Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাজধানীতে এডিস মশার প্রকোপ এবার আগেভাগেই শুরু

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় এবার নির্ধারিত সময়ের আগেই এডিস মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর একটু আগেই এডিস মশার প্রজনন শুরু হয়ে গেলেও সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এই সময়ে মশা নিধনে কোন কর্মসূচি থাকে না। ফলে মশার বংশবিস্তার ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক বছর ধরেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এডিস মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরাই বেশি। এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি এর চিকিৎসা খরচও ব্যয়বহুল হয়ে থাকে।

এদিকে এডিস মশার আগাম বংশবিস্তারে ভাবিয়ে তুলেছে সিটি কর্পোরেশনকেও। কারণ, সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রম শুরুর আগেই এর প্রকোপ শুরু হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি কতটা মোকাবেলা সম্ভব, সেই বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তাও রয়েছে দুই নগর কর্তৃপক্ষ। সাধারণত বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিশেষ করে গরম ও বর্ষার সময় এডিস মশার উপদ্রব ও ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। কিন্তু এবার মে মাসের শুরু থেকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে জরিপ চালিয়ে এই মশার লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

জরিপে ঢাকা উত্তরের সাতটি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। তবে ঢাকা দক্ষিণে এর থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৫টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। কিছু জায়গায় এর পরিমাণ অনেক বেশি। ইতিমধ্যে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিআরবি ও আজগর আলী হাসপাতালে দুজন মারা গেছে বলেও জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পক্ষ থেকে এই জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। সেখানে এমন চিত্র উঠে এসেছে। যে কারণে এসিড মশার নিধন ও ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া রোগের বিষয় জনগণকে সচেতন করতে ধারাবাহিকভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশন। দুই সিটিতে অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে সচেতনতামূলক সভা করা হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এলাকার জনপ্রিতিনিধি, মসজিদের ইমাম এবং গণমান্য ব্যক্তিদের এডিস মশার ভয়াবহতা ও প্রতিকারের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তারাও নিজেদের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলেন। শুধু এই ধরনের সভার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রত্যেক এলাকায় এডিস মশার বিস্তার রোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পরামর্শ দেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ডিপিএম) এম এম আক্তারুজ্জামান বলেন, ৩ থেকে ১২ মে পর্যন্ত দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৭ ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে জরিপ চালানো হয়েছে। সে জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। আমরা এখন এ নিয়ে কাজ করছি। মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছি। জরিপ কার্যক্রমে বিভিন্ন স্পট ছাড়াও ৯৯৮টি বাড়ি পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ভাইরাসজনিত জ্বর মশার মাধ্যমে না ছড়ালেও ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ্বরের জীবাণু বহন করে এডিস মশা এবং তা একই প্রজাতির। দুটোই এডিস মশার কারণে হয়। ২০১৮ সালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে পরিসংখ্যানে গত বছরে ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বলা হলেও এর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়।

দুই সিটির যেসব এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহৃত সূচক বেশি দেখা গেছে ওই সব এলাকার নির্মাণাধীন ভবনের মেঝেতে জমানো পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিক বালতি, পানির চৌবাচ্চা ও ফুলের টব, এসির পানিতে এডিস মশার প্রজনন বা বংশবিস্তার বেশি দেখা গেছে। এবারের জরিপে প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশার ঘনত্ব নির্ণয়ে বিজি সেন্টিনেল ট্র্যাপ-২ ব্যবহার করা হয়েছে। দুই সিটির ১৯টি ওয়ার্ডে ১৪১টি বিশেষ ধরনের ফাঁদ পাতা হয়। এতে দেখা যায় কিউলেক্স মশার আধিক্য। প্রতিটি ট্র্যাপে এডিস মশা পাওয়া যায় শূন্য দশমিক ৫৫টি এবং কিউলেক্স মশা পাওয়া যায় গড়ে ৪৬ দশমিক ৭টি।

জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব সূচক (বিআই) সর্বোচ্চ ৮০ পাওয়া গেছে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে (শরতগুপ্ত রোড, গেÐারিয়া)। এটাই বৃহত্তর ঢাকার মধ্যে সব থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে (তেজগাঁও)। সেখানে লার্ভার ঘনত্ব সূচক (বিআই) সর্বোচ্চ ৪০ পাওয়া গেছে। যা অবশ্য দক্ষিণের থেকে অর্ধেক। তেজগাঁওয়ের পরই এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র (বিআই) ৩০ পাওয়া গেছে ১ নম্বর (তুরাগ), ৪ নম্বর (পল্লবী), ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে (বনানী, গুলশান, বারিধারা), বিআই ২০ পাওয়া গেছে ১৬ নম্বর (কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া), ২২ নম্বর (রামপুরা) ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে (বাড্ডা)।

ঢাকা দক্ষিণের ৪০ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া যেসব এলাকায় এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র পাওয়া গেছে বেশি তা হলো- ১২ নম্বর ওয়ার্ডে বিআই ৭০ পাওয়া গেছে, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিআই ৪০ পাওয়া গেছে, ৪ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিআই ৩০ পাওয়া গেছে, বিআই ২০ পাওয়া গেছে ৬, ৭, ১৪, ১৯, ২০, ২১, ২২, ৪৩, ৪৭ ও ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক সানিয়া তহমিনা বলেন, আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ থেকে নগরবাসীকে নিরাপদ রাখতে বিভিন্ন কাজ করছি। রোগী শনাক্ত হলে দ্রæত চিকিৎসা যেন পায় সেজন্য হাসপাতালগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। সব জায়গায় একইভাবে যেন চিকিৎসা দেয়া হয় সেটাও বলে দেয়া আছে। পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় মশা পরিস্থিতি দেখতে এই জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, ঢাকা দক্ষিণের রাস্তাঘাট সরু, এখানে মানুষের বসবাসও বেশি। মশার প্রজননক্ষেত্র পাওয়ার কারণও সেজন্য বেশি। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। আমরা জনগণকে সচেতন করার কাজ করছি। প্রত্যেকে সচেতন হলে শতভাগ না হলেও এসিড মশার হাত থেকে অনেকাংশে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা। আর উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই আমরা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের হাত থেকে রক্ষার জন্য নগরবাসীকে সচেতন করতে কাজ করছি। কোথাও ময়লা-আবর্জনা পেলে দ্রুত বর্জ্য বিভাগকে দিয়ে তা সরিয়ে ক্লিন করা হচ্ছে। তারপরও মশা দেখা যাচ্ছে।

নগরবাসীকে নিজ নিজ আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, নগরবাসীর সচেতনতাই এডিস মশার বিরুদ্ধে লড়ার প্রধান হাতিয়ার হতে পারে। কারণ, এই মশাগুলো জন্মই নেয় ঘরের ভেতর বা আশপাশের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ