Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইলহান ওমর : মার্কিন রাজনীতির বাঁক বদলের কণ্ঠস্বর

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে ২০১৬ সালে মিনেসোটা ফিফথ ডিস্ট্রিক্ট কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৩৫ বছর বয়েসী কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম তরুণী ইলহান ওমর। পুরো নাম ইলহান আব্দুল্লাহি ওমর। ১৯৮১ সালে সোমালিয়ার রাজধানী মুগাদিসুতে জন্মগ্রহনকারী ইলহান ওমর নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করেন। সম্ভবত ইলহান ওমরই হচ্ছে প্রথম কোনো সোমালি-আমেরিকান নাগরিক যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার রাজনীতিতে নজিরবিহিন সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। মার্কিন রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র এবং মার্কিন সমাজের উপর ইহুদি লবি ও জায়নবাদি ইসরাইলের অনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন রাজনীতিতে ইলহান ওমর গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত চরিত্রে পরিনত হয়েছেন। প্রতিনিধি পরিষদে দেয়া ইলহান ওমরের যুক্তিনিষ্ঠ ও ওজস্বী বক্তৃতা মেইন স্ট্রীম মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার ও জনসমর্থন লাভ করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে নিওকন পলিটিসিয়ানদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পক্ষান্তরে মার্কিন ডেমোক্রেটরা একযোগে এবং ঐক্যবদ্ধভাবেই ইলমান ওমরের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছে। প্রতিনিধি পরিষদে ইলহান ওমরের দেয়া ধর্ম বিদ্বেষ, বর্ণবাদ বিরোধি একটি প্রস্তাব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ডেমোক্রেটদের এক হাত দেখে নিতে তাদেরকে ইসরাইল ও ইহুদি বিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। গণমাধ্যমে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প ইলহান ওমরের প্রস্তাব পাস হওয়ার ঘটনাকে লজ্জাজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। উল্লেখ্য প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩০ জন ভোটদাতার মধ্যে পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৪০৭ জন এবং বিপক্ষে দিয়েছেন মাত্র ২৩ জন। ইলহান ওমরই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের প্রথম আফ্রো-আমেরিকান মুসলিম নারী সদস্য যিনি সব বাঁধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে মাথায় হিজাব বেঁধে তার বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন। মুসলিম নারী হিসেবে হিজাব পড়ার অধিকার সমুন্নোত রাখার জন্যও ইলহানকে অনেক প্রতিবাদি কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। তবে সে সব বিতর্ক বিরোধিতার গ্যারাকল ডিঙ্গিয়ে ইলহান ওমর অনেক এগিয়ে গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি যে ইসরাইল ও জায়নবাদ বিরোধি বক্তব্য দিয়ে ইহুদি লবি ও রিপাবলিকানদের কাছ থেকে তীব্র বিরোধিতা ও বৈরিতার সম্মুখীন হয়েছেন, এই প্রস্তাব পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে ইলহান ওমরের বক্তব্য ও নীতিগত অবস্থানের প্রতি মার্কিন মাল্টি কালচারালিজম ও গণতান্ত্রিক শক্তির নিরঙ্কুশ সমর্থনের ভিত্তি প্রমানীত হল। সেই সাথে জায়নবাদি শক্তির তোড়জোর ও অনৈতিক উন্মাদনার নিরব পরাজয় নিশ্চিত হল। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এই ইউনিপোলার পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ একদিকে মার্কিন অর্থনীতির ধস ঠেকাতে পারেনি। অন্যদিকে বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, জাতিগত সামরিক সংঘাত, অস্থিতিশীলতা ও রক্তপাত বেড়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে তা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল পররাষ্ট্র নীতি। বিশেষত: মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব-ইসরাইল সংকটে ইসরাইলের পক্ষে মার্কিনীদের অন্ধ একপাক্ষিক নীতির প্রশ্নে অনেক সমালোচনা থাকলেও মার্কিন মূলধারার রাজনীতি বরাবরই ইহুদি লবি ও অর্থের কাছে কার্যত বন্দি হয়ে আছে। ইলহান ওমরে মত নতুন প্রজন্মের আফ্রো-আমেরিকান রাজনীতিকদের যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য এবং দৃঢ়-সাহসী অবস্থান মার্কিন রাজনীতিতে জায়নবাদী শক্তির আধিপত্য নড়বড়ে করে দিতে শুরু করেছে। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মার্কিন মাল্টি কালচারালিজমের স্বপক্ষে আব্রাহাম লিঙ্কন, মার্টিন লুথার কিং থেকে বারাক ওবামা পর্যন্ত যে স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে, ইলহান ওমর যেন সেই স্বপ্নেরই উত্তরাধিকার বহন করছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসী বাহিনীর অন্যতম টার্গেট ছিল ইউরোপ থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করা। জার্মানীতে হিটলার উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রবর্তক হলেও তিনি ধর্মান্ধ খৃষ্টান বা মুসলমান ছিলেন না। তার ইহুদি বিদ্বেষের মূলে ছিল ইহুদিদের উগ্র জাতীয়তাবাদ ও পুঁজির উপর তাদের অশুভ নিয়ন্ত্রণ। তবে রোমান সাম্রাজ্যের কাল থেকে ইউরেশিয়ায় জনসংখ্যার দিক থেকে কখনোই ইহুদিরা ধর্তব্যের মধ্যে না থাকলেও যুগে যুগে তারা স্থানীয় জনগণ ও রাজশক্তির প্রবল বৈরীতার শিকার হওয়ার পেছনে অভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতাকেই চিহ্নিত করা যায়। ষোড়শ শতকে ইংরেজ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার যেমন ইহুদিদের নেতিবাচক জাতীয় চরিত্র সম্পর্কে সাহিত্য রচনা করে গেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র দার্শনিক কার্লমার্ক্সও বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে ইহুদি জাতির বিরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিবন্ধ লিখে ধারনা দিয়েছেন। সর্বযুগেই ইহুদিরা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সমাজের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত আড়াই হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধুমাত্র স্পেনের আন্দালুসিয়ায় মুসলমান খিলাফতের প্রায় দুইশ বছরের শাসনকাল বাদ দিলে রাষ্ট্রশক্তির হাতে ইহুদিদের নিগ্রহের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই। পশ্চিমা ঐতিহাসিকেরা কর্ডোভা খিলাফতের সময়কালকে ইহুদিদের জন্য গোল্ডেন এজ বা স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেন। খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমানের পুত্র দ্বিতীয় আল হাকামের মৃত্যুর পর কর্ডোভা খেলাফত দুর্বল হয়ে তা বহুধা রাজশক্তিতে বিভক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইহুদিদের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে। ইউরোপে ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর আবারো চরম বিপর্যয় নেমে আসে পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে আলহামরা ডিক্রির মধ্য দিয়ে। কর্ডোভা খিলাফতের পতনের পর থেকে নেমে আসা বিপর্যয়ের চরম পরিনতি ঘটে এই ডিক্রির মাধ্যমে। স্পেনের খ্রষ্টান ক্যাথোলিক শাসক শাসকরা ১৪৯২ সালে আলহামরা ডিক্রি জারি করে ইহুদিদের দেশ ত্যাগ অথবা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণের নির্দেশ জারি করেন। পর্তুগালের ইহুদিদের জন্য ১৪৯৬ সালে একই ধরনের ডিক্রি জারি করা হয়। তবে শত শত বছরের মুসলমান শাসনে কখনোই মুসলিম খলিফারা ইহুদি বা অন্য কোন সম্প্রদায়ের জন্য এ রকম কোনো ডিক্রি জারি করার নজির নেই। ভারতের হিন্দুত্ববাদি রাজনীতিক ও সাধারণ হিন্দুদের কেউ কেউ এ দেশে মুসলমান শাসকদের শাসন ও ধর্মপ্রচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে জবরদস্তি বা তলোয়ারের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক তুললেও ইতিহাসের বিচার-বিশ্লেষণে তাদের এ ধরনের দাবী ধোপে টিকে না। এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাতাত্তি¡ক পন্ডিত, অধ্যাপক শেলডন পোলক বলেছেন, মুসলমান শাসকরা যদি জোর করে হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা করত তবে আটশ বছরের মুসলমান শাসনের পর ভারতে কোনো হিন্দুই থাকতো না। আজ একোবিংশ শতকে এসে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও মুসলমান ও ইসলাম বিদ্বেষের রাজনীতি শুরু হয়েছে মুসলমান সুলতান বা মোঘল শাসনে তা চিন্তার বাইরে ছিল। পক্ষান্তরে গত আড়াই হাজার বছরের মধ্যে ইহুদিরা কোনো রাষ্ট্র গঠন করতে না পারলেও বিংশ শতাব্দীতে এসে নাৎসী জার্মানদের ইহুদি বিদ্বেষ, তথাকথিত হলোকষ্টের ঘটনার অতিরঞ্জিত প্রচারনা এবং বিতাড়িত ইহুদিদের পুনর্বাসনের জন্য মুসলমানদের জমি দখল করে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা এবং যুদ্ধের প্রলম্বিত রক্তক্ষয়ী ঘটনাবলীর সাথে ইহুদিদের জায়নবাদি পরিকল্পনা ও সুগভীর ষড়যন্ত্রের যোগসাজশ এখন অনেকটাই স্পষ্ট। বৃটিশ ও আমেরিকান অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ফিলিস্তিনী মুসলমানদের গ্রাম ও শহরগুলো দখল করে বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সামরিক সংঘাতের পেছনে কোনো না কোনোভাবে ইসরাইল ও এর গোয়েন্দা সংস্থার যোগসুত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথম মহাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল সারায়েভোর রাজপথে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় আর্চডিউক ফার্দিনান্দের গুলিবিদ্ধ হওয়া। এই ঘটনার কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয়েছিল কি , সে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল? তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার দায় আল কায়েদার উপর চাপিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা অন্তহীন যুদ্ধ শুরু করার প্রায় দুই দশক পর দেখা যাচ্ছে, এই যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বে সন্ত্রাস বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে অস্ত্রের ব্যবসা। এই অস্ত্র ব্যবসার বড় অংশই যাচ্ছে পশ্চিমা মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিনিয়োগকারীদের হাতে, এর বড় অংশই জায়নবাদি ইহুদিদের হাতে। তবে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলা ও নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পেছনে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকার তথ্য বিভিন্ন ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং রিপোর্টে জানা গেছে। তবে সবচেয়ে বিষ্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, পুঁজিবাদী বিশ্বের সাংস্কৃতিক- অর্থনৈতিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত নিউ ইয়র্ক শহরটি এখন অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে গত এক দশকে শত শত বিলিয়ন ডলারের বেইল আউট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হলেও নিউ ইয়র্কের মত এমন গুরুত্বপূর্ণ বহুজাতিক শহর দেউলিয়া হয়ে গেল কেন? গত শনিবার নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার শীর্ষ শিরোনাম ছিল ঋণ পরিশোধে অক্ষম বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ নাগরিকরা দলে দলে নিউ ইয়র্ক শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। নিউ ইয়র্কের এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত হওয়ার সমুহ আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের সাথে জায়নবাদি ইহুদিদের যোগসুত্র প্রমান করা কোনো দূরূহ নয়। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা গণহত্যা ও কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘাতের মধ্যেও ইসরাইলের নেপথ্য ভ’মিকার তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি ভারতীয় বিমান বাহিনীর হয়ে পাকিস্তানে হামলা করতে গিয়ে একজন ইসরাইলী পাইলট নিখোঁজ হওয়ার অসমর্থিত তথ্যও বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য থেকে বিশ্ব সভ্যতায় জায়নবাদী ইহুদি সম্প্রদায়ের ন্যক্কারজনক ভ’মিকার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিরা যতটা না মার্কিন স্বার্থের প্রতি আচারনিষ্ঠ তারা তারচেয়ে অনেক বেশী অনুগত জায়নবাদী ইসরাইলের প্রতি। আর এই ইহুদি লবি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে বিদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও সুনাম ক্ষুন্ন করছে। এই অভিযোগ নতুন নয়, মার্কিন ও পশ্চিামা স্বার্থ বিরোধী ও যুদ্ধবাদী ভ’মিকার কারণে পশ্চিমা বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিডিএস (বয়কট, ডিভেস্টেট এন্ড স্যাঙ্কশন টু ইসরাইল)আন্দোলন ক্রমে জোরদার হচ্ছে। এই আন্দোলনের কারণে ইসরাইলী অর্থনীতিকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হলেও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই আন্দোলনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। ইহুদি লবির প্রভাবে অনেক মার্কিন রাজ্য ইতিমধ্যে বিডিএস আন্দোলন বিরোধী রেজুলেশন পাস করার উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে। ইলহান ওমরের প্রস্তাবিত রেজ্যুলেশনটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। বিডিএস আন্দোলনকে ইহুদি লবি যেভাবে প্রচার করতে চাইছে, হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস থেকে পাস হওয়া রেজুলেশনটি তার শক্ত জবাব। বিডিএস ইহুদি বিদ্বেষ নয়, ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলী গণহত্যা, অবৈধ ইহুদি সেটেলমেন্ট এবং মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের প্রতিবাদে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈতিক অবস্থানের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। অন্যদিকে ইসরাইলী নেতারা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতাদের যেভাবে টার্গেট কিলিংয়ে হত্যা করছে, ঠিক একইভাবে বিডিএস আন্দোলনের নেতারাও টার্গেটেড কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। ২০১৬ সালে ইসরাইলের ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড এটোমিক এনার্জি মিনিস্টার ইসরায়েল কাজ্ব বিডিএস নেতাদের জন্য টার্গেটেড সিভিল এলিমিনেশনস বা টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশনের প্রস্তাব করেছেন। গত বছর ইজরাইলের মিনিস্ট্রি অব স্ট্রাটেজিক অ্যাফেয়ার বিডিএস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন দেশের বিডিএস কমিটির সদস্যদের ইজরাইলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইহুদিরা রাষ্ট্র গঠনের আগে তাদের জায়নবাদী রাজনীতির সাংগঠনিক প্লটফর্ম গঠনের আগে ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে মার্কস বাউয়ের ও কার্ল মার্ক্স পশ্চিমা সমাজে(বিশেষত জার্মানীতে) ইহুদিদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার দাবীর প্রশ্নে যে সব যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন পবর্তিতে তা ইহুদি প্রশ্নে নামক একটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। সে সময়ের ইহুদিদের সমাজ বাস্তবতা এবং খ্রষ্টধর্ম প্রভাবিদ রাষ্ট্রে তাদের নাগরিক অধিকারের যে সংকট দেখা দিয়েছিল তা কখনো মিমাংসা বা সমাধানের সুত্র খুঁেজ পাওয়া যায়নি। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদি শক্তি ব্যবহার করে ইহুদিদের রাষ্ট্রচিন্তার জটিল অবাস্তব ধারনা কোনোভাবেই শতকরা ১০ ভাগের কম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ ছিল না। সুদি ব্যবসায় শত শত বছরে জমানো ইহুদি অর্থ-সম্পদ দিয়েও ফিলিস্তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র আরব মুসলমানের সম্পদ হাত করা যায় নি। বৃটিশ রাজশক্তি ইহুদিদের জন্য আইনগত সুবিধা দিয়ে এবং অনৈতিক সামরিক শক্তি ব্যবহার করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের যে নীল নকশা গ্রহণ করেছিল, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের চরম বহি:প্রকাশ। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর ইহুদি হাগানা মিলিশিয়া বাহিনীর লুণ্ঠন, গণহত্যার মত যুদ্ধাপরাধের মধ্য প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল কখনোই আরব ও ফিলিস্তিনীদের সাথে রাজনৈতিকভাবে একটি সহাবস্থানমূলক স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করেনি। বর্বর অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই তারা সমগ্র আরব জাহানকে নিয়ে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের স্বপ্ন দেখেছে। আরব রাষ্ট্রগুলোকে খন্ড-বিখন্ড দুর্বল ও অকার্যকর করতে সব রকমের ফন্দি-ফিকির জবরদিস্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অনিচ্ছা ও ব্যর্থতার ইতিহাস যেন সভ্যতার বিপর্যয়ের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি শক্তির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সাতষট্টি সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে দখলকৃত ভ’মি নিয়ে নির্লজ্জ টালবাহানা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। পূর্ব জেরুজালেমসহ দখলকৃত ভ’মির উপর ইসরাইলের অধিকার জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে সর্বদা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। টু নেশন সলিউশনের ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন আরব-ইসরাইল সংকটের মধ্যস্থতা করার ভান করলেও ডোনাল্ড প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিনীরা সে অবস্থান থেকে সরে গিয়ে পূর্ব জেরুজালেম ও বায়তুল মোকাদ্দাসের উপর ইসরাইলী দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বের প্রায় দুইশ কোটি মুসলমান ও ওআইসিভুক্ত অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের চাইতে মার্কিন প্রশাসন মাত্র কয়েক মিলিয়ন ইহুদি জনগোষ্ঠির রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি একতরফা পক্ষপাতিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক আমেরিকার মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিকরা তাদের রাষ্ট্রের এই ভ’মিকা সমর্থন করছেনা। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে কপোর্রেট শক্তির যে ভিত্তি গড়ে উঠেছে সে সব থিঙ্কট্যাঙ্ক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী এবং কর্পোরেট মিডিয়ার চালকের আসনে বসে আছে ইহুদি জায়নবাদিরা। এরা মার্কিন জনগোষ্ঠির শতকরা ১ শতাংশেরও কম। এদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে মার্কিন অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি। এরই ধারায় মার্কিন সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির প্রভাবে পুরো বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে ওই ইহুদি লবি হাতের ক্রীড়নকের মত খেলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই বাস্তবতার পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে উঠে আসছেন ইলহাম ওমরের মত নতুন প্রজন্মের দৃঢ়চিত্ত রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা। ইলহাম ওমর যে পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছেন , সেখানে তাঁর পাশে নৈতিক-রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বার্নি সেন্ডার্স, কমলা হ্যারিস, এলিজাবেধ ওয়ারেনের মত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা। ইহুদি লবিস্টদের গলাবাজি ও এন্টি-সেমিটিজমের টাবু ভেঙ্গে দিয়ে শত শত ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নজির মার্কিন রাজনীতির মাইন্ডসেট পরিবর্তনের একটি যুগান্তকারী মাইল ফলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলহান ওমরের এগিয়ে যাওয়ার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তিনি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও বারাক ওবামার যোগ্য উত্তরসুরী ।
এ বছরের শুরুতে মিশিগান থেকে ডেমোক্রেটদলের মনোনয়ন নিয়ে প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন রাশিদা তৈয়ব। এভাবেই জায়নবাদি প্রতিরোধ ভেঙ্গে ইলহান ওমরদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটে চলেছে।
[email protected]



 

Show all comments
  • মোহাম্মদ আব্দুস সালাম ১৩ মার্চ, ২০১৯, ৮:২২ এএম says : 0
    ধন্যবাদ ইলহান ওমরকে। ইলহান ওমরের মত প্রতিনিধি মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হুক এবং জায়নবাদী ইহুদীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ভীমিকা পালন করুক মহান আল্লাহর নিকট এই কামনাই করি।
    Total Reply(0) Reply
  • ইলহান ওমরকে এত ভয় কেন ট্রাম্প্রের? ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৭:৪৪ পিএম says : 0
    একদিন পূর্ণাঙ্গ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন হবেই । ইস্রাইল পরাজিত হবেই হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মার্কিন

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন