Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জীবনের মূল্য : মানুষ বনাম গরু

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

হাইকোর্ট ৩ ফেব্রুয়ারি ‘নদী দখল’ সংক্রান্ত এক রিটের রায়ে বর্তমানে ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা’ অনুপস্থিতির প্রসঙ্গটি তুলেছেন। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে খবরাখবর লিখলে সমাজ উপকৃত হয়, অনেক অনিয়ম কমে যায়। হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণ খুবই তৎপর্যপূর্ণ। দেশে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রোনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় বিপ্লব ঘটলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। খবরের পিছনের খবর পাঠকদের জানানো এবং প্রকৃত তথ্য উৎঘাটনে সংবাদকর্মীদের মধ্যে যেন তেমন আগ্রহ নেই। যার জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন অঘটনের পর শত শত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়; কিন্তু কোনো তদন্ত খবর আলোর মুখ দেখে না। প্রকৃত তথ্য থেকে যায় মানুষের অজানা। পরিণতিতে আবার ঘটে একই ধরণের ঘটনা।
১২ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় বেতনা সীমান্ত এলাকার বহরমপুর গ্রামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময় অন্তত ২০ জন আহত হন। ঘটনার পর নিহত ব্যাক্তিসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অথচ গ্রামবাসীরা মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেয়নি। আতঙ্কিত গ্রামের মানুষ গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুরুষশূন্য গ্রামে নারীরা ভীতিকর পরিবেশে বসবাস করছে। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে রিটও দায়ের করা হয়েছে।
গ্রামবাসীর ভাষ্য, ঘটনার দিন হরিপুর উপজেলার বহরমপুর গ্রামের হবিবুর রহমান মেয়ের বিয়ের অর্থ জোগার করতে গরু নিয়ে বিক্রির জন্য যাচ্ছিলেন যাদুরানী হাটে। পথে বিজিবির বাধার মুখে পড়েন। দু’সাপ্তাহ আগে তিনি যে গরু কিনেছিলেন সে কাগজপত্রও দেখানো হয়। কিন্তু বিজিবির সদস্যরা গরু ছাড়েনি। বিজিবির বেতনা ক্যাম্পের সদস্যরা গরুগুলো ভারত থেকে চোরাচালান করে আনা হয়েছে মনে করে জব্দ করেন। এ নিয়ে বিজিবির সদস্যদের সঙ্গে গ্রামবাসীর বাক্বিতন্ডা হয়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। সংঘর্ষে বিজিবি গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে দু’জন পরবর্তীতে একজনের মৃত্যু ঘটে। ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদের ভাষ্য চোরাচালানী চারটি গরু জব্দ করে বিজিবির সদস্যরা ক্যাম্পের দিকে ফিরছিলেন; তখন চোরাকারবারিরা তাঁদের উপর হামলা চালায়। বিজিবির সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হন। স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঘটনার সুস্থ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ গ্রামবাসীর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন।
প্রশ্ন হলো গরুর জীবনের মূল্য বেশি না মানুষের জীবনের মূল্য? দু’তিনটি গরু ধরতে সংঘর্ষে তিনজন মানুষকে হত্যা করা হলো। এ দায় কার? ইতোমধ্যেই ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্টেট নূর কুতুবুল আলম, সদস্য পীরগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, হরিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ঠাকুরগাঁও সেক্টর সদর দপ্তর বিজিবি’র সহকারি পরিচালক, ঠাকুরগাঁও পাবলিক প্রসিকিউটর, হরিপুর থানার ওসি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তদন্ত কমিটিতে তাকে রাখায় এলাকার মানুষ তদন্ত কমিটিতে ঠাকুরগাঁও সেক্টর সদর দপ্তর বিজিবি’র সহকারি পরিচালককে না রাখার দাবি জানিয়েছেন।
গরুর জন্য এই যে তিনজন মানুষের প্রাণ গেল, এলাকার পুরুষ গ্রামছাড়া, আতঙ্কিত গ্রামবাসী উদ্বেগ উৎকন্ঠায় দিনযাপন করছেন; মিডিয়াগুলো যেন দায়সারা গোছেন রিপোর্ট করেই দায়িত্ব সেরেছে। হাইকোট অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু মিডিয়া সেক্টরে বিপ্লবঘটার পরও মিডিয়াগুলো কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করছে? প্রতিটি অপ্রীতিকর ঘটনার অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ সময়ের দাবি, এটা প্রকাশ সাংবাদিকদের জন্য নৈতিকতাও বটে। দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে ইদানিং নতুন ট্রেডিশন চালু হয়েছে। তা হলো দেশের কোথাও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমন হলে, নৃগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাসীরা আক্রমন করলে মিডিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লী, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে রামু, যাশোর, পাবনা, রংপুরের গঙ্গাচরায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার পর অনুসন্ধান করে নানান পন্থায় মিডিয়াগুলো রিপোর্ট করেছে। খবরের পিছনের খবর প্রচার করে বাহবা নিয়েছে। এটা খুবই ভাল এবং অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার হলে অধিকাংশ মিডিয়া সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ খবর মনে করেন না। সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অন্যায়-অবিচারের শিকার হলে তারা কি মিডিয়ায় কভারেজ পাওয়ার অধিকার রাখেন না? কথায় আছে ‘যার যায় সে বোঝে’। ঠাকুরগাঁয়ে বিজিবির গুলিতে যে পরিবারগুলো স্বজন হারালো তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, যন্ত্রণা অন্যের অনুভব করার দূরহ। কিন্তু রাষ্ট্রের তৃতীয় স্তম্ভ মিডিয়ার কি প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে নৈতিক দায়িত্ব এড়াতে পারে? হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সে জন্যই খুবই তৎপর্যপূর্ণ বটে।
সীমান্ত হত্যা আমাদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। ফেলানী হত্যার বিচার নিয়ে ভারতের প্রহসনের কাহিনী কে না জানে? ভারতের সঙ্গে পররাষ্ট্র নীতিতে নজতানু মানসিকতার কারণে ৫৪ নদীর পানিসহ নানাভাবে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে ভারত। সুসম্পর্কের অজুহাতে দিল্লি নিজেদের প্রয়োজনে সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে; বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাচ্ছে না। নেতানেত্রীরা দিল্লির অনুকম্পার জন্য অস্থির। ৩০ বছরের পানি চুক্তি করেও পদ্মায় পানি দিচ্ছে না; তিস্তা চুক্তির মূলা ঝুলিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ ধরে। সীমান্ত হত্যা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের অঙ্গিকার করেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। গত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর সীমান্তে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ। বিএসএফের হাত বাংলাদেশীদের রক্তে রঞ্জিত। কিন্তু সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বিজিবি’র হাতে দেশের নাগরিককে প্রাণ দিতে হবে! সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের ট্যাক্সের অর্থে যাদের বেতনভাতা দেয়া হয় তাদের হাতে রাষ্ট্রের মালিক নাগরিকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে?
বিজিবির দায়িত্ব সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষা করা। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তেই শুরু নয়, মিয়ানমার সীমান্তেও আমাদের নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। মিয়ানমার সেন্টমার্টিন দাবি করে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না। বিজিবিতে যারা চাকরি করেন তারা এদেশের সন্তান। আমাদের কারো ভাই কারো ছেলে আরো আত্মীয়-স্বজন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে পিলখানায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বিজিবির (তখন বিডিআর) জোয়ানরা। আধা সামরিক বাহিনীর হওয়ায় দেশের আইন শৃংখলা রক্ষাসহ নিরাপত্তা কাজেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এই বাহিনী। যদিও ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে দেশের ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করে দেশবাসীর ঘৃণা কুড়িয়েছে। পিলখানা হত্যাকান্ডের পর বাহিনীটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু নাম পরিবর্তনের সঙ্গে আচরণের পরিবর্তন হয়েছে কি? ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের বেতনা সীমান্তের বহরমপুর গ্রামে যে ভাবে গ্রামবাসীর ওপর গুলি ছুঁড়েছে তা কি স্বাভাবিক ঘটনা? সীমান্ত পাহারা দেয়া যাদের দায়িত্ব যাদের; দেশের অভ্যন্তরে হাট-বাজারে নাগরিকদের গরু কেনাবেচার দেখভাল বিজিবির দায়িত্বে পড়ে? স্থানীয় সংসদ সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা বক্তব্য ঘটনার সুস্থ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। অপ্রিয় হলেও সত্য পিলখানা হত্যাকান্ডের কারণে জনগণের কাছে বিজিবির ইমেজ তলানীতে। বিজিবির ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনেই বহরমপুরের ঘটনার সুস্থ তদন্ত হবে মানুষে সে প্রত্যাশাই করে। একই সঙ্গে মিডিয়া কর্মীদেরও উচিত অন্যান্য অঘটনের মতোই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে হরিপুরের বেতনা সীমান্তের বহরমপুরে বিজিবি-গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনার প্রকৃত চিত্র উদঘাটন করা। পরবর্তীতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে জন্যই নির্মোহ ও নিরপেক্ষ চিত্র জনগণের সামনে উঠে আসা উচিত। বহরমপুরের মানুষ মনে করছে বিজিবির কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে গরুর জীবনের মূল্য অনেক বেশি। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ