পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হঠাৎ পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ১১ ফেব্রুয়ারি স্পট সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, অমর একুশে বইমেলা। বাতাসে ভেসে আসছে মাগরিবের নামাজের আজানের ধ্বনি। মেলায় হাজার হাজার দর্শনার্থীর মধ্যে তরুণ-যুবক-বয়স্ক মানুষ ছুটছেন মেলার প্যান্ডেলের উত্তর-পূর্ব দিকে। ফুলকি নামের স্টলের পাশে ‘নামাজ ঘর’-এর পাশে প্রচন্ড ভিড়। নামাজিদের জন্য অজুর চমৎকার ব্যবস্থা। ভেতরে মুসল্লিরা জামায়াতে নামাজ পড়ছেন। জায়গা না হওয়ায় শতাধিক মুসল্লি অজু করে টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। নামাজের জন্য অপেক্ষায় থাকা মুসল্লিদের বেশির ভাগই স্মাট তরুণ-যুবক। নামাজ শেষে ভেতর থেকে মুসল্লিরা বের হতেই অপেক্ষারত মুসল্লিরা সারিবদ্ধভাবে ভেতরে যাচ্ছেন নামাজ পড়তে। একুশে বইমেলার এ দৃশ্য একেবারেই নতুন। গতকাল ১৫ ফেব্রুয়ারিও দেখা গেছে একই দৃশ্য।
বইমেলায় হাজার হাজার দর্শনার্থীর মধ্যে মহিলা, শিশু আর প্রেমিক-প্রেমিকা জুটিই বেশি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসেছেন। তারা দলবেঁধে ঘুরছেন। সবাই সেলফি তুলছেন। সেলফি তোলার দৃশ্য দেখে মনে হয় এন্ড্রয়েড ফোনের বদৌলতে আমরা সেলফি যুগে প্রবেশ করছি। কি ছেলে-মেয়ে, কি বুড়ি-বুড়ি সবাই সেলফি তুলছে। বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুরা এসেছে মেলায়। তারাও সেলফি নিয়ে ব্যস্ত। তবে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতীর বিচরণ চোখে পড়ার মতোই। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আলো-আঁধারিতে তাদের আচরণ দৃষ্টিকটুও বটে। বইমেলা যেন হয়ে গেছে প্রকাশ্য প্রেম করার উত্তম জায়গা। হাজারো মানুষের সামনেই রঙ-ঢঙের সমারোহের ভিড়েও মাগরিবের আজান শুনেই নামাজ পড়তে এত মানুষের উপস্থিতির দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। অথচ মাগরিবের নামাজের সময় অনতিদূরে বেলেল্লাপনা, তরুণ-তরুণীদের ঢলাঢলির দৃশ্য দেখা গেল। আবার বিপরীত দৃশ্য হিজাব, বোরকা পরিহিত মেয়েদেরও মেলায় ঘুরতে দেখা যায়। পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় ঘুরছেন, বই কিনছেন। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্যান্ডেরের বাইরে আলো-আঁধারিতে জোড়ায় জোড়ায় ঢলাঢলির দৃশ্য সত্যিই বেমানান। বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ; বদলে গেছে একুশের বইমেলা। বইমেলায় আসা উচ্চশিক্ষিত ছেলেদের মধ্যে ইসলামী জাগরণের দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব।
প্রেমিক-প্রেমিকার অবাধ বিচরণ :
বাংলা একাডেমির বইমেলা যেন অন্য জগৎ। ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো বিকেলে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উত্তরে শাহবাগ, দক্ষিণে দোয়েল চত্বর, পূর্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন গেইট, পশ্চিমে নীলক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকেন; দেখবেন এক সময় আপনি বাংলা একাডেমির অমর একুশের বইমেলায় পৌঁছে গেছেন। জন স্রোতই আপনাকে মেলায় নিয়ে যাবে। এই জন স্রোতের বেশির ভাগই নারী-শিশু, শিক্ষার্থী আর প্রেমিক-প্রেমিকাযুগল। মেলার দর্শনার্থীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ এরাই। শিশুরা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে, প্রেমিকা প্রেমিকের হাত ধরে রঙঢঙ করছে। বইমেলা উপলক্ষে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে চলছে কার্যত ফ্রি স্টাইলে প্রেম। উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের নিচে কৃত্রিম লেকে টইটম্বুর পানি। মেলার উত্তর পাশে লেকের সঙ্গে যুক্ত করে প্যান্ডেল ঘেড়াও করা হয়েছে। লেকের ধারে শত শত প্রেমিক-প্রেমিকাযুগল বসে রয়েছে। কেউ প্রেমিকার কোলে মাথা রেখে, কেউ হাতধরাধরি করে বসে লেকের স্বচ্ছ পানি ও মেলার দৃশ্য একসঙ্গে উপভোগ করছেন। এ যেন বিশ্বের যৌনতার রাজধানী খ্যাত থাইল্যান্ডের পাতায়া সি-বিচের এক খন্ড! প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলদের পাশাপাশি মায়েরা শিশুদের নিয়েও লেকের ধারে বসে সময় কাটাচ্ছেন। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে অতি কাছাকাছি বসে আছেন, অথচ লোকলজ্জার বালাই নেই! যেন কেউ দেখলে কিছুই আসে যায় না। এ কেমন আধুনিকতা?
বইমেলায় রয়েছে হরেক রকম বইয়ের স্টল। তবে বইয়ের বেশির ভাগ দোকান ফাঁকা দেখা গেলেও উপচে পড়া ভিড় খাবারের সব দোকানে। খাবারের দোকানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই; কেউ দলবেঁধে খাচ্ছে, কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে টেবিল খালি হবে প্রত্যাশায়। ১৫ টাকা দরের কফি লাইন ধরে সংগ্রহ করছে দর্শনার্থীরা।
বইমেলায় এবার নামাজের ঘর ছাড়াও পরিষ্কার পানি পানের ব্যবস্থা এবং বেশ কয়েকটি পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। ভাষাশহীদ ও প্রখ্যাত লেখকদের নামে কর্নার এবং সিসিমপুরের সৌজন্যে শিশুদের জন্য আনন্দ করার জায়গাও রাখা হয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েকে বইমেলায় নিয়ে এলেই তাদের সুন্দর পরিবেশে খেলা আর মজা-আনন্দ করার জায়গা দেখিয়ে দিতে পারবেন। শিশুরা খেলবে, তারপর বই কিনবে- চমৎকার মজার জায়গা। কিন্তু শিশুদের জন্য মেলায় প্রেমিক-প্রেমিকাযুগলের অবাধ বিচরণের দৃশ্য দৃষ্টিকটু।
লেখক বলছি :
মেলার ভেতরে বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মরণে ১৩টি চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে। কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি শহীদ কাদরী, কবি রফিক আজাদ, আবদুল গফুর, শওকত ওসমান, সরদার জয়েনউদ্দীন, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, আমীর হোসেন চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র সেন, আহসান হাবীব, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন ও নূরজাহান বেগম এই ১২ বিশিষ্টজনের নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ১২টি চত্বরের নামকরণ রয়েছে। এ ছাড়াও বাংলা একাডেমি অংশে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে আরেকটি চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে।
নতুন বই এলেই মাইকে বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের বই সংক্রান্ত এবং লেখক সংক্রান্ত খবরাখবরও মাইকে প্রচার করা হয়। ‘লেখক কর্নার’ নামে একটি বিশেষ স্থান বরাদ্দ রাখা হয়েছে। লেখক কর্নারকেও নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। ‘লেখক বলছি’ নামের এই বিশেষ আয়োজনে প্রতিদিনই পাঁচজন করে নবীন-প্রবীণ কবি-লেখক তাদের প্রকাশিত নতুন বই নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি হচ্ছেন। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় বিকেল ৫টায়। চমৎকার আয়োজন। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান মেলায় একটি বিশেষ আকর্ষণীয় দিক। নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে প্রতিদিনই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমাগম ঘটছে। বাংলা একাডেমি ক্যাম্পাসের মূল মঞ্চে নির্ধারিত বিষয়ের ওপর আলোচনা চলছে প্রতিদিনই। আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত মঞ্চে বাংলাদেশ সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে একুশে নাট্যোৎসব-২০১৯ চলছে। প্রতিদিন বিকেলে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ক্লাব ও নাট্যগোষ্ঠী নাটক পরিবেশন করছে।
হারিয়ে গেছে সার্বজনীনতা :
কবি-সাহিত্যিক-লেখক-গবেষকরা নিজেদের মতো করেই লিখে থাকেন। মুক্তচিন্তা থেকে তাদের লেখা বই প্রকাশ হওয়ার কথা। বাঙালির আত্মপরিচয়ের ক্যানভাস যাপিত জীবন মুক্তমত চর্চা। কয়েক বছর আগেও বাংলা একাডেমির বইমেলায় সার্বজনীনতা ছিল। বইমেলার দর্শদের বিচরণ এবং কবি-লেখকদের নতুন নতুন বইয়ে সব মত-পথের মুক্ত সমারোহ চোখে পড়ত। শতাধিক স্টলে ঘুরে নানার লেখকের বই উল্টেপাল্টে মনে হলো এবারের বইমেলা লেখা-বিক্রি-দেখা সব কিছুই একপক্ষীয় চিন্তা-চেতনায় ঠাসা। ভিন্নমত দূরের কথা নানান মতের লেখা বইয়ের সংখ্যা যৎসামান্যই। ভিন্নমতের লেখকদের উপস্থিতিও খুবই কম। মস্তিষ্কের স্বাধীনতার বদলে কবি-লেখক-গবেষকরা মননশীল লেখার বদলে একটি রাজনৈতিক পক্ষকে প্রাধান্য দিয়ে এবার প্রকাশিত নতুন নতুন বইয়ের পৃষ্ঠা সাজিয়েছেন। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিশুতোষ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সব ধরনের বইয়ে কাউকে না কাউকে খুশি করার চেষ্টা দেখা যায়। রাজনৈতিক দলকে খুশি করতে ব্যক্তি বিশেষকে নিয়ে লেখায় প্রাধান্য দিয়ে বইমেলায় ‘জঙ্গলের জন্য বৃক্ষ দেখা যায় না’ অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। গবেষণাধর্মী, চিন্তা ও মননশীল, সৃজনশীল বই যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নজরদারিতে ১০ বছর আগের ‘মুক্ত পরিবেশ’ বর্তমান বইমেলায় নেই। সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে; নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই যেন দর্শনার্থীরা মেলায় ঘুরে বেড়ানোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। গণতান্ত্রিক দেশে সব কিছুই ‘সমাজতান্ত্রিক নিয়তির’ মতো চলছে। কয়েক বছর আগে মেলার সৌন্দর্য রক্ষায় গ্রন্থের বাইরে অন্য সব ধরনের পণ্য তথা বারোয়ারি পণ্যের দোকান নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এবার মেলায় অনলাইন ব্যাংকিংয়ের বিকাশের দোকানগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। বইয়ের দোকানের দর্শনার্থী নেই; অথচ পাশের বিকাশের দোকানে প্রচন্ড ভিড়; সেখানে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার হিড়িক। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিকাশ নামের টাকার দোকান কি জ্ঞানের ভান্ডার বইয়ের তালিকায় উঠে এলো? বইয়ের মেলায় বিকাশের এতগুলো দোকান বরাদ্দ দেয়ার রহস্য কী?
সৃজনশীল বই কম:
একুশে বইমেলা বাঙালির ঐতিহ্য ও অর্জনের এক সাহসী ঠিকানা। এই বইমেলায় লেখক-পাঠকের মহামিলন ঘটে। বন্ধু-প্রিয়জনের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয়। অনেক লেখক বইমেলা উপলক্ষে নতুন বই লেখেন; প্রকাশকরা বই প্রকাশ করেন। নতুন নতুন সাহিত্য পড়ে পাঠক পুলকিত হন। তথ্যপ্রযুক্তির উন্মেষের যুগে এবারের বইমেলায় আসা প্রতিটি নতুন বইয়ের কাভারে বেশ জৌলুশ; তবে হরেক রকমের বই নিম্নমানের লেখাই বেশি। ৪ ঘণ্টা ধরে কয়েকটি স্টলে নতুন-পুরনো লেখকদের বই উল্টেপাল্টে দেখে মনে হলো নতুন লেখকের তালিকা হুহু করে বাড়লেও মানসম্পন্ন লেখা বা পরিশ্রম করে লেখালেখি করা লেখকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গবেষণা ও মননশীল বইয়ের সংখ্যা একেবারেই কম। চটুল গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভূতের গল্প ইত্যাদি হালকা লেখাই বেশি। ইন্টারনেট ঘেঁটে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি নকল লেখার সংখ্যাই বেশি। দু-একটি বই দেখে লিখলে ‘নকল বই’ আর ১০ থেকে ১৫টি বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে লিখলে ‘গবেষণামূলক’ বই হয়। সেই গবেষণামূলক বইয়ের সংখ্যাও খুবই কম। তবে বইমেলা উপলক্ষে চলছে বই প্রকাশের এলাহি কান্ড। দেশে গণতন্ত্র, মানুষের ভোটের অধিকার থাক না থাক, মানবাধিকার নিত্যদিন রাস্তায় গড়াগড়ি দিক; কিন্তু কবি-সাহিত্যিক আর লেখকের বাড়বাড়ন্ত চলছে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মেলা উপলক্ষে প্রখ্যাত অনেক কবি-লেখকের নতুন বই প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রতিদিন যে গ্রন্থ আসছে, তার অধিকাংশই লেখক-কবিরা নিজেদের টাকায় বই ছাপিয়েছেন। লেখার মান তথা বইয়ের ভেতরে কী লেখা রয়েছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টলে দাঁড়িয়ে থেকে একটি বই বিক্রি করতে পারলেই লেখক নিজের পরিচয় দিয়ে অটোগ্রাফ দেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। আবার উল্টো চিত্র আছে। কোনো কোনো লেখক অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যথা করে ফেলছেন। বই বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনেক প্রসিদ্ধ প্রকাশনী সংস্থাও কবির টাকায় বই ছাপিয়েছে। প্রজ্বলন নামের এক বই স্টলের বিক্রেতা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এই বলে যে, বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশকদের অবস্থা এমন লেখকের টাকার বই ছাপালে শিল্পমান দেখার প্রকাশক কে? কবি-লেখকরা নিজের বই ছাপিয়ে এনেছেন নিজের টাকায়। তাদের প্রয়োজন সমাজে যশ-খ্যাতি কবি-সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি। টাকা যতই খরচ হোক চাই লেখক হিসেবে পরিচিতি। এই লেখকদের অনেকেই নিজেরাই গুগল ঘেঁটে কোনো এক চিত্র কেটেকুটে নিজেই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। বইয়ের ভেতর ছাপার অক্ষরে ছাইপাশ যাই থাক, বিক্রি হোক না হোক সমস্যা নেই। বাংলা একাডেমির ঐতিহ্যের বইমেলা যেন হয়ে গেছে প্রেমিক-প্রেমিকার বাধাহীন প্রেম করা আর লেখক-কবিদের হাটবাজার। সৃজনশীল প্রকাশনী সংস্থাগুলো হয়ে গেছে কবি-লেখক তৈরির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফ্যাক্টরি। বই মেলায় প্রতিদিন নিত্যনতুন কবি; গল্প-কবিতার বই আসছে বানের পানির মতো। কেউ কিনুক না কিনুক বিক্রি হোক না হোক; বই উল্টেপাল্টে দেখছে দরদাম করছে এ যেন জমজমাট সাহিত্য সওদার তীর্থস্থান।
নতুন বইগুলোর লেখার মান দেখে মনে হয় কবি হওয়া বা গল্প-উপন্যাস লেখা যেন ছেলেখেলা! কবিতা-ছড়া-গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে প্রতিভার বিকাশ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। দেখার বোঝার তৃতীয় নয়নের কারণেই প্রতিভাবানদের মাথায় এমনিতেই কবিতা-গল্প আসে; এসে যায়। মেলা উপলক্ষে যে বইগুলো প্রকাশ হচ্ছে তার কয়টি বৃক্ষ আর কয়টি জঙ্গল ও আগাছা তা নিরূপণ করা কঠিন।
কবিতা বনাম ইসলামী বই:
মেলায় প্রতিদিন নতুন নতুন বই আসছে। প্রথম দিকে প্রতিদিন সাতটি নতুন বই মেলায় এলেও এখন এক শ’ থেকে দেড় শ’ বই প্রতিদিন মেলায় যুক্ত হচ্ছে। গতকালও এসেছে ২৭২ নতুন বই। এ পর্যন্ত মেলায় ২ হাজার ২৭১টি নতুন বই এসেছে। নানান ধরনের নতুন বইয়ের মধ্যে কবিতার বই বেশি। অথচ কবিতার বইয়ের বিক্রি সবচেয়ে কম। হাতেগোনা কয়েকজন লেখকের লেখা উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশনস, গল্প-ভ্রমণ কাহিনী, প্রবন্ধের বই প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে শিশুতোষ বই, ভূতের কাহিনীর বই আর ইসলামী ধারার বই। কয়েকটি স্টল ঘুরে দেখা যায়, বইমেলায় ইসলামী ধারার বইয়ের সংখ্যা কম। তবে বিক্রেতারা জানান, কবিতার বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে ইসলামী ধারার বই। আলোর কাফেলা, আলোর মিছিল, সাহাবিদের জীবন চিত্র, আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ ও ইসলাম, প্রিয় নবীর আদর্শ জীবন, এসো নামাজ পড়ি, কুরআন ও হাদিসের আলোকে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা, কুরআন পড়ো জীবন গড়ে, নবীদের সংগ্রামী জীবন, কুরআন বোঝার পথ ও পাথেয়, আশুরা ও কারবালা, কুফরি ফতোয়া, কুরআন শিক্ষার সহজ পদ্ধতি, মুক্তির পথ ইসলাম, যাকাত সাওম ইতেকাফ, রাসূলুল্লাহর (স.) বিচার ব্যবস্থা, পর্দা ও ইসলাম, ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী আইন ইত্যাদিসহ মনীষীদের জীবনীমূলক বই বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, বাংলা একাডেমির বইমেলায় ইসলামী ধারার বই খুব কম। তারপরও কবিতার চেয়ে ইসলামী ধারার বই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
মেলার উৎপত্তি এবং :
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে মেলার আয়তন সাড়ে ৫ লাখ বর্গফুট এলাকা জুড়ে। মেলায় অংশ নিচ্ছে ৪৯৯টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এবার ১৯টি নতুন প্রকাশনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ৬ শতাধিক স্টল ও ৪২টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে থাকা শতাধিক স্টল নানা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন নানান নামে স্টল সাজিয়েছে। এবার ২৩টি প্রকাশনীকে প্যাভিলিয়ন দেয়া হয়েছে। সেই সাথে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৩৩৮টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে ৫৯৩টি ইউনিট বণ্টন করা হয়েছে। আর একাডেমি প্রাঙ্গণে ফুটপাথে ঘুপচি টং দোকানের মতো করে অনেকগুলো স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়।
মেলার নাম একুশে গ্রস্থমেলা। এবারের মেলায় থিম ‘৫২ থেকে ৭১’। মূলত মুক্তিযুদ্ধের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পুঁথিঘর-মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদের ব্যানারে বাংলা একাডেমির বটতলায় (তখন নাম ছিল বর্ধমান হাউজ) ৩২টি বই ঘাসের ওপর সাজিয়ে বিক্রি করেন। কলকাতা থেকে আনা বইগুলোর লেখক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে শরণার্থী বাংলাদেশী লেখকরা। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প প্রকাশ করে। এভাবে বর্ধমান হাউজ বই বিক্রি চলে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। ১৯৭৯ বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতিগুলো যুক্ত হয়। তবে ১৯৮৪ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সাড়ম্বরে সূচনা হয়। ২০১৪ সালে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।