Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের জীবনমান রক্ষায় বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো পুনর্বাসন জরুরী

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৯, ৬:০১ পিএম

দক্ষিণ উপকুল জুড়ে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার ‘উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ’এর বেশীরভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। সাগরের লবণাক্তটা থেকে ফসলী জমি রক্ষা সহ উপকুলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন এবং জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় ‘মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইড’এর সহায়তায় ১৯৬০ সাল থেকে ’৮০ সালের মধ্যে মাত্র ৩৮ কোটি ৬০লাখ টাকা ব্যায়ে দক্ষিণের বিশাল উপক’লীয় এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সহ বিভিন্ন ধরনের পানি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এরফলে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার প্রায় ৬ লাখ একর জমি লবণাক্তটা থেকে রক্ষার পাশাপাশি ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। প্রকল্প এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড খালাশী সেড, বাস ভবন, গুদাম সহ ১৮৮টি বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ছাড়াও প্রায় ৩শ ড্রেনেজ স্লুইস ও ফ্লাশিং স্লুইস সহ ২৭২টি রিভার ক্লোজার নির্মাণ করে। এরফলে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা সহ জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।

কিন্তু প্রকল্পটির শুরু থেকে শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় ২০ বছর। এ সময়কালের মধ্যেই অনেক বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সহ পানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবার পাশাপাশি সাগরের ঢেউ ছাড়াও একাধিক ঝড় জলোচ্ছ্বাসে উপক’লীয় বাঁধ এবং বিভিন্ন অবকাঠামো একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু মেরামত সহ পরিপূর্ণ পুনর্বাসনে তহবিল সংকট ছিল সব সময়ই। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেই বছরে যেখানে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যায় ২৫কোটি টাকা, সেখানে এর এক তৃতীয়াংশ অর্থও কখনো পাওয়া যায়নি। এমনকি ইতোপূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমেই ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী’র আওতায় উপক’লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সহ বিভিন্ন অবকাঠামো মেরামত ও পুনর্বাসন হলেও গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে তা বন্ধ। এক হিসেবে দেখা গেছে ১৯৮১-৮২সালে উপক’লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সহ অবকাঠামো সমূহ রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৮০লাখ টাকা। এর পরের বছর ঐ বরাদ্দ মাত্র ৬২ লাখ টাকায় হৃাস করা হয়। সেসময়ই বছরে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ চাহিদা ছিল প্রায় সাড়ে ৪কোটি টাকা।
১৯৮০সালে ইউএসএইড ভুক্ত প্রকল্পটির কাজ শেষ হবার পরে আরো বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে উপক’লীয় এলাকায় বেশ কিছু বাঁধ ও পানি অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সমূহে ৮৭টি পোল্ডারে ৩ হাজার ৭৪৩ কিলোমিটার উপক’লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছাড়াও ১ হাজার ৯৯টি রিভার ক্লোজার এবং প্রায় ১ হাজারটি ইনলেট স্ট্রাকচার, সোয়া ২শ ব্রীজ ও কালভার্ট ছাড়াও পৌনে ৩শ ক্রসড্যাম রয়েছে।
কিন্তু একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব উপক’লীয় বাঁধ সহ পানি অবকাঠামোর একটি বড় অংশই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। উপরন্তু ১৯৬০সালে যে উচ্চতায় এসব বাঁধ নির্মাণের নকশা প্রণয়ন করা হয়, সময়ের বিবর্তনে তার পরিবর্তনও জরুরী বলে মনে করছেন পানি বিশেষজ্ঞ মহল। পাশাপাশি ক্রমাগত সাগর ও নদ-নদীর স্রোত এবং ঢেউ আছড়ে পড়ায় এসব বাঁধের বেশীর ভাগই ক্ষয়িষ্ঞুপ্রায়। বরগুনার রংগাবালী ও ভোলার কয়কটি এলাকায় প্রায় ২০ কিলোমিটার উপক’লীয় বাঁধ বিলীন হয়ে বর্তমানে উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। এসব বাঁধ পুনর্বাসন অত্যন্ত জরুরী। অবিলম্বে উপক’লীয় এসব বাঁধ সহ পানি অবকাঠামো সমূহ মেরামত ও পুনর্বাসন না করলে দেশের উপক’লীয় এলাকার কৃষি ও স্বাস্থ্য সহ আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পাশাপাশি জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়তে পরে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
সিডর, আইলা ও মহাশেন-এর একের পর এক তান্ডবে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠী, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা সমূহে প্রায় ৩শ কিলোমিটার উপক’লীয় বাঁধ সম্পূর্ণ ও দেড় হাজার কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও এসব উপক’লীয় জেলা সমূহের বাঁধের বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। উল্লেখিত জেলা সমুহে প্রায় ৩শটি পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো সম্পূর্ণ ও আরো ৫শতাধীক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধ, রেগুলেটর, ফ্লাশিং স্লুইস গেট সহ বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি মেরামত ও পুনর্বাসনে কয়েক হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও সময়মত তহবিলের সংস্থান না হওয়ায় সিডর-এর প্রায় এক যুগ পরেও এখনো ক্ষয় ক্ষতির পুনর্বাসন চলছে।
তবে পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝড় জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতির পুনর্বাসন ছাড়াও গোটা উপক’লীয় এলাকার বাঁধসমুহের উচ্চতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি সহ নতুন নকশায় ঢাল তৈরী করে সাগরের জলোচ্ছ্বাসকে প্রতিহত করার উদ্যোগ জরুরী। সম্প্রতি বিশ্বব্য্যাংক-এর ইসিআরপি প্রকল্প, ডাচ সরকারের ‘ব্লু-গোল্ড প্রগ্রাম’ ও ‘সিআইপি-১’ এর আওতায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা টাকা ব্যায়ে সিডর, আইলা ও মহাশেন-এর ক্ষতি পুনর্বাসন সহ ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় বাঁধ সহ পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো সমূহের মেরামত শুরু হয়েছে। তবে তা দক্ষিণাঞ্চলের উপক’লের ৮৭টি পোল্ডারের মধ্যে মাত্র ২৭টিতে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট প্রায় সাড়ে ৭শ কোটি টাকা বায়ে পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের ১২টি পোল্ডারে ইসিআরপি প্রকল্পের আওতায় ১৯.৭৬ কিলোমিটার স্থায়ী নদী তীর সংরক্ষণ, ৩৫.৪৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত, ১৭৪টি পানি অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও ১৯১টির মেরামত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া ডাচ সরকারের ‘ব্লু-গোল্ড’ প্রোগ্রামের আওতায় প্রায় ৫৬৫ কোটি টাকা ব্যায়ে পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ৯টি পোল্ডারে ৫৮৯ কিলোমিটার উপক’লীয় বাঁধ মেরামত, ৮৫৪ কিলোমিটার নিষ্কাশন খাল খনন ও ৯০টি পানি অবকাঠামোর মেরামত চলছে।
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় গৃহীত ‘সিইআইপ-১’ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের ৬টি পোল্ডারে ২০৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও পুনঃ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রায় ২শ কিলোমিটার নদী ও খাল খনন সহ পুনঃ খনন, ১২৩টি পানি অবকাঠামো নির্মাণ এবং প্রায় সাড়ে ৫কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ সহ ৮টি ক্লোজার ছাড়াও আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজ করা হচ্ছে। তবে নিরাপদ উপক’লের জন্য দক্ষিণাঞ্চলের ৮৭টি পোল্ডারের প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার উপক’লীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সহ পানি অবকাঠামো সমূহের পূণর্বশনের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
এসব ব্যাপারে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল(অবঃ) জাহিদ ফারুক শামিম-এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, ‘এ বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় সম্পূর্ণ সচেতন রয়েছে। কিভাবে এসব বাঁধ মেরামত ও পূণর্বাশন করা যায়, সে লক্ষে ইতোমধ্যে আমরা বরিশাল ও ঢাকায় একাধীক সেমিনার সহ মত বিনিময় সভা করেছি। সেখান থেকে অনেক তথ্য-উপাত্ত সহ বাস্তব কিছু মতামত পাওয়া গেছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে’ বলেও জানান পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বরিশাল

২৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ