Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আমেরিকা বনাম ভেনেজুয়েলা

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৯, ১২:১১ এএম

যুদ্ধের জন্য ঘুঁিট সাজাচ্ছে আমেরিকা। যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরো। নিজের শক্তি প্রদর্শনে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি পরিদর্শন করার সময় মাদুরো জানিয়েছেন, নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মহড়ার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ যুদ্ধের জন্য ঘুুঁটি সাজাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে লক্ষ্যে ভেনেজুয়েলায় এখন বেপরোয়া ঢঙে প্ররোচনা করে চলেছে ওয়াশিংটন। কোনো সন্দেহ নেই, মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি অসাংবিধানিক সরকার বসিয়ে দিতে চান সেখানে। এটি একটি অভ্যুখান, এই অভ্যুথান ভেনেজুয়েলার জনগণ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নিজেদের সার্বভৌমত্ব বাঁচাতে এবার যে-কোনো মূল্যে আমরিকার বিরোধিতা করতে প্রস্তুত ভেনেজুয়েলা। দেশের পরিস্থিতি আচমকাই বদলে গিয়েছিল গত ২৩ জানুয়ারি। সেদিন নিজেকে ভেনেজুয়েলার অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন বিরোধী নেতা হুয়ান গুইদো। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁকে ‘স্বীকৃতি’ দেয় আমেরিকা। এক টুইটবার্তায় ট্রাম্প বলেন, ‘ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি।’ একেবারে নিখুঁত ছকে বাঁধা। একই সঙ্গে, গুইদোকে সমর্থনের জন্য অন্যান্য দেশের কাছে ট্রাম্পের আরজি। মুহুর্তেই ব্রাজিল, কলম্বিয়া, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, আর্জেন্টিনা এবং প্যারাগুয়ে-লাতিন আমেরিকার সাতটি দক্ষিণপন্থি সরকারের সমর্থন। দেশের সামরিক বাহিনীর সমর্থন না পেলেও আমেরিকার বলয়ে থাকা একাধিক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হুয়ান গুইদো। দুই মার্কিন মিত্র ইসরাইল ও অষ্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকেও তাঁর প্রতি সমর্থন জানানো হয়। পাল্টা জবাবে ওয়াশিংটনের কূটনীতিকদের তিনি দেশ ছাড়তে ৭২ ঘণ্টা সময় দেন। মাদুরো বলেন, ‘ভেনেজুয়েলা ছাড়ো। আমাদের আত্মমর্যাদা রয়েছে।’ এতেই ঘুম ছুটেছে হুয়ান গুইদোর।
আসলে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট বিরোধীরা গণতন্ত্র রক্ষার নামে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্টতই তেল সমৃদ্ধ লাতিন আমেরিকার এই দেশটির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ওয়াশিংটনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সেজন্য চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিংসা ছড়াচ্ছে। গত ২ মে ২০১৮ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ৬৭ শতাংশ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন নিকোলাস মাদুরো। কিন্তু তারপরই শুরু হয় মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। তারা ভেনেজুয়েলার শীর্ষ আদালতে হেলিকপ্টার থেকে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। ভ্যালেন্সিয়া শহরে সেনাঘাঁটিতেও আক্রমণ চালিয়েছে। রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোকে হত্যা করে সেনা অভ্যুথানের মাধ্যমে ভেনেজুয়েলার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রও হয়েছিল, যাতে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩০ জন সেনা কর্মকতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে তিনজন বিমান বাহিনীর জেনারেল। ভেনেজুয়েলার সরকার জানিয়েছে, সেনা অভ্যুত্থানের ছকের পিছনে বিরোধী পক্ষের নেতা-নেতৃত্বদের একাংশের এবং সেই সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের হাত থাকার প্রমাণ মিলেছে। শুধু তাই নয়, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ রক্ষার অজুহাতে ওয়াশিংটন মদত জোগাচ্ছে ভেনেজুয়েলার চরম দক্ষিণপন্থী দাঙ্গাকারীদের, যাদের ন্যাশনাল এনডাওমেণ্ট ফর ডেমোক্র্যাসি এবং ইউএসএইচ- এর মতো মার্কিন সংস্থাগুলোর উপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে ওয়াশিংটন। তারা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সরকারবিরোধী প্রচার চালিয়ে সা¤্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের প্ররোচনা দিচ্ছে।
সা¤্রজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ভেনেজুয়েলার প্রগতিশীল মানুষ দেশরক্ষায় সরব হয়েছেন। রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান ও চীন মাদুরোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ফোন করে মাদুরোকে জানিয়েছেন, ‘ভাই মাদুরো, আত্মবিশ্বাস রাখুন, তুরস্ক আপনার সঙ্গে আছে।’ তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন ইংরেজিতে ‘উই আর মাদুরো’ বা ‘আমরা মাদুরো’ লিখে হ্যাশট্যাগ দিয়েছেন। বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেস বলেছেন, দক্ষিণ আমেরিকা আর আমেরিকার আঙ্গিনায় পরিণত হবে না। মাদুরোর পাশে দাঁড়িয়েছে কিউবাসহ মেক্সিকো, নিকারাÐয়া, উরুগুয়ে, এল সালভাদোর। স্বাভাবিকভাবেই নড়েচড়ে উঠেছে হোয়াইট হাউসও।
ইতোমধ্যে মাদুরোকে উৎখাতের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন চেয়েছে আমেরিকা। মাদুরোকে উৎখাতের প্রস্তাবে আগে থেকেই বিরোধিতা করে আসছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া। আর মাদুরো কৌতুকের সুরে মন্তব্য করেছেন, তিনি নিজেও চান নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা অনুষ্ঠিত হোক। এতে তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার তথ্য সকলের সামনে তুলে ধরা যাবে। মাদুরো জানেন, ভেনেজুয়েলার বলিভারীয় সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে তাঁর পাশে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভøাদিমির পাদরিনোলোপেজ জানিয়ে দিয়েছেন, সশস্ত্র বাহিনী কখনোই চাপিয়ে দেওয়া অন্তবর্ত্তী রাষ্ট্রপতিকে মেনে নেবে না। এক টুইটে তিনি আরও বলেছেন, বরং সশস্ত্র বাহিনী রক্ষা করে যাবে ভেনেজুয়েলার সংবিধান এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বকে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী যেদিকে দাঁড়াবে, ক্ষমতার পাল্লা সেদিকেই হেলে পড়বে। এবার কী করবে হোয়াইট হাউস?
গোটা ঘটনার বিশ্লেষণে, ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, যেসব সচিব ও উপদেষ্টা বেষ্টিত হয়ে আছেন ট্রাম্প, তাঁরা তাঁকে যথাযথ পরামর্শ দিতে সক্ষম কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কে না-জানে, এই মুহুর্তে ট্রাম্পের সঙ্গে আছে একদল নির্বোধ। ট্রাম্পের জন্য এখন মাত্র দু’টি পথ খোলা। এক, দ্রæত ভেনেজুয়েলার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, যার অর্থ মার্কিন সেনাবাহিনীকে সেখানে পাঠানো এবং অপরটি, অপমানজনকভাবে পিছিয়ে যাওয়া।
গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিবন্ধে সিমন টিসডাল মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্পের পাশে ভালো কোনো পরামর্শদাতা না-থাকা এবং আগ্রাসী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোলটনের উপস্থিতির কারণে ভেনেজুয়েলার জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে আমেরিকা। কারণ, মার্কিন সেনাবাহিনী পিছিয়ে যাওয়াটা জুয়া খেলার মতো কাজ হয়ে যাবে, যা কোনো সময় বিপরীত ফল ডেকে আনতে পারে। হোয়াইট হাউসকে মনে রাখতে হবে, মাদুরো সমর্থন পেয়েছেন কিউবা, মেক্সিকো, তুরস্ক, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের। ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসেই ভেনেজুয়েলায় পরমাণু শক্তিধর দু’টি যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে রাশিয়া। টিইউ-১৬০ মডেলের এই বিমান দু’টি শব্দের গতির চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে উড়তে পারে। সিরিয়ায় রুশ অভিযানে এমন যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে, চীন গত বছর ভেনেজুয়েলাকে বিশাল অঙ্কের ঋণ দিয়েছে। গার্ডিয়ানে সিমন টিসডাল বলেই ফেলেছেন, মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কী করা উচিত এবং কীভাবে করা উচিত সে বিষয়ে ট্রাম্পকে যথাযথ পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তি হোয়াইট হাউসে আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
টিসডাল একজন মার্কিন ভাষ্যকারের মন্তব্য উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘লিংকনের ছিল একদল প্রতিদ্ব›দ্বী। আর ট্রাম্পের সঙ্গে একদল নির্বোধ। জেমস ম্যাটিসের জায়গায় এখন রয়েছেন, প্যাট্রিক শ্যানাহাম। তিনি ম্যাটিসের সহকারী ছিলেন। কিন্তু বোয়িংয়ের প্রাক্তন এই কর্তার নেই কোনো সমরাস্ত্র বা কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা। ট্রাম্পের আ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বারের কাজ দেখে মনে হয়, তাঁর দায়িত্ব ট্রাম্প যা চান তা বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া। ট্রাম্পের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ স্যানডার্স নিজের সংবাদ মাধ্যমকেই পছন্দ করেন। এদিকে হোয়াইটি হাউসের চিফ অব স্টাফ মুলভেনি খোদ ট্রাম্পকেই ‘বিপজ্জনক মানুষ’ আখ্যা দিয়েছেন। এমন অবস্থায় ভেনেজুয়েলার পট পরিবর্তনের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগ পরিস্থিতেকে আরও বিগড়ে দিতে পারে। ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রদূত অগুস্তো মন্টিয়েল জানান, তাঁর দেশ গোটা বিশ্বের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখতে চায়। কোনোভাবে থার্ড আম্পায়ারের নাক গলানোকে সহ্য করবে না ভেনেজুয়েলা, আমেরিকার কোনো রকম কর্তৃত্ব সহ্য করবে না। সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখতে সম্প্রতি মাদুরো রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে কথা বলেছেন। মাদুরোকে সমস্ত রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন বলেও জানিয়েছেন দুই দেশের রাষ্ট্রনায়করা।
ভেনেজুয়েলার বিরোধী গোষ্ঠিগুলোর নেতাকে অন্তবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বীকৃিত দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা ভেনেজুয়েলার জনগণের গনতান্ত্রিক রায়ের পরিপন্থী, যাঁরা বৈধভাবে তাঁদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিলেন নিকোলাস মাদুরোকে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরাও সেই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে অভিহিত করেছিলেন। সে কারণে, ভেনেজুয়েলায় গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারের স্থিতিশীলতা বিঘিœত করার মার্কিন পদক্ষেপের দৃড়তার সঙ্গে নিন্দা করা উচিত। সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভেনেজুয়েলার লড়াইটা জারি থাক। এটাই চায় বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ও রাষ্ট্র।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

মাদকে জড়িয়ে পড়ছে পথশিশুরা
মো. ওসমান গনি
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত- এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আমাদের দেশের শিশু অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে দেশের বহু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। তারপরও শিশুদের একাংশ পথশিশু বা ভাসমান হিসাবে পরিচিত হচ্ছে। এসব শিশু সরকার ও পরিবারের কোন তত্ত¡াবধানে না থাকায় নিজেরা তাদের মনমতো চলাফেরা করছে। অনেকেই টোকাইর কাজ করছে আবার অনেকে ফুলসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করছে। তাদের দেখাশুনা বা খোঁজখবর নেওয়ার মতো কেউ নেই। এ জন্য তারা এক পর্যায়ে আস্তে আস্তে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই হতে শুরু করে এমন কোন কাজ নেই যে, তারা করতে পারে না। তবে তাদের জীবনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাজটি হলো তারা এক সময় নেশার জগতে জড়িয়ে পড়ে নেশা করতে করতে অকালেই জীবন হারিয়ে ফেলছে। তাদের নেশার জগতে আনার জন্য একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে, তারা যাদের বড় ভাই হিসাবে ডাকে। এই বড় ভাইদের নির্দেশেই তারা সব কাজ করে থাকে। তারা যখন অতিমাত্রায় নেশাক্ত হয়ে পড়ে তখন এক পর্যায়ে নেশার টাকা জোগতে নিজেই শুরু করে মাদক কেনাবেচা। ভাসমান রিকসা চালক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা তাদের কাছ থেকে মাদক কিনে থাকে। এক সময় ক্রেতা আর নেশা দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। তখন শুধু সেবনই করে না, বিক্রির পাশাপাশি ফরমায়েশ মতো বিভিন্ন জায়গায় গাঁজা, ইয়াবাও ইত্যাদি পৌঁছে দেয়।
বড় ভাইরা মাদক বিক্রি ও বহনের কাজে শিশু-কিশোরদের বেশি নিরাপদ মনে করে। তাই তাদের দলে ভেড়ানো হয়। এ কারণে দিন দিন এ কাজে শিশু-কিশোরদের চাহিদা বাড়ছে। আগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মাদক নিয়ে গেলে ছোটদের ৫০ টাকা দিলেই হতো। এখন ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিতে হয়। বয়স একটু বেশি হলে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। যে সব শিশুরা দেখতে খুবই সহজ সরল, কিন্তু আচরণে অনেক চালাক-চতুর তাদেরই চাহিদা বেশি বড় ভাইদের কাছে। এসব শিশু কিশোর নিরাপদে মাদক বিক্রি ও বহন করতে পারে। খুব সহজে ধরা পড়ে না। তবে কখনো ধরা খেলে দু’চারটি থাপ্পড় ও লাথি মেরে ছেড়ে দেয়।
দেশে কী পরিমাণ ভাসমান শিশু-কিশোর মাদকে আসক্ত তার নির্দিষ্ট তথ্য নেই। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়ে থাকে, দেশে ৭০ থেকে ৮০ লাখের মতো মাদকাসক্ত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, ঢাকায় পাঁচ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মাদকাসক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০২-০৩ সালের এক গবেষণায় বলেছে, পথশিশুদের ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত।
আইসিডিডিআরবি সর্বশেষ ২০১১ সালের এক গবেষণায় ৫১ শতাংশ পথশিশুর মাদকাসক্তের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। গত কয়েক বছর আগে তার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্ত পথশিশুদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও ৮ শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে। এর বাইরে বিরাট একটি অংশ ড্যান্ডির (সলিউশন গাম) নেশায় আসক্ত।
পথশিশুদের বেশিরভাগই পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না। তবে বেশিরভাগ পরিবার সন্তানদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। গুটি কয়েক পরিবার আছে যারা মাঝে মধ্যে এসব মাদকাসক্ত শিশু কিশোরকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চায়। পথশিশুরা প্রথমে সিগারেট ধরে। এরপর ড্যান্ডি ও গাঁজা সেবন শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ইয়াবা ও হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। এক সময় এসব শিশুর ব্যবহার করে বড় ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড করানো হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাসমান বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। তাদের ভেতরে সব সময় অপরাধমূলক প্রবণতা কাজ করে। তাই বাড়িতে থাকলেও তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে সর্বদা ঝামেলায় জড়িত থাকে। এছাড়া বাড়ির টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি ছাড়াও প্রতিবেশীদের বাসায় চুরি করে থাকে। এ জন্য তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিলে পরিবার আরও বেশি ঝামেলায় পড়ে, যার কারণে তারাও সন্তানদের বিষয়ে উদাসীন।
শহীদ মিনার এলাকায় থাকা কুলসুম নামে এক কিশোরী জানায়, এক সময় ফুল আর চকলেট বিক্রি করতো। পরে বন্ধুদের সাথে ড্যান্ডি খাওয়া শুরু করে। এখন মাঝে মধ্যে গাঁজা আর ইয়াবা খায়। তবে ইয়াবার আসক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় গাঁজা খেতে হয়। নয়তো মাথা ঠিক মতো কাজ করে না। তার ভাষ্য, গাঁজা খেতে না পারলে মাথা আর শরীর অবশ হয়ে যায়। কোন কিছু চিন্তা করতে পারে না। খুবই খিট খিটে মনে হয়। এছাড়া তখন অন্যান্য বন্ধুর সাথে খুব ঝগড়া হয়।
পলাশীতে থাকা লাকী নামের আরেক ভাসমান কিশোরী জানায়, ছেলে বন্ধুরাই দুষ্টমির ছলে তাদেরকে ড্যান্ডি আর গাঁজা খাওয়া শিখিয়েছে। এখন সপ্তাহে দু’দিন ইয়াবাও খায়। তাদের ছেলে বন্ধুরা শাহবাগ, আজিমপুর ও নীলক্ষেতসহ আশপাশের এলাকায় মহিলদাদের ভ্যানিটি ব্যাগ ও মোবাইল ছিনতাই করে। যেদিন বেশি টাকা আয় হয় সেদিন সবাইকে ইয়াবা খাওয়ায়। অন্যান্য দিন সবাই টাকা ভাগ করে ইয়াবা কিনে খায়।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ভাসমান শিশু-কিশোররা সব সময় হতাশাগ্রস্ত থাকে। এছাড়া রাষ্ট্র বা সমাজ এই বিচ্ছিন্ন শিশু-কিশোরদের যথাযথভাবে গ্রহণ করতে চায় না। এসব কারণে ভাসমান শিশু-কিশোররা মানসিকভাবে নানা জটিলতায় ভুগে মাদকে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এককভাবে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়ই এ সমস্যার জন্য দায়ী। এসব শিশু-কিশোর দু’বেলা খাবারের জন্য অনেক সময় বড় অন্যায় করে বসে। যার কারণে সরকারিভাবে এসব শিশু-কিশোরের দেখভালের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই তাদেরকে নেশা ও অপরাধ থেকে ফিরিয়ে মূল ¯্রােতে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আমেরিকা


আরও
আরও পড়ুন