্যথায় মাদকের কার্যক্রম চলবেই। রাষ্ট্রপক্ষ উদ্যোগী না হলে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হবে। তাদের টালবাহানা আছে কি-না, সেটাও দেখা দরকার। এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের নজর দেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই আইনমন্ত্রী।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা শাখা) নজরুল ইসলাম শিকদার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মামলায় দীর্ঘসূত্রতার মূল কারণ সাক্ষী না আসা। সমন দেয়ার পরও সাক্ষী হাজির হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ দায়িত্বও পালন করা হচ্ছে না। এসব কারণেই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ দেখান না। কেউ কেউ চাকরিতে থাকলেও বদলি হয়ে অন্য জেলায় যাওয়ায় আগের মামলার সাক্ষ্য দিতে অনীহা দেখান। কোনো কোনো মামলায় সাধারণ সাক্ষীও খুঁজে পাওয়া যায় না।
হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দ্রুত বিচার পাওয়া মানুষের অধিকার। যদি বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে দেরি হয় তখন ন্যায় বিচার পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায়। এ কারণে হাইকোর্ট বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, জেলখানার তো একটি ধারণক্ষমতা আছে দ্রুত বিচার শেষ না হলেও বিনা বিচারের দীর্ঘ সময় কারাবাস থাকতে হচ্ছে। এটা তো কাম্য নয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করি, খুব শিগগির প্রত্যেক জেলায় ট্রাইব্যুাল গঠিত হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে মাদক মামলার বিচার দ্রুত হবে।
বিচারাধীন মামলার পরিসংখানে দেখা যায়, ঢাকায় ৭৮ হাজার ৩৩৮টি, নারায়ণগঞ্জে ১৫ হাজার ৯৮৭, গাজীপুরে ৯ হাজার ১৭৪, নরসিংদীতে ৪ হাজার ১৯৩, মুন্সীগঞ্জে ৫ হাজার ৯৯৮, মানিকগঞ্জে ৪ হাজার ৬৩৩, কিশোরগঞ্জে ১ হাজার ১৯৭, টাঙ্গাইলে ৪ হাজার ৮০৭, ফরিদপুরে ৫ হাজার ২৮১, গোপালগঞ্জে ৩ হাজার ৫০৪, মাদারীপুরে ৭০১, শরীয়তপুরে ১ হাজার ৭১৪, রাজবাড়ীতে ৪ হাজার ৬৫২, ময়মনসিংহে ৬ হাজার ৪০৬, জামালপুরে ৪ হাজার ৭১৮, শেরপুরে ৩ হাজার ৩৯১, নেত্রকোনায় ২ হাজার ৮৪৩, চট্টগ্রামে ২৫ হাজার ৩২৩, কক্সবাজারে ৪ হাজার ৩৭৮, নোয়াখালীতে ২ হাজার ৮০, ফেনীতে ১ হাজার ৯৩৪, লক্ষীপুরে ১ হাজার ৮৫৩, কুমিল­ায় ৭ হাজার ৮৩৭, চাঁদপুরে ২ হাজার ৬৩৯, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭ হাজার ২৩, বান্দরবানে ৪০৪, রাঙামাটিতে ১ হাজার ২১, খাগড়াছড়িতে ৭৩৭, রাজশাহীতে ১০ হাজার ২২০, নওগাঁয় ৮ হাজার ২৫০, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪ হাজার ২৭০, নাটোরে ৪ হাজার ৩৬২, পাবনায় ৭ হাজার ৬১৫, সিরাজগঞ্জে ৪ হাজার ১৪৩, বগুড়ায় ১১ হাজার ৭১, জয়পুরহাটে ১ হাজার ৬০৯, রংপুরে ১ হাজার ৭৭৪, কুড়িগ্রামে ৩ হাজার ৫১৭, গাইবান্ধায় ৪ হাজার ৫২১, দিনাজপুরে ৭ হাজার ৯৪৩, লালমনিরহাটে ১ হাজার ৯৮৫, নীলফামারীতে ১ হাজার ৮৫৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ হাজার ৫৫০, পঞ্চগড়ে ৩৯৯, খুলনায় ৬ হাজার ৩৫৫, সাতক্ষীরায় ১ হাজার ৭৫৯, বাগেরহাটে ১ হাজার ৮৬১, যশোরে ১৬ হাজার ১৬৪, নড়াইলে ১ হাজার ৬৫৩, মাগুরায় ১ হাজার ৯২৩, কুষ্টিয়ায় ২ হাজার ৫৬৫, মেহেরপুরে ৫০১, চুয়াডাঙ্গায় ৪ হাজার ৮৬৮, ঝিনাইদহে ২ হাজার ৩১, বরিশালে ৩ হাজার ৯৯৩, ঝালকাঠিতে ৭৩৩, পিরোজপুরে ১ হাজার ৫০৪, বরগুনায় ৪৮০, পটুয়াখালীতে ১ হাজার ৭৮৯, ভোলায় ১ হাজার ৮৩৪, সিলেটে ৪ হাজার ৬০৯, সুনামগঞ্জে ২ হাজার ৪, মৌলভীবাজারে ২ হাজার ৮২৬ এবং হবিগঞ্জে রয়েছে ৩ হাজার ৪১৮টি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৯৬হাজার ৭শ’ ১৯টি মামলা বিচারধীন অবস্থায় রয়েছে। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে এক লাখ ৯৫৫জনকে। এদের মধ্যে অধিকাংশ মামলার আসামীই পলাতক। গ্রেফতারকৃতদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে এসেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যায় ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের মামলার সংখ্যা ৭হাজার ৭শ’৬৪টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৭হাজার ৯শ’ ৬৬জনকে। ২০১০ সালের মামলার সংখ্যা ৮হাজার ১৯টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৮হাজার ২শ’ ৮৩জনকে। ২০১১ সালের মামলার সংখ্যা ৮হাজার ৭শ’ ৪৯টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৯হাজার ৩শ’ ৩৬জনকে। ২০১২ সালের মামলার সংখ্যা ১০হাজার ১৪টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ১১হাজার ৪০জনকে। ২০১৩ সালের মামলার সংখ্যা ১০হাজার ১শ’ ১১টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ১০হাজার ৯শ’ ৯০জনকে। ২০১৪ সালের মামলার সংখ্যা ১১হাজার ৭শ’ ২৩টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ১২হাজার ৫শ’ ৯০জনকে। ২০১৫ সালের মামলার সংখ্যা ১০হাজার ৫শ’ ৪৮টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ১১হাজার ৩শ’ জনকে। ২০১৬ সালের মামলার সংখ্যা ৯হাজার ৭শ’ ৭৩টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ১০হাজার ৪শ’ ৬৫জনকে। ২০১৭ সালের মামলার সংখ্যা ১১হাজার ৬শ’ ১২টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ১২হাজার ৬শ’ ৫১জনকে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত মামলা দায়ের করা হয়েছে ৮হাজার ৪শ’ ৬টি এবং এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৯হাজার ৩শ’ ৩৪জনকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাদক

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ