Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাজধানীর দুর্নাম ঘুচবে কবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৯, ১২:১১ এএম

রাজধানী ঢাকা অনেক আগেই বসবাসের অনুপযোগী শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অসভ্য নগরীর খেতাব পেয়েছে। যানজট, বায়ুদূষণসহ নাগরিক সেবার ন্যূনতমও এ শহরে মিলছে না। এটি এমন এক শহর, যেখানে যা খুশি তাই করা যায়। যে যেভাবে পারছে, একে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলো যথাযথভাবে কাজ করছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেক দিনের। নগরটির অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ দেখলেও বোঝা যায়, এর কোনো অভিভাবক নেই। এভাবেই চলছে দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা। সম্প্রতি বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিও ট্র্র্যাফিক ইনডেক্স-২০১৯ প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, যানজটের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের এক নম্বর শহর। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাকে এদিক থেকে টপকে গেছে। এতদিন ঢাকার পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ এবং সার্বিকভাবে অনুপযোগিতা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হলেও যানজট নিয়ে এবারই প্রথম জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য এই জরিপ প্রকাশ না করলেও একজন সাধারণ মানুষ অনেক আগে থেকেই জানে, ঢাকার মতো যানজটের শহর বিশ্বে আরেকটিও নেই। নামবিও জরিপ প্রকাশ করে তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল মাত্র। ঢাকার যানজট সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য ইতোমধ্যে অনেক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভারও নির্মাণ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এসব ফ্লাইওভারও যানজট নিরসন করতে পারছে না। উল্টো ফ্লাইওভারেই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বলা যায়, যানজট এখন ভূমি থেকে উপরে উঠে গেছে। এতে ফ্লাইওভারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে মেট্রোরেলের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এটি যানজট কমাতে কতটা সহায়ক হবে তা নির্মাণের পর বোঝা যাবে। তবে ঢাকায় যেভাবে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা চলছে, তাতে যানজট কমার কোনো কারণ থাকতে পারে না। নিয়ম-শৃঙ্খলা মান না হলে শহর যতই পরিপাটি হোক না কেন, সেখানে অরাজকতা থাকবেই। নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকলে যে যানজট থাকে না, তা ঢাকা ক্যান্টনম্যান্টের ভেতরে যারা চলাচল করেন, তারা বুঝতে পারেন। এই রাজধানীর মধ্যেই এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মনে হবে, এ এক আলাদা জগৎ, যেখানে পরিকল্পিত ও শৃঙ্খলভাবে যান চলাচল করছে। আসলে নিয়ম-শৃঙ্খলা যদি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এ কথা সত্যি, ঢাকায় যানবাহন চলাচলের জন্য যে পরিমাণ সড়ক প্রয়োজন, তা নেই। তারপরও বিদ্যমান সড়ক যদি কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমে ব্যবহার করা যায়, তবে যানজট অনেকটা সহনীয় হতে পারে।
দুই.
পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত ও অসভ্য নগরী হিসেবে দুর্নাম হলেও ঢাকা আমাদের প্রাণের শহর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিকসহ সবকিছুরই প্রাণকেন্দ্র। যত সমস্যাই থাকুক, ঢাকা ছেড়ে কেউ যেতে চায় না। সারা দেশের মানুষ ঢাকার দিকেই তাকিয়ে থাকে। কোনো রকমে ঢাকায় থাকার মতো ব্যবস্থা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। এই প্রবণতার কারণে প্রতিদিন ঢাকামুখী মানুষের ঢল নামছে। হু হু করে বাড়ছে এর জনসংখ্যা। এখন ঢাকায় বসবাস করে সরকারি হিসেবেই প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের দিকে এ জনসংখ্যা দাঁড়াবে আড়াই কোটি। হবেই বা না কেন? প্রতিদিন যদি সারা দেশ থেকে আড়াই-তিন হাজার মানুষ প্রবেশ করে, তবে ঢাকার জনসংখ্যা তিন-চার কোটিও হতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা নগরীর প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় তিন হাজার লোক বসবাস করে। বিশ্বে এমন ঘন বসতিপূর্ণ শহর আর একটিও নেই। একটি আদর্শ রাজধানীর সুযোগ-সুবিধা কেমন, এখানের বাসিন্দাদের তা জানা নেই। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সিটি করপোরেশনসহ যেসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো পরিচালনার জন্য নগরবাসী ট্যাক্স দিলেও তারা এ অনুযায়ী ন্যূনতম সেবা পাচ্ছে না। নগরবাসীর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার দায়িত্ব যে ওয়াসার, প্রতিষ্ঠানটি তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তার সরবরাহকৃত পানি ময়লা-আবর্জনা, ঘোলা ও দুর্গন্ধযুক্ত। এ পানি পান করা দূরে থাক ঠিকমতো রান্না-বান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়া ও গোসল করা মুশকিল। ঢাকা শহরের কতভাগ মানুষ ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি পান করে, তার পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই দূষিত পানিই ওয়াসা বেশ চড়া দামে নগরবাসীর কাছে বিক্রি করছে। অথচ আমাদের মতো অনেক দেশেই সরকারিভাবে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তা নিঃশংসয়ে মানুষ পান করে। উন্নত বিশ্বের নাগরিকরা তো সরাসরি ট্যাপের পানি পান করে। পরিতাপের বিষয়, মিষ্টি পানির অফুরন্ত ভান্ডারের দেশ হওয়া সত্তে¡ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ওয়াসার কাজ শুধু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাই নয়, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ঠিক রাখা। ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেমের কী করুণদশা তা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই বেশিরভাগ সড়কে হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি জমে যায়। রাজধানীর যে চিরায়ত যানজট, এ জট তীব্র আকার ধারণ করে বৃষ্টির সময়। রাস্তায় জমে থাকা পানির কারণে মানুষ চলাচল দূরে থাক যানবাহনও চলতে পারে না। বাধ্য হয়ে চলতে গিয়ে খানাখন্দ ও ওয়াসার খোলা ম্যানহোলে পড়ে অনেককে হতাহতও হতে হয়। আমরা দেখেছি, ওয়াসার ম্যানহোলে পড়ে শিশুর করুণ মৃত্যু হতে। আবার জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতের ছেঁড়া তারে জড়িয়ে মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটেছে। এসব প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এমনকি ন্যূনতম দুঃখও প্রকাশ করে না। এ ধরনের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা কি সভ্যতার মধ্যে পড়ে? যানজটের দিক থেকে ঢাকা এখন শীর্ষে। বলা হয়, যানজটই ঢাকাকে অচল ও স্থবির একটি শহরে পরিণত করেছে। শুধু যানজটে আটকা পড়ে ঢাকা শহরে প্রতিদিন মানুষের প্রায় ৮০ লাখ শ্রমঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এই শ্রমঘন্টার মূল্যমান গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা। কারো কারো মতে আরও বেশি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে যদি শুধু যানজটের কারণে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান হয়, তবে উন্নয়নের চাকাটি সচল থাকবে কিভাবে? যদি এ অর্থ ক্ষতি না হতো, তাহলে দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো-এ চিন্তাটি কেউ করছে বলে মনে হয় না। সরকারের নীতি-নির্ধারকদেরও যেন কোনো মাথাব্যাথা নেই। যানজটে যে শুধু আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, মানুষের কাজকর্মও স্থবির করে দিচ্ছে। যে কাজ এক ঘন্টায় শেষ হওয়ার কথা, সে কাজ করতে চার-পাঁচ ঘন্টা, এমনকি দিনও চলে যায়। এতে কর্মজীবী একজন মানুষের যে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, এর দায় কেউই নেয় না। গুরুতর রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে যথাসময়ে হাসপাতালে পৌঁছানো তো এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের একমুহূর্ত বিলম্ব করার সুযোগ নেই, সেখানে যানজটে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এ দৃশ্য কোনো দেশের রাজধানীতে দেখা যায় কিনা, জানা নেই। ঢাকায় এ চিত্র নিত্যদিনের এবং অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও অহরহ ঘটছে। এসব খবর খুব কমই নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায়। অথচ যে রোগী মৃত্যুবরণ করে সে যদি একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হন, তাহলে সে পরিবারটির কী দুর্দশা হয়, তা আমরা কজনই বা খোঁজ রাখি! বলা হয়, যানজটের অন্যতম কারণ ঢাকা শহরের রাস্তা-ঘাটের স্বল্পতা। একটি আদর্শ নগরীতে সড়ক পথের জন্য শতকরা ২৫ ভাগ জায়গা থাকতে হয়। ঢাকায় আছে মাত্র ৭ ভাগ। এই সড়ক দিয়েই প্রতিদিন লাখ লাখ যানবাহন যাতায়াত করে। এই সড়কেরও একটি বিরাট অংশ বেদখল হয়ে আছে। পরিস্থিতি যদি এই হয়, তবে যানজট থেকে কোনো দিনই মুক্তি মিলবে না। বড় বড় ফ্লাইওভারও খুব একটা কার্যকর হবে না। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, বিদ্যমান সড়কও যদি যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবহার করা যেত, তাহলে যানজট কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে থাকত। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কাজটি করবে কে? এ দায়িত্ব প্রতশত সিটি করপোরেশনের হলেও, তারা কি তা করতে পারছে? উল্টো এমন চিত্র দেখা যায়, সড়ক দখলমুক্ত করার পরিবর্তে সিটি করপোরেশন ফুটপাতে দোকানপাট বসা এবং মূল রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের অনুমতি দিচ্ছে। এমনকি সিটি করপোরেশন এ বিষয়টিও আমলে নিচ্ছে না যানজটের অন্যতম কারণ যে রিকসা, সেই রিকসা চলাচলে সে যে লাইসেন্স দিয়েছে, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি রাস্তায় চলাচল করছে। তার অনুমোদিত ৮০ হাজার রিকসার পরিবর্তে চলাচল করছে কয়েক লাখ। এই ধীরগতির যানটি মূল সড়কে যেমন খুশি তেমনভাবে চলছে। বিশ্বের কোনো দেশে দ্রুতযান ও ধীরগতির যান একসাথে চলাচলের এমন দৃশ্য দেখা যায় না। ডিজিটাল যুগে এসে যদি রাজধানীকে রিকসার রাজধানীর পরিচিতি নিয়ে থাকতে হয়, তবে এর চেয়ে পরিতাপের আর কি হতে পারে? রাজধানীতে নাগরিকদের জন্য আরও যে মারাত্মক দুটি ঘাতক রয়েছে তা হচ্ছে-শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ। এ ব্যাপারে সরকার তো বটেই কেউই সচেতন নয়। অথচ ঢাকা দূষণের নগরী হিসেবেও বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। এই দুই দূষণে নগরবাসী নীরবে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, ক্যান্সার, অ্যাজমা ও বধিরতাসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় যারা বসবাস করছে, তারা যেন অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা একটি জেলখানায় বসবাস করছে। যেখানে সভ্য নগরী ও তার নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা খুবই অপ্রতুল এবং কষ্টসাধ্য।
তিন.
একটি দেশ কতটা উন্নত তার পরিচয় ফুটে উঠে তার রাজধানীর চিত্রের মাধ্যমে। রাজধানীকে বলা হয়, দেশের মুখ। মানুষের মুখ দেখে তার রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, আনন্দ-বেদনা যেমন বোঝা যায়, তেমনি রাজধানীর চেহারার মাধ্যমে দেশের সার্বিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ, তা ধনী হোক আর দরিদ্র হোক, রাজধানীকে পরিপাটি রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করে না। আর যাই হোক, রাজধানীকে সুন্দর করে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে হবে। কারণ হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে নামী-দামী ব্যক্তিবর্গ ও পর্যটকরা রাজধানীতেই আসেন। রাজধানীর চেহারা দেখে তারা দেশটির উন্নতি, অগ্রগতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারেন। আমরা যদি পর্শ্ববর্তী ভারতের কথা ধরি, তাহলে দেখা যাবে, রাজধানীসহ বড় বড় শহরগুলো বেশ পরিপাটি করে গড়ে তোলা হয়েছে। ঝকঝকে ও চকচকে উপস্থাপন করে স্লোগান দিচ্ছে ‘সাইনিং ইন্ডিয়া’। অথচ দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ এখনও খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করে। যথাযথ স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই। শুধু রাজধানী ও কিছু শহরকে আধুনিক করে বিশ্বকে দেখাচ্ছে, তারা বিরাট উন্নতি সাধন করছে। কয়েক দশক আগেও আমাদের ঢাকার এমন দুরবস্থা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছর তিনেক আগে এক সভায় ঢাকাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। তার স্মৃতিচারণে ঢাকা কেমন ছিল, তার সুন্দর কিছু চিত্র উঠে আসে। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, আমরা যখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আসি, তখন আশপাশে ধানক্ষেত দেখা যেত। কেউ আসলে বলত ঢাকা থেকে এসেছি বা ঢাকা যাচ্ছি। সে সময় ধানমন্ডিকে ঢাকা বলে গণ্য করা হতো না। বসুন্ধরার এলাকাটি ছিল একটি বিল। আজকের পান্থপথটি ছিল একটি খাল। সেখানে শাপলা ফুটতো, নৌকা চলত। খালটি ধানমন্ডি লেক হয়ে নদী পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল। মতিঝিলের ঝিলে নৌকায় চড়েছি। আজকের যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তা ছিল রাজধানীর বাইরে। জাতীয় তিন নেতার কবরের সামনে ছিল ঢাকার প্রবেশ দ্বার ‘ঢাকা গেট’। সেই ঢাকা গেটের স্তম্ভ এখনও আছে। মহাখালি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল তো গ্রামেই গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন তা বোঝার উপায় নেই। তিনি বলেছিলেন, এখন ঢাকা প্রায় টাঙ্গাইল পর্যন্ত চলে গেছে। অচিরেই ময়মনসিংহ পর্যন্ত চলে যাবে। এভাবেই একটি শহর গড়ে উঠে। বলা বাহুল্য, যারা ঢাকার আদি বাসিন্দা তারা ঢাকার এ চিত্র সম্পর্কে ভালভাবেই অবগত। সময়ের সাথে সাথে এবং নাগরিক প্রয়োজনে নগরের পরিধি বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ পরিধি বৃদ্ধি ঘটাতে হবে মূল নগরকে ঠিক রেখে সুষম পরিকল্পনা এবং নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। ঢাকার পরিধি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, মূল শহরের কাঠামো ভেঙ্গে যে যেভাবে পেরেছে, সেভাবে এর সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। এক সময় ঢাকা শহরে প্রায় ৪৬টি খাল ছিল। এসব খালের অধিকাংশই এখন নেই। অবৈধ দখলের কারণে হারিয়ে গেছে। অথচ এই খালগুলোর কারণেই ঢাকা একসময় ‘জলেভাসা পদ্ম’ নামে পরিচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, রাজধানীর সব খাল দখল হয়ে যাওয়ায় নগরবাসীকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শহরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পান্থপথের খালটিকে মাঝে রেখে তার দুইদিকে রাস্তা করলে দেখতে যেমন দৃষ্টিনন্দন হতো, তেমনি জলাবদ্ধতা দূর করে পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো। এটিকে বক্স কালভার্ট করে শেষ করে দেয়া হয়েছে। সেগুনবাগিচা ও শান্তিনগরের খাল দুটিকেও একই অবস্থা করা হয়েছে। রাজধানীর বায়ু দূষণ এবং নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য পার্ক অত্যন্ত জরুরী। এগুলোকে বলা হয় রাজধানীর ফুসফুস। ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি পার্ক থাকলেও অযত্ন ও অবহেলায় এগুলো বেহাল হয়ে রয়েছে। ইট-পাথরের ভবন থেকে বের হয়ে পার্কে গিয়ে যে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবে, তার উপায় নেই। রাজধানীর চির দুঃখ হয়ে রয়েছে, সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার নামে রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ি। তাদের এই সেবা বৃদ্ধিকরণ কর্মকাণ্ডে নগরবাসীর দুর্ভোগ স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। একটা সময় আমেরিকায় স্বর্ণ অনুসন্ধানের জন্য মানুষ শাবল-খুন্তি নিয়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করত। তাদের মতোই ঢাকার সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলো সেবার লক্ষ্যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করলেও সেবার পরিবর্তে নগরবাসী কেবল দুঃখই পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যেন রাস্তা খোঁড়ার পরিবর্তে সরকারি কোষাগার খুঁড়ে অর্থ বের করে নিচ্ছে।
চার.
বিশ্বের খুব কম রাজধানীতে একই সাথে প্রশাসনিক, আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পকারখানা থাকে। রাজধানীকে তারা যতটা সম্ভব আবাসিক এলাকা থেকে আলাদা করে রাখে। আবাসিক এলাকা থাকবে রাজধানীর মূল কেন্দ্র থেকে বাইরে। এক সময় ঢাকায় এই আদর্শ পরিবেশ ছিল। ধানমন্ডির কথা যদি ধরি তবে দেখা যায়, পঞ্চাশের দশকে আবাসিক এলাকা হিসেবে ধানমন্ডিকে মূল শহরের বাইরে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে তিন বিঘা করে একেকটি প্লট এবং এতে পঞ্চাশ জনের বসবাসের উপযোগী করে পরিকল্পনা করা হয়। পুরো ধানমন্ডির মানুষের সংখ্যা হিসেবে করে সেখানে স্কুল, খেলার মাঠ, পার্ক, লেক, মার্কেট ও প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। অর্থাৎ ঢাকার অদূরে একটি গার্ডেন সিটি হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। গুলশান, বনানী পরবর্তীতে উত্তরাও একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়। অর্থাৎ মূল শহর থেকে দূরে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলাই এর মূল পরিকল্পনা ছিল। কোনোকালে এসব এলাকা ঢাকার বাইরে ছিল এখন তা বিশ্বাসই করা যায় না। নগরীর সম্প্রসারণ এত দ্রুতই হয়েছে যে এসব এলাকা প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এ সম্প্রসারণ সুষমভাবে হয়নি। প্রভাবশালীরা যে যেভাবে পেরেছে নিজেদের মতো করে রাজধানীকে সম্প্রসারিত করেছে এবং করে চলেছে। এসব নিয়ন্ত্রণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলে যে একটি কর্তৃপক্ষ আছে, তার কার্যক্রম কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। যদি বাস্তব ক্ষেত্রে তার জোরালো ভূমিকা থাকতো, তাহলে রাজধানীর অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হতো। বোঝা যাচ্ছে, রাজধানীর এই অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ দায়িত্বরত কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা ঠেকাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ঠেকাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, নাগরিক সেবা বাড়াতে ঢাকাকে ভেঙ্গে আরও ছোট করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। রাজধানী যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাতে আরেকটি শহরের সাথে মিশে যাবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একটি দেশের রাজধানীর নির্দিষ্ট আয়তন থাকা দরকার। এই আয়তনকে কেন্দ্র করে অন্যান্য এলাকা স্বন্তন্ত্র ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এতে রাজধানী যেমন ভারমুক্ত হবে, তেমনি অনিন্দ্যরূপে গড়ে তোলাও সম্ভব। সবচেয়ে বড় বিষয়, ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রশাসনিক কোনো ছোটো-খাটো কাজ করতে দেশের আনাচ-কানাচ থেকে মানুষকে রাজধানীতে ছুটে আসতে হবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি উপলব্ধি করে যথার্থই বলেছিলেন, দেশের জনসংখ্যা ষোল কোটি। সবার কাছে সেবা পৌঁছে দিতে হবে। এজন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একান্তভাবে প্রয়োজন। রাজধানীর সেবা ও পরিকল্পনার কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর এ কথা উপলব্ধি করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার রাজধানী থেকে সরিয়ে কেরানীগঞ্জ নেয়া হয়েছে। হাজারীবাগ ট্যানারি শিল্প সাভারে নেয়া হচ্ছে। তেজগাঁও শিল্প এলাকা ও আবাসিক এলাকাকে আলাদাভাবে আধুনিক করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়কেও সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে রাজধানী যেমন ভারমুক্ত হবে, তেমনি একটি আদর্শ শহরে পরিণত হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজধানীর দুর্নাম
আরও পড়ুন