Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সিলেটের টিলায় অন্য রকম বসন্ত

রেজাউল করিম রাজু | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, পলাশ, রাধাচুড়া, গগনচুড়া, করবী, মাধবীলতায় রং বেরংয়ের ফুল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে ঋতুরাজ বসন্ত। সারা দেশের মত ফাল্গুনের প্রথম দিনটি টিলা আর চায়ের রাজ্য সিলেটে এসেছিল ভিন্ন আমেজে।
নগরীর উপকন্ঠে এক্সেল সিওর সিটিতে বসেছিল অন্যরকম মিলন মেলা। টিলাজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো গাছ গাছালীর মাঝে কৃষ্ণচ‚ড়া করবী পলাশের দেখা না পাওয়া গেলেও বসন্তের প্রথম দিনে সেখানে যারা সমবেত হয়েছিলেন তারা সবাই যেন একেকটা পলাশ, শিমুল, করবী, মাধবীলতার রুপ ধারণ করেছিলেন। আবির ছড়াচ্ছিল সমানে। তাদের আনন্দ উচ্ছাস বলে দিচ্ছিল কবি সুভাষের ভাষায় ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি প্রকৃতির অপরুপ অবদান সিলেটের উঁচু উঁচু টিলার উপর মানুষের মেধা মনন দিয়ে গড়ে তোলা রিসোর্ট আরো অপরুপ হয়ে দাড়িয়েছে। তেমনি আরেকটি রিসোর্ট শুকতারা থরে থরে অনন্যরুপে সাজানোয় নামের যথার্থতা বলে দেয়। সেদিনকার বাসিন্দারা আর আকাশের লক্ষ কোটি তারার মাঝে অনন্য শুকতারা আলো যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সবাই যেন একেকটি শুকতারা। ঋতুরাজ বসন্তের শুরুর এ দিনটায় হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরান (রহ.) এর পূণ্যভূমিতে জড়ো হয়েছিলেন দৈনিক ইনকিলাবের দেশজুড়ে থাকা ব্যুরো ও আঞ্চলিক প্রধানরা। যার নেতৃত্বে ছিলেন পত্রিকার প্রাণপুরুষ একাধারে সম্পাদক অভিভাবক বড় ভাই ও নিরঅহংকার অসম্ভব ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন ও তারুণ্যে ভরা মন মননশীলতায় একজন পরিপূর্ণ মানুষ এ এম এম বাহাউদ্দীন। যিনি ইনকিলাব পরিবারের সবাইকে আপনজন ভেবে সাথে নিয়ে নানারকম চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিনদশকের বেশী সময় ধরে শুধু দেশ ও জনগণের পক্ষে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
এ সিপাহসালার তার পথ চলার সহযাত্রীদের নিয়ে ফি বছর এমনিভাবে পরিবার পরিজন সাথে নিয়ে মিলন মেলার আয়োজন করেন। কিভাবে আরো মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যায়। সততা বজায় রেখে নিজেদের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা যায় তেমনি নির্দেশনা দেন। হরহামেশা মুঠোফোনে বিভিন্ন এ্যাসাইনমেন্ট দেন। আর বছরে এ দিনটিতে সবার সব কথা শোনেন, পরামর্শ নেন ও দেন। একজন যোগ্য অভিভাবকই বটে। সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান। বহু গণমাধ্যমের দেশ বাংলাদেশ এমনটি বিরলই বটে।
সিলেটের উপকন্ঠে উঁচু টিলার উপর এক্সেলসিওর রির্সোটের মধু মালতিতে সব ব্যুরো ও আঞ্চলিক প্রধানদের অবস্থান ও মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় প্রীতি সম্মিলন। উঁচু টিলার উপর হাজার হাজার গাছ পরিবেষ্টিত রিসোর্ট। কাঁচ ঘেরা জানালা দিয়ে চারিদিকে নজর পড়ে সবুজ বৃক্ষ রাজি। পাহাড়ী গাছ গাছালী ছাড়াও নজরে পড়ে আম, আতা, সফেদা, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। রয়েছে হাজারো বানরের ঝাঁক। এডালে ওডালে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে। বলছে আহা কি আনন্দ আজি আকাশে বাতাসে। নীচে নজরে পড়বে শত শত হরিনের অবাধ বিচরণ। এছাড়া রয়েছে কত রকম পাখ-পাখালির। যা ক্ষণিকের জন্য সকল ক্লান্তি দুঃখ কষ্ট বেদনার কথা মন থেকে মুছে দেয়। মনটা অনেক বড় আর উদার হয়। জাগ্রত হয় মানবিক মূল্যবোধ।
অদূরে আরেক অনন্য রিসোর্ট শুকতারা। অসাধারণ ভাব গড়ে তোলা হয়েছে। শুরুতে গেট পেরিয়ে উঠার পথটি বেশ রোমাঞ্চকর। খাড়া পথ উঠতে হবে সাবধানে। উঠার জন্য রয়েছে ছোট রেলগাড়ি সদৃশ্য বাহন। সব যন্ত্র চালিত যান উপরে উঠতে পারবেনা। আর রিসোর্টটি যেন ছোট একটি পাহাড়ী ভ‚স্বর্গ। সিড়ি গোড়ায় গিয়ে ছোট বেলার সেই ছড়াটি মনে হচ্ছিল- ‘আইকুম বাইকুম তাড়াতাড়ি, যদু মাষ্টার শ্বশুর বাড়ি, রেল গাড়ি কাম ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম’। সত্যিই রিসোর্টে উঠতে গিয়ে পা পিছলে গেলে আলুর দমের মতই অবস্থা হবে। এখানে অবস্থান নিয়েছিলেন সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, দৈনিক ইনকিলাবের ক্রীড়া সম্পাদক ও ব্যুরো চীফ ফোরামের উপদেষ্টা রেজাউর রহমান সোহাগ, ইনকিলাবের আইটি প্রধান সৈয়দ আহসানুর রহমান গালীবসহ আরো কজন। ছিলেন সদা প্রাণবন্ত সোহাগ অনন্য জুটি মিসেস নাসিমা আক্তার ডলি। খুব সহজেই দুজনে সবার সাথে হাসিমুখে মিশে যেতে পারেন। আল্লাহপাক যেন তাদের সৃষ্টি করেছেন একে অপরের জন্য। আর চির তারুণ্যের অহংকার নিয়ে রয়েছেন আহসানুর রহমান গালীব। যিনি কখনো গোমড়া মুখে থাকেন না। ডলি ভাবীর সাথে এবার যোগ দিয়েছিলেন ইনকিলাবের সর্বকনিষ্ট ব্যুরো প্রধান ফয়সাল আমীনের নববধূ সানিয়া রুলি। যার তারুণ্যতা আর প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ানো সবার সাথে সাবলীল ভাবে মিশে যাওয়া সবাইকে মুগ্ধ করেছে। নববধূকে ইনকিলাব ব্যুরো প্রধানদের পক্ষ থেকে উপহার তুলে দেন সম্পাদক। আর সম্পাদক তাকে একটা নতুন মোবাইল ফোন তার পক্ষ থেকে উপহার দেন। উপহার পেয়ে কি যে খুশী তা লিখে বোঝানো যাবে না। বিশেষ করে সুন্দর মোবাইল ফোন পেয়ে সবাইকে দেখিয়ে বলছিল সম্পাদক স্যার দিয়েছেন। বসন্ত সাজে সেজে নতুন মোবাইল ফোনের সেলফি তুলে ব্যাস্ত সময় পার করে।
দুদিন ঘন্টা দেড়েক করে পত্রিকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক ও নির্দেশনামূলক বক্তব্যের পর মধুমালতি রেস্তরায় দুপুরের খাবার। হরেক রকম পদের সাথে ছিল সিলেটের সাতকড়া দিয়ে রান্না করা ডাল আর কালাভুনা। আগের রাতেই ডিনারের পর মেন্যুটি দিয়েছিলেন সম্পাদক নিজেই। খাবার পর পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে জানানো হলো সবার ছুটি। এখন কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা। ছুটি পেয়েই সবাই ছুটলো হযরত শাহজালাল ও হযরত শাহপরানের মাজার পানে। নামাজ আদায় এবং মাজার ভক্তিভরে জিয়ারত। দোয়া দরুদ পাঠ শেষে নোয়াখালী ব্যুরো প্রধান আনোয়ারুল হক আনোয়ার আউলিয়াদের মাজারের সামনে দাড়িয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে আল্লাহর দরবারে সবার সুখ শান্তি কামনা, গুনাহ মাফ, যারা যে সব পেরেশানীর মধ্যে আছেন তা থেকে মুক্তি, প্রত্যেকের শারীরিক সুস্থতা বিশেষ করে ইনকিলাব পরিবারের সকলের মঙ্গলময় জীবন কামনা করে মোনাজাত করেন। সবার অন্তর ও চোখ ভিজে গিয়েছিল। কেউ কেউ একাধিক দিন জিয়ারত করেন।
এরপর সিলেট নগরী ঘুরে দেখা শুরু। চা কেনা, মনিপুরি মার্কেটে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাপড়, সাতকড়ার আচার কিছুই বাদ যায়নি। সিলেট ব্যুরোর তরুণ ফটো সাংবাদিক সারল্যতায় ভরা মুখ সর্বত্রই হাঁসি খুশি আনোয়ার সফর সঙ্গী হয়ে সিলেটের চা বাগান থেকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখায়। সবাইকে সিলেটের মিষ্টি পান যাতে খয়ের আর মিষ্ট মশল্লার বেশী ব্যবহার করা হয়েছে। এমন রসগোল্লা মার্কা পান অকাতরে বিতরণ করে সিলেটী মাত মাতিয়ে বলছিল ‘সিলেটের মিষ্ট ফ্যান খাইলে মনে হইবো মিষ্ট পান খারে খয়’। আরো নানা কথা বলে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। ভোজন নামক রেষ্টুরেন্টের চা পান করিয়ে সবাই অবাক করে। অনেকে স্বাদে অনন্য কারণে কেউ কেউ ডবল অর্ডার দেন। পরদিন দুপুরে পানসি নামে এক খাবার হোটেল নানা রকম ভাজি ভর্তার সমাহারে দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। খাবারের স্বাদের কারণেই জানান দিচ্ছিল সকাল থেকে কেন এতো হাজার লোকের ভীড়।
রাতের বেলা সবাই সহধর্মিণী আর ছেলে মেয়েদের বর্ণনা দিচ্ছিল রিসোর্ট আর আনন্দ ভরা দিনের কথা। মোবাইল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সহধর্মিণীরা অভিমানী কন্ঠে বলছিলেন ‘আমি কি তোমার আপন ছিলাম নারে বন্ধ’ু। অন্য এক সময় নিয়ে আসব বলে প্রতিশ্রুতি দেন অনেকে। শেষ দিকে স্বপরিবারে এসে যোগ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম ব্যুরোর মুরাদ। তার স্ত্রী সন্তানরা বেজায় খুশী। স্বস্ত্রীক এসেছিলেন ময়মনসিংহ ব্যুরো প্রধান শামসুল আলম খান।
এদিকে গভীর রাত পর্যন্ত রুমে রুমে চলে আড্ডা। বিশেষ করে নোয়াখালীর আনোয়ার রস রসিকতায় মাতিয়ে তোলেন। যশোরের তোতা মধ্য রাতে ভিডিও কলের মাধ্যমে মেয়ে জামাইদের সাথে ভালোবাসা দিনের শুভেচ্ছা জানান। যেন মরহুমা রেবা রহমানের শূন্য স্থানে কিছু শান্তনা দেবার চেষ্টা করছেন।
বগুড়া ব্যুরোর মহসীন আলী রাজু ছিলেন আমার কক্ষের সঙ্গী। বৃহস্পতিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে রিসোর্টের বাইরে বাগানে বসে একা একা গান গাইছিলেন। গলা কেমন আছে তা পরখ করার জন্য আবার মোবাইলে রেকর্ড করছিলেন। সাত সকালে গানের অন্য কোন শ্রোতা না থাকলেও কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখেন শ’দেড়েক বানর তার আশেপাশে বাইরে ভীড় জমিয়েছে। যেন তার গানের ভক্ত। অবাক বিষয় নিয়ে ঘরে ফেরেন। বিষয়টা বলার পর ছোট একটা মন্তব্য করেছিলাম ‘চিনিলো ক্যামনে’। সহজ উত্তর ডারউইনের থিওরি। বিষয়টি চাউর হলে হাস্য রসের সৃষ্টি হয়।
সবকিছু ছিল অত্যন্ত গোছালো এবং পরিকল্পিত। সিলেট ব্যুরো প্রধান ফয়সাল আমীন ও তার সঙ্গীদের পাশাপাশি সর্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণ করছিলেন ইনকিলাবের জিএম রবিউজ্জামান রবিসহ তার সঙ্গীরা। শুকতারা রিসোর্ট থেকে সবকিছু মনিটরিং করা হচ্ছিল। রবি সাহেবের কর্মকান্ড দেখে মনে হচ্ছিল জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি অবুঝ মনের অভিনেতা সাইফুদ্দিনের কথা। কোথায় কি হলো, কি খাচ্ছে, কেমন আছে সব যেন গোপনে নোট বইয়ে টুকে নেয়া। আর জায়গামত জানান দেয়া। কথায় বলে ‘শেষ ভাল যার সব ভাল তার’। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই ভাল ছিল। তারপরও সিলেট ব্যুরো প্রধান আর তার সাথীদের মাঝে ছিলনা ক্লান্তি। শেষ দিনে রিসোর্ট স্টেশন, বিমানবন্দর আর বাস টার্মিনাল পর্যন্ত ছুটেছেন। জানিয়েছেন বিদায়। বিনয় ঝরে পড়ছিল কন্ঠে। সম্পাদক চা বাগানের পর পরবর্তী মিটিং আমের রাজধানী রাজশাহীতে আম মৌসুমে করার ঘোষনা দিলে সবাই করতালী দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। মধুমালতি নামের ক্ষনিকের অতিথিশালা ছাড়ার সময় মনের অজান্তে গুনগুনিয়ে উঠছিল জনপ্রিয় শিল্পী সন্ধ্যা মুখার্জির- ‘মধুমালতি ডাকে আয়, ফুল ও ফাগুনের এ খেলায়’।
নিজ নিজ গন্তব্যে যাত্রা শুরুর পর শুরু হয় প্রত্যেকের প্রত্যেক যাত্রা পথের খবর নেয়া। বাড়ি না পৌছা পর্যন্ত চলে খবর দেয়া নেয়া। সম্পাদক খোজ খবর নেন। এযেন আত্মার সাথে আত্মার হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের বন্ধন। এ বন্ধন থাকুক অনন্তকাল ধরে। পরিবার থেকে পরিবারের মধ্যে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিলেট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ