Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

১১৪ লাশের বিনিময়ে ইউপি নির্বাচন

যেখানে হয় রক্তের বন্যা, আমরা কি তেমন নির্বাচন চাই?

প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান : ইউপি নির্বাচনের এ পর্যন্ত পাঁচটি পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। পাঁচটি পর্বের এই নির্বাচনে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২১৯৫ টি চেয়ারম্যানের পদ, বিএনপি ৩১৫ টি, জাতীয় পার্টি ৪১ টি, অন্যান্য দল ৪২ টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্র্থীরা পেয়েছেন ৬৯৭ টি আসন। গত ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ইউপি নির্বাচনের প্রথম পর্ব, ৩১ মার্চ দ্বিতীয় পর্ব, ২৩ এপ্রিল তৃতীয় পর্ব এবং ৭ মে চতুর্থ পর্বের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সব শেষে গত শনিবার ২৮ মে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম পর্বের নির্বাচন। ৯৩ শতাংশ আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ, আর মাত্র ৭ শতাংশ আসন পেয়েছে বিএনপি। এখন যদি কেউ বলেন যে, সারা দেশে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে ৯৩ শতাংশ মানুষ, আর বিএনপিকে করে মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ, তাহলে সেটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য হবে সেটি বিবেচনা করবেন এদেশের সাধারণ মানুষ।
১১৪ টি প্রাণের বিনিময়ে নির্বাচন
সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের ২১৯৫ এবং বিএনপির ৩১৫ টি চেয়ারম্যান পদ লাভ করার জন্য ঝরে গেছে ১১৪ টি তাজা প্রাণ। আহত হয়েছেন প্রায় ৬ হাজার মানুষ। স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে নীচের স্তরে অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের জন্য রক্তের এত বীভৎস খেলা স্বাধীনতার পর আর দেখা যায়নি। কেন এই বিপুল রক্তপাত? আমাদের মধ্যে যারা খুব প্রবীণ তারা তো ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি এবং ১৯৭১ সালের পাকিস্তান বিভক্তির পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রশ্নে এত বিপুল সংখ্যক আদম সন্তানকে কোরবানী দিতে দেখেন নি বা শোনেন নি। কার জন্য এত বিপুল প্রাণহানি?
এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। অতীতেও হয়নি। তারপরেও এবার কেন হল? এই প্রশ্ন আজ সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে ঢাকা মহানগরী পর্যন্ত সর্বত্রই মানুষ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন যে, যদি দলীয় টিকেটে বা দলীয় ভিত্তিতে এবারের ইউপি নির্বাচন না হতো তাহলে শতাধিক মানুষকে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে হতো না। কি প্রয়োজন ছিল ইউনিয়ন পর্যায়ে এই দলবাজি করার? কি প্রয়োজন ছিল গ্রামে-গঞ্জে আওয়ামী লীগের নৌকা ভাসানোর? আওয়ামী ঘরানার লোকরাই তো যথা তথা এই গানটি গেয়ে বেড়ান,
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
(আমরা) আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
আগেও তো ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন হয়েছে। তখন সেটি আজকের মত ইউনিয়ন পরিষদ ছিল না। তখন সেটি ছিল ইউনিয়ন বোর্ড।
ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন
যাদের বয়স ৫০ বছরের ওপরে তারা দেখেছেন ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন। যারা ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর বা চেয়ারম্যান প্রার্থী হতেন তারা যেমন তার গ্রামবাসী সকলকে চিনতেন তেমনি গ্রামবাসীরাও প্রার্থীদেরকে চিনতেন। কত সুন্দর সহজ আন্তরিক পরিবেশে সেদিন নির্বাচনী প্রচারণা চলত। তখনও মাইক্রোফেনের ব্যবহার এত ব্যাপক হয়নি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচারণা হতো টিনের চোঙ্গা ফুঁকে। যারা প্রার্থী হতেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় পার্টি বলে কিছু ছিলনা। মনে মনে তারা হয়তো কোন না কোন দলের সমর্থক ছিলেন। কেউ কেউ হয়তো কোন না কোন রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য কর্মী বা নেতা ছিলেন। কিন্তু ইউনিয়ন বোর্ডের ইলেকশনে কেউই তার দলীয় পরিচয় নিয়ে ভোটারের কাছে যেতেন না। রাস্তা-ঘাট বানাবেন, সাঁকো তৈরী করবেন, ইত্যাদি জনহিতকর কার্যের ওয়াদা করতেন তারা। অনেককেই দেখেছি খাসি মারতে (অর্থাৎ খাসি জবাই করে মজলিশের ব্যবস্থা করা)। সেখানে সব দলের লোকদেরকে জিয়াফত করা হতো। জিয়াফত করার সময় প্রার্থীরা বলতেন, আরে মিয়া আমাকে ভোট দাও আর না দাও, অন্তত পেট পুরে চারটি খেয়ে যাও। ভোট দিক আর না দিক সব শ্রেণীর মানুষ সেই মজলিশে যোগ দিতেন। আমি আমাদের জেলায় অর্থাৎ বগুড়ায় দেখেছি, ইলেকশন শেষ হওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী এক রিক্সা করে বাজারে যাচ্ছেন।
কোথায় হারিয়ে গেল
সেই সব দিন
কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব দিন? সেই সব মুহূর্ত যেন আজ শুধুই অতীত দিনের স্মৃতি। সেইসব স্মৃতি কেউ ভোলে, কেউ ভোলে না। আজ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসে ততই প্রার্থীদের মুখ দেখাদেখি হয়ে যায় বন্ধ। নির্বাচন যখন দরজায় করাঘাত করে তখন বেরিয়ে আসে টেঁটা, বল্লম, সড়কী। আর যেসব যুবক শহর থেকে গ্রামে যায় ইলেকশন করতে তাদের অনেকের হাতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র। শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপির লড়াই হয়না, লড়াই হয় আওয়ামী লীগ বনাম বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ, বিএনপি বনাম বিদ্রোহী বিএনপির। উদারভাবে এস্তেমাল করা হয় টেঁটা, বল্লম আর আগ্নেয়াস্ত্র। প্রমাণ করতে হবে, আমার দল সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, আমার দল সবচেয়ে জনপ্রিয়। আর সেটা প্রমাণ করার জন্য পুলিশদের নাকের ডগার ওপর বের করে দেওয়া হয় প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টদেরকে। ধমক দিয়ে ব্যালট পেপার কেড়ে নেওয়া হয় এবং শুরু হয়ে যায় সিল মারার মহোৎসব। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে শুরু হয় প্রচলতি ও অপ্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহার। আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি শুধুমাত্র ইউনিয়ন বোর্ডের ইলেকশনেই লাশের মিছিল।
এর শেষ কোথায়? যদি
গণতন্ত্র হারিয়ে যায়?
আজ এক শ্রেণীর সমাজসেবী, লেখক ও বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিক ঘোরতর দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। কারণ শুধু শহরের নয়, গ্রামের লোকেরাও ধীরে ধীরে নির্বাচনের প্রতি বিমুখ হয়ে উঠছেন। আর উঠবেন নাই বা কেন? সকালবেলা উঠে ব্রেকফাস্ট ও চা খেয়ে আপনি গেলেন ভোট কেন্দ্রে। প্রিজাইডিং অফিসার বললেন, স্যার, আপনার ভোট দেওয়ার আর প্রয়োজন নাই। কারণ, আপনার ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। এগুলো কোন বানানো খবর নয়। প্রতিদিন এসব রিপোর্ট খবরের কাগজে আসছে। আপনারা কি অতীতে কল্পনা করতে পেরেছেন যে, এবারের ইউপি ইলেকশনে দুই শতেরও বেশি ব্যক্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্থাৎ বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছে? প্রতিটি নির্বাচনেই একটি করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। এবং প্রতিটি রেকর্ডই ইতিহাসের পাতায় অশ্রুতপূর্ব বলে স্থান পাচ্ছে। যেখানে ভোট দেওয়ারই কোন দরকার নাই, বিনা ভোটেই যেখানে চেয়ারম্যান মেম্বর হয়ে যাচ্ছেন, সেখানে ইলেকশন করারই বা কি দরকার আছে?
এই প্রবঞ্চনা শুরু হয়েছে
২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্বাচনের এবং ভোট দানের ক্ষেত্রে যেসব তেলেসমাতি কারবার দেখা যাচ্ছে, তার ফলে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন নতুন সংজ্ঞা লাভ করতে যাচ্ছে। ঐ নির্বাচনের পর আরো কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে। প্রথমে ৭/৮টি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন, তারপর উপজেলা নির্বাচন, তারপর ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং সব শেষে ৫ টি পর্বে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। একটি দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন এবং ভোটের রাজনীতির রসাতল যাত্রা অব্যাহত ভাবে চলে আসছে। এখন ইলেকশন সম্পর্কে মানুষের সব ধারণাই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে যে মডেলের ইলেকশন হচ্ছে তেমন মডেলের ইলেকশন পৃথিবীর প্রায় সোয়া দুই শত রাষ্ট্রের কোথাও পাওয়া যাবে না। প্রবীণ ও অভিজ্ঞরা বলছেন যে, এই অসুস্থ প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকতে আর বেশি দেরি নাই। তাই প্রশ্ন, এই ধরনের নির্বাচন কি আর জনগনের কাম্য হতে পারে?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ১১৪ লাশের বিনিময়ে ইউপি নির্বাচন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ