Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাঙালির নববর্ষ

শামসুল ইসলাম সাদিক | প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৮ এএম

নদীর আছে গন্তব্য, মিশে যায় মোহনায়। ম্রিয়মান ছায়া পেছনে ফেলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনও বাড়ি যায়। অস্তমিত হয় শেষ বিকেলের সূর্য। সময় এমনি হয়। সেই সময়ের পথ ধরে পুরনো হয়ে গেলো আরো একটি গল্পের পান্ডুলিপি। কবির ভাষায়- বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক---/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভূলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাস্প সুদূরে মেলাক--। বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমাদের বাঙালির জাতীয় জীবনে অসা¤প্রদায়িক, সার্বজনীন প্রধান একটি উৎসব পহেলা বৈশাখ। এদিনটি প্রতিটি বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে উৎসব আমেজ আর ফুরফুরে বাতাসের দিন বসস্ত। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। জীর্ণ-শীর্ণ পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের আহŸানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিন, বাঙালির চিরায়ত উৎসবে মেতে ওঠার দিন, প্রাণ খুলে আনন্দে ভেসে যাওয়ার দিন। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শাস্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাঙালির নববর্ষ। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের এবং সব শ্রেণীর মানুষ এ দিনটি উদযাপন করে মহাধুমধামে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সমাজ, ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। এ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া অন্যান্য অনুষঙ্গ আমানি, রাজপুণ্যাহ, হালখাতা ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান যা আগের দিনে মাস জুড়ে চলতো। 

বাংলা নববষের্র সূচনা মুসলমানদের হাতে। মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে। মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে বাংলার কৃষকদের সুুুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা নববর্ষের যাত্রা খুব বেশি দিন আগের নয়। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের বছর ৯৬৩ হিজরি (১৫৫৬ ঈসায়ী) সনকে শুর‘র বছর ধরে ফসলী সন নামে যে সন প্রবর্তন করা হয় কালক্রমে তাই বাংলাদেশে বাংলা সন নামে পরিচিত লাভ করে। মূলত মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। তাই দেখা যায় বাংলা নববর্ষ সব বাঙালির হলেও উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশি । উলে­খ্য, হিজরি সন গণনা হয় রাসুলে পাক (সা.) এর মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হযরত ওমর (রা.) রাসূল (সা.) এর হিজরতকে স্মরণীয় রাখতে হিজরতের বছরকে ভিত্তি বছর ধরে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। পরে মুঘল সম্রাট আকবর তার সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউল­াহ সিরাজীর (দৈবে দশমরতœ) পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন।
জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এ সন প্রবর্তন করা হয়। এর আগে এদেশের দেশীয় সন হিসেবে শকাব্দের প্রচলন থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন চালু ছিল গোটা ভারতবর্ষে। আর এ কারণেই হিজরি সনকে ভিত্তি বছর ধরে এ বাংলা সনেরও প্রবর্তন করা হয়। অন্যদিকে এ সনের মাসের নামগুলো নেয়া হয় শকাব্দ থেকে। এভাবে দেখা যায় সনটি প্রবর্তনে এখানকার প্রধান দু’টি ধর্ম অর্থাৎ মুসলমান এবং হিন্দু উভয় ধর্মের একটি প্রভাব সনটির ওপর পড়েছে। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সকল সনের ক্ষেত্রেই এ ধর্মীয় প্রভাবের একটি দিক থাকে। বাংলা সনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমের এ মিলিত গ্রোত সনটিকে একটি অসা¤প্রদায়িক অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে যা উদার ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশি সংস্কৃতির সাথেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই এ সন প্রবর্তন করা হয়েছিল। ফলে সন প্রবর্তনের সময় থেকেই সাধারণ মানুষের সাথে এ সনের পরিচয় ও সম্পর্ক সুগভীর। আজও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে যদি জানতে চান আজ বাংলা কত তারিখ, তাহলে তিনি হাতের আঙ্গুলে গুণে আপনাকে কোন মাসের কত তারিখ তা বলে দেবেন। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পর দ্বিতীয় গুরুত্ব হ’েছ হিজরি সন বা চন্দ্র মাসের হিসাব। ইংরেজি সন গ্রামের মানুষের কাছে আজও ব্যাপক হারে স্থান লাভ করেনি। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হ’েছ। এ সনের হিসাব মতে এবং তা আজ পর্যন্ত এ নিয়মেই বিদ্যমান।
মুসলমানদের মিলাদশরীফ ও দোয়া অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা ‘বর্ষবরণ’ উদযাপনের উৎপত্তি ঘটে। আর ইংরেজ শাসনামল অবসানের পর কালক্রমে ‘নববর্ষ’ উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তীকালের ঘটনা বাংলা ‘নববর্ষ’ উদযাপনকে প্রাণবস্ত ও বিস্তৃত করেছে। অবশ্য সা¤প্রতিককালের ‘নববর্ষ’ বা ‘বর্ষবরণ’ ও আগের দিনের ‘নববর্ষ’ বা বর্ষবরণের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আস্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হ’েছ। বর্তমান সময়ের নববর্ষ উদযপানে পাস্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। এতে ধনী ও বিলাসী মানুুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের অস্তরে প্রকৃত সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহরের মানুষদের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিমতায় নিবীঢ় পল­ীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব অতল গহŸনে হারিয়ে যায়। শিল্পপতি, চাকরিজীবী ও টাকাওয়ালাদের উৎসবের গহŸনে পিষ্ট হয় বাঙালি কৃষকদের নববর্ষ উৎসব। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনাই হয়েছে বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষের মূলে কৃষক ও কৃষি।
বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায় মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো বাঁশের বেতের তৈজষ আর নানা জাতের খেলনা সামগ্রী, নারকেল মুড়কিসহ আরো কত কি থাকে এসব মেলায়- তার ইয়ত্তা নেই। মেলার সময়ে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর এমন কি মেলায় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান বসতো। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র আসতো বাপের বাড়িতে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ধুম পড়ে যেতো। বৈশাখী মেলায় আগের দিনে লাঙ্গল জোয়াল মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো মেলায়। এছাড়া জুড়ি-বুন্দি জিলাপি রসগোল­া ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের সমারোহ তো ছিল বেশ চমৎকার।
প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই জড়িত একটি বিষয় হল হালখাতা। তখন প্রত্যেকে চাষাবাদ বাবদ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। যা পরবর্তিতে ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানীরা সারা বছরের বাকীর খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুর‘ করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো গ্রাম গঞ্জে নববর্ষে হালখাতার হিড়িক পড়ে প্রত্যেক বাজার, বন্দর ও গ্রামগঞ্জে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নববর্ষ

১৪ এপ্রিল, ২০২২
১৪ এপ্রিল, ২০২২
১৪ এপ্রিল, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন