Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ওয়াসার পানি কতটা সুপেয়?

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৮ এএম

ওয়াসার পানি ‘শতভাগ সুপেয়’, ওয়াসার এমডি এ কথা বলে ফেঁসে গেছেন। যদি ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় হয় তবে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর প্রায় ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয় কী করে? একথাতোও ঠিক, ওয়াসার পানি সরবরাহে পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় অধিকাংশ গ্রাহককেই মটর দিয়ে পানি টানতে হয়। এতে যে অহেতুক ব্যাপক বিদ্যুৎ খরচ হয়, তার হিসাব টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়নি।
সবাই ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খায়, এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘জারের পানি ও বোতলজাত পানি তাহলে কোথায় যায়’। এখানে কিন্তু একটি ‘মহা শুভঙ্করের ফাঁকি’ লক্ষ্যণীয়। দেশে জারের পানি, বোতলজাত পানির যত কোম্পানি তারা, তারা কেউই একথা বলে না, আমরা ওয়াসার পানি থেকে সরবরাহ করে থাকি। তাহলে তারা নিশ্চিত বাজার হারাবে। বরং তারা প্রচার করে থাকে, আমরা গভীর নলকুপ থেকে পানি সরবরাহ করে থাকি। যদি ওয়াসার পানি শতভাগই সুপেয় হয়, তাহলে ওয়াসা অফিসসহ সরকারি সব অফিসে সরাসরি ওয়াসার পানি খাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয় না কেন?
বিভিন্ন সময় ময়লা, দূষণ, দুর্গন্ধ ও কালো পানি আসার কারণে ওয়াসার পানি সরাসরি খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না সচেতন কেউ। এজন্য প্রত্যেকেই পানি ফুটিয়ে খেয়ে থাকে। এতে গ্যাসের ব্যায় হয়। স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিবেচনায় পানি ফুটানোতে গ্যাসের ব্যয়কে ঠিক অপচয় বলা যায় না। অন্যদিকে অপচয়ও বটে। ওয়াসা শতভাগ সুপেয় পানি সরবরাহ করলে এই বিপুল গ্যাসের ব্যয় হতো না।
গ্যাসের অপচয় সম্পর্কে ওয়াসার এমডি বলেন, ‘টিআইবির গবেষণায় অপচয়ের কথা বলা হয়েছে কিন্তু রাজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বছরে ৪০০ কোটি টাকা এবং সিস্টেম লস কমানোর মাধ্যমে আরও ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করছে ওয়াসা। বিষয়টি টিআইবির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়নি।’ ওয়াসা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও সিস্টেম লস কমানোর মাধ্যমে আয় করছে এটা ভালো খবর। সরকারি অনেক খাত রয়েছে, যা অলাভজনক, সেবামূলক। কিছু রয়েছে লোকসানি। কিন্তু ওয়াসার রাজস্ব আয় লাভের চিন্তার চেয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাই অতি জরুরি। কেননা পানির সাথে সম্পর্ক রয়েছে মানুষের রোগ-ব্যাধিসহ এবং সুস্থতার।
সারা দিন কিছু না খেলেও পানি পান করতে হয়। এই পানি একদিকে আমাদের জীবন, আবার এই পানি আমাদের জীবননাশের কারণ হতে পারে। সাধারণত পানি যদি পানযোগ্য না হয়, বা দূষিত হয় তবে পানিবাহিত অনেক রোগ হতে পারে। পানিবাহিত রোগের মধ্যে ডায়রিয়া, আমাশয়, পোলিও, অধিকাংশ চর্মরোগ, হিপাটাইটিস এ ও ই, টাইফয়েড, প্যারাটাইপয়েড জন্ডিস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ডায়রিয়া এবং অন্যান্য পাকস্থলীর পীড়া, খাদ্যনালির প্রদাহ যে সব পরজীবীর কারণে ঘটে তাদেরকে পানিবাহিত বলে এবং এরা পানির মাধ্যমেই সংক্রমিত হয়। বাংলাদেশে সংঘটিত রোগব্যাধির শতকরা প্রায় পঁচিশ ভাগের কারণ দুষিত পানি পান।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে জনমানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করার সুযোগ আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির গণমানুষের চাহিদা ও দাবী উপেক্ষা করে কথা বলা ঠিক নয়। সামনে রমজান আসছে, বাজারে গেলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার প্রধান টেবিল চাপড়ে বিবৃতি দেবেন, ‘বাজার স্থিতিশীল’ এবং সেই সত্যই আমাদের মেনে নিতে হবে। এই নিয়মের পরিবর্তন কে করবে?
যে দেশে পৃথিবীর প্রায় ৯৮ শতাংশ প্রবাহমান প্রাকৃতিক মিঠা পানির উৎস্য রয়েছে, সেখানে বছরে শতকোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন দেশের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট আমদানি করাকেই অপচয় বলা যেতে পারে। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে যে মানুষ বাস করে, তা বিশ্বের কোনো কোনো রাষ্ট্রের সমান হবে। সীমিত লোকবল ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ওয়াসা ইউরোপ, আমেরিকা মানের সুপেয় পানি সরবরাহ করবে সে আশা করাই ভুল। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতেও ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানিগুলো সার্ভিস দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে শতভাগ সুপেয় না হোক, অন্তত নিরাপদ খাবার পানির দাবী একজন নাগরিক হিসেবে ওয়াসার কাছে প্রত্যেকেই করতে পারে ।
ওয়াসার পানি যে বিশুদ্ধ নয়, তা নগরবাসীর কাছে স্পষ্ট। ঢাকাবাসীকে ওয়াসার পানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। খাবার পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করলেও গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে সরাসরি পাইপলাইনের পানিই ব্যবহার করা হয়। থালা-বাসন ধোয়া, রান্নার কাজেও পাইপলাইনের পানি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাজেই এসবের ভেতর দিয়েও রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।
ঢাকা ওয়াসার পানি নি¤œমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করে। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয় ইত্যাদি। এ গবেষণা প্রতিবেদন দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। পরবর্তীতে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে করে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, ‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়’।
পরবর্তীতে ঢাকা ওয়াসার পানি কেমন, তা প্রতিষ্ঠানটির এমডিকে পান করানোর জন্য রাজধানীর কয়েকজন বাসিন্দা কাচের জগ ও বোতলে ওয়াসার পানি, গøাস, লেবু ও চিনির প্যাকেট নিয়ে ওয়াসা ভবনের সামনে হাজির হয়। রাজধানীতে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়াসার পানি কতটা ‘সুপেয়’, তা দেখানো ও সেই পানি দিয়ে শরবত তৈরি করে এমডিকে পান করানোর জন্য তারা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ওয়াসা ভবনে আসে।
টিআইবি এক গবেষণায় জানিয়েছে, ঢাকা ওয়াসার নি¤œমানের পানি ও পয়োনিষ্কাশন সেবায় রাজধানীর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি সেবাগ্রহীতা অসন্তুষ্ট। একই সঙ্গে ওয়াসার অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সেবন করে পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে নগরবাসী। টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেবাগ্রহীতার ৫১.৫ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি অপরিষ্কার এবং ৪১.৪ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযুক্ত বলে অভিযোগ করেছে। সেবাগ্রহীতাদের মতে, তাদের পরিবারের ২৪.৬ শতাংশ সদস্য পানিবাহিত কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর আগে গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরাঞ্চলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা ৮২ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকারক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ওই প্রতিবেদনের পর উচ্চ আদালতে একটি রিটও হয়েছিল।
রাজধানীবাসীর জন্য ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে প্রশ্ন অনেক পুরনো। ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, সেবার মান, দুর্নীতি, গ্রাহক সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি, অনিয়ম, সীমাবদ্ধতা, পানি সঞ্চালনের চারিদিকে অব্যাবস্থাপনার জাল, ইত্যাদি বিষয়ে অনুধাবন করতে গেলে বলতে হয়, এভাবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব নয়।
ওয়াসার পানি সুপেয় বা শতভাগ সুপেয় থাকা বড় কথা নয়! আসল কাজ হলো গ্রাহকের হাতের মুঠোয় পর্যন্ত নিরাপদ ও জীবাণুমুক্ত পানি পৌঁছে দেওয়া। ওয়সার পানি সরবাহের যে পাইপ লাইন আছে সেগুলোর বিভিন্ন ত্রæটি ও পুরনো সরবরাহ লাইন থাকার কারণে পানি গ্রাহকের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে তা পান করার অনুপযোগী হয়ে যায়। এজন্য ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি উৎস থেকে গ্রাহকের জলাধার (রিজার্ভ ট্যাঙ্ক) ও ভবনের ছাদের ট্যাঙ্ক পর্যন্ত পানি সম্পূর্ণ শতভাগ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ আছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত ও নিয়মিত তদারকি করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ওয়াসা

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন