Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

এটা স্বাধীনতার অপমান

সৈয়দ ইবনে রহমত | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

পার্বত্য তিন জেলার ২৫টি উপজেলার নির্বাচন ছিল সোমবার ১৮ মার্চ ’১৯। ভোট শেষে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট কেন্দ্র থেকে সন্ধ্যায় উপজেলা সদরে ফেরার সময় উপজাতি সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারসহ ৭ জন নিহত এবং অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। হতাহতদের মধ্যে বেশির ভাগই আনসার বাহিনীর নারী ও পুলিশ সদস্য। এছাড়াও ভোটগ্রহণকারী বেসামরিক কর্মকর্তারাও রয়েছেন। অপরদিকে, নির্বাচনের পরের দিন মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) সকালে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নির্বাচনী কার্যক্রম শেষ করে সুরেশ তার স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে ফারুয়া ইউনিয়ন থেকে নদী পথে বিলাইছড়ি সদরে ফিরছিলেন। স্ত্রী এবং ছেলেকে বোট থেকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে সুরেশকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একই দিন খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি থেকে ইউপি সদস্য হেমন্ত চাকমা (৪৫) এবং পানছড়ি থেকে অপর ইউপি সদস্য কঠিন কুমার ত্রিপুরা (৩৮)কে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সংঘটিত হলেও একই সূত্রে গাঁথা, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

নির্বাচনী পরিবেশ নিজেদের খেয়ালখুশি মতো প্রভাবিত করতে না পেরে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে ফেসবুকের মাধ্যমে হুমকি দেয়া হচ্ছিল আগে থেকেই। নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন উপজেলা নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দায়িত্ব পালন শেষে সাজেক থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে স্বাধীনতার মাসে জীবন দিতে হয়েছে সরকারি কাজে নিয়োজিতদের। এটাকে শুধুমাত্র সন্ত্রাসীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকান্ড ভেবেই বিচার-বিবেচনাকে স্থির রাখলে হবে না। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়েও ভাবতে হবে। এটা সরাসরি আমাদের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল; এটা আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের চরম ধৃষ্টতাও।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বেশকিছু আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে। তার মধ্যে উপজাতীয়দের চারটি সংগঠন বেশ সক্রিয়। তবে তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে সংগঠনটি সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে। কিন্তু তাদের একটি গ্রুপ আলাদা হয়ে শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে গঠন করে ইউপিডিএফ নামের সশস্ত্র সংগঠন। শুরু থেকে গ্রুপ দুটি পরস্পরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত হয়। তাদের উভয় গ্রুপের অপহরণ, চাঁদাবাজি, গুম, খুনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে পার্বত্যবাসী। এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)’র সভাপতি সন্তু লারমার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারিসহ স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে একটি গ্রুপ আলাদা হয়ে গঠন করে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে নতুন সংগঠন, জেএসএস (সংস্কার) নামেও তারা পরিচিত। সর্বশেষ শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফেও ভাঙনের সৃষ্টি হয়। তপন কান্তি চাকমা (বর্মা)’র নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন সংগঠন। এই চারটি সংগঠনের হাতেই মজুদ আছে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এদের মধ্যে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস (সন্তু) এবং প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের মধ্যে এককালে সাপে-নেউলে সম্পর্ক থাকলেও বর্তমানে তাদের মধ্যে একটা স্বার্থগত সমঝোতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এবং জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের মধ্যেও বোঝাপড়া দৃশ্যমান। চারটি সংগঠন দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম যেমন করছে, তেমনি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচনেও পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দিচ্ছে বা নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে। যাইহোক, এবারের ৫ম উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়িতে যেসব হত্যাকান্ড এবং অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং বাঘাইছড়ির সাজেক, খাগড়াছড়ির পানছড়ি এবং লক্ষীছড়ি ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা।
বাঘাইছড়ি উপজেলায় জেএসএস (সন্তু) এবং জেএসএস (এমএন লারমা) দুই গ্রুপের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিয়েছিল। নির্বাচনের দিন সকালে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের প্রার্থী বড়ঋষি চাকমা নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে বর্জনের ঘোষণা দেয়। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার সাথে সাথে এর পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকার ব্যাপারে হুঁশিয়ারিও দেয়া হয় তার পক্ষ থেকে। জেএসএস (এমএন লারমা)’র প্রার্থী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বলেন, ‘সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস (সন্তু)’র প্রার্থী বড়ঋষি চাকমা নিশ্চিত পরাজয় জেনে সকালে নির্বাচন বর্জন নাটক করার পর সন্ধ্যায় সরকারি কাজে নিয়োজিতদের ওপর এই নৃশংস হামলা চালিয়েছে।’ তিনি এই হামলার জন্য জেএসএস (সন্তু) ও ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের বাঘাইছড়ি উপজেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘এই ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ ওই এলাকায় আমাদের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম বা অবস্থান নেই। ওইটা পুরোটাই ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রিত এলাকা।’ ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের পক্ষ থেকেও নিজেদের দায় অস্বীকার করা হয়েছে। অন্যদিকে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপ বিলাইছড়ি উপজেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গাকে হত্যার সাথেও নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে নিশ্চিত হয়েছে, বাঘাইছড়ির হত্যাকান্ডের সাথে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সরাসরি জড়িত ছিল এবং তাদের ইন্ধন যুগিয়েছে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের ক্যাডাররা।
ইতিপূর্বে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে এলাকায় যে সংগঠনের প্রভাব বেশি সেখানে বিশেষ করে উপজাতীয় ভোটারদের ভোট সেই সংগঠনের প্রার্থীর পক্ষেই শতভাগ কাস্টিং হয় থাকে। কারণ, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের প্রার্থীর পক্ষেই স্থানীয় উপজাতীয় জনগণকে ভোট দিতে বাধ্য করত। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তাদের সেই একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদের প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়াও অনিশ্চিত হয়ে গেছে। যার সুস্পষ্ট প্রভাব যেমন একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেখা গেছে, তেমনি ৫ম উপজেলা নির্বাচনেও পরিলক্ষীত হয়েছে। নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকায় তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে না পারার ক্ষোভ থেকেই তারা নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর এই সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তারা হয়তো এই হামলার মাধ্যমে সরকারকে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, এসব এলাকায় তাদের ইচ্ছার বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন কোনো ভূমিকা না নেয়। এ কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় রাঙ্গামাটির মানবাধিকার কর্মী টুকু তালুকদারের কথায়। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এর মাধ্যমে হামলাকারীরা সরকারকে কোনো বার্তা দিতে চেয়েছে। যারা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে, এসব লোকদের ওপর এমন হামলা কখনও হয়নি। এটা আসলে তারা কি বোঝাতে চেয়েছে, সেটাও ভাবার বিষয়। আর সরকারের ওপর মানে এতজন সরকারের লোককে একসাথে মেরে ফেলা, এটাতো সরকারকে হুমকি দেয়া। পার্বত্য অঞ্চলে এপর্যন্ত যত হত্যাকান্ড হয়েছে, সেগুলো কেউ কখনও স্বীকার করেনি। সবাই জানে, এটা ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে এটা কখনও স্বীকার করা হয়নি।’
এসব হামলার পেছনে কারা জড়িত এবং কেনইবা তারা হামলা চালিয়ে সরকারি কাজে নিয়োজিতদের হত্যা করেছে সে ব্যাপারে নিশ্চয় কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই। ঘটনা যাই হোক, এটা আমাদের স্বাধীনতার অপমান, আমাদের সার্বভৌমত্বের অপমান। তার প্রমাণ, আমাদের স্বাধীনতার মাসে তারা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে, হত্যা করেছে সরকারি লোকজনকে। শুধু তাই নয়, এখানে অভিযুক্ত একটি গ্রুপের প্রধান সন্তু লারমা ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু তিনি কোনো জাতীয় দিবসেই আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক শহিদ মিনার কিংবা স্মৃতিসৌধে যাননি। ইউপিডিএফ তো পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে জুম্ম ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাই তাদের সন্ত্রাসীদের পক্ষে যা খুশি তাই করাটা কোনো ব্যাপার না। এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এত বড় ধৃষ্টতা দেখানোর সুযোগ সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে দেয়া উচিৎ কিনা।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন