Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মেয়েরা এমনই হয়

কা ম রু ল হা সা ন দ র্প ণ। | প্রকাশের সময় : ২৭ জুন, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

শরীরে নীলার গন্ধ লেপটে আছে। কোনো মানবীর শরীরের গন্ধ এমন হয়! ধারণা ছিল না। প্রথম টের পেলাম। ঠিক গন্ধ নয়। সুবাস। হ্যাঁ, সুবাসই। সুবাস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। শরীরের চতুর্দিকে ঘুরছে। আমি সূর্য। টুকরোগুলো গ্রহ। একেকটি টুকরা সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে নাকে ঢুকছে। নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। শুধু নাক নয়। প্রতিটি রোমক‚পের মধ্যদিয়ে শরীরে ঢুকছে। হাত, পা, চোখ, মুখ, বুক, ঠোঁট সুবাস পাচ্ছে। পুরো মন সুবাসে অবশ। মাতাল মাতাল লাগছে। হালকা হয়ে গেছি। ভেতর ফাঁকা। মনে হচ্ছে দেহে প্রাণ নেই। আমার সবটুকু নিঃশ্বাস নীলা শুঁষে নিয়েছে।

ঘটনাটি আচমকা ঘটে। এখনও এর গতি মাপার যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি। স্বাভাবিক কোনো ঘটনাও না। বলার মতোও না। মনে মনে ভালবাসতাম। স্বপ্ন দেখতাম। ঘুমোনোর সময় ওর ছায়া পাশে নিয়ে ঘুমাতাম। ভাবতাম নীলা পাশে শুয়ে আছে। কথা বলি, মান-অভিমান করি। আমি অভিমান করলে ও ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ঘনিষ্ঠ হই, জাপটে ধরি। বাহু থেকে ছুটে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। গালে গাল ঘষি। ছাড়ো! ছাড়ো! তোমার সঙ্গে কথা নেই, বলে ছুটতে চেষ্টা করে। যতই ছুটতে চায়, ততই ঘনিষ্ঠ হই। এক সময় হার মেনে বলে, আহ আস্তে! লাগছে। আমি নতুন তুমি জান না! কখনো ওর হাত টেনে আঙুল কামড়ে দেই। লাফিয়ে উঠে কান মলে দেয়। মান অভিমান আর ভালোবাসাবাসি করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ি। কখনো বালিশ ব্যবহার করি না। নীলাই আমার বালিশ। মাথা মখমলের ভেতর হারিয়ে যায়।
অফিস থেকে একটু আগেই বেরিয়েছি। বিপদে পড়ে গেলাম। এই আধো দিন আধো সন্ধ্যায় কোথায় যাই। বন্ধুদের আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রতিদিন একই জায়গা। একই কথাবার্তা। একই মুখ। দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। একঘেয়ে জীবন। বাসা টু অফিস। অফিস টু আড্ডা, আড্ডা টু বাসা। একই চক্রে বাঁধা। নো চেঞ্জ। আড্ডার বিষয়বস্তুর বেশিরভাগই নারী বিষয়ক। বিশ্রী আর অসভ্য ব্যাপার-স্যাপার। তরুণের মুখ এতো খারাপ যে, হড়হড় করে অশ্লীল কথা বমি করে। জীবনে কয়টা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে। কয়টার সঙ্গে বিছানায় গেছে। টু দি পয়েন্ট বর্ণনা দিয়ে যায়। সবাই বিস্মিত আর হা হয়ে শোনে। একবার বোটানিক্যাল গার্ডেন তিন নম্বর প্রেমিকা সাথীর সঙ্গে কী করেছে বর্ণনা শুরু করে। ঝোপের আড়ালে পাশাপাশি বসে সাথীকে চেপে ধরে। ব্যথা পেয়ে সাথী কঁকিয়ে উঠে। এই অসভ্য! কি হচ্ছে। হাত সরাও। বলেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর ওর উপর উঠে কান কামড়ে দেয়। দ্যাখ, দ্যাখ, শালী কি করেছে। কামড়ে কানের লতি ছিড়ে ফেলেছে বলে আমাদের দিকে কান বাড়িয়ে দেয়। ওর বলা থামে না। অনবরত বকবক করেই যায়। বুঝলি, মেয়েদের ফিলিংস কঠিন জিনিস। সহজে আসে না। আসবে কী করে। ওদের হার্ট থাকে উঁচু উঁচু দুই বুকের আড়ালে। এতো পুরো পাহাড় ভেদ করে ফিলিংস পৌঁছতে পৌঁছতে কয়েক লক্ষ বছর লেগে যায়। কাজেই ফিলিংস আসার আগেই কাজ সেরে নিতে হয়। বুঝলি! অকথ্য অশ্রাব্য সংলাপ। প্রেম তরুণের কাছে সার্কাসের জাগলারের মতো। চার-পাঁচটা ছোট বল দু’হাতে উপরে ছুঁড়ে দিয়ে একটার পর একটা বদলে নেয়। আমাকে ডাকে সাইলেন্ট লাভার। নীরব প্রেমিক! তীর্যকভাবে বলে, তুই সারাজীবন গাছের টসটসে ফল দেখে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যাবি। পেড়ে খেতে পারবি না। কুড়িয়েও খেতে পারবি না। তোর ফল অন্যে খেয়ে যাবে। কিছু বলি না। বলতেও পারি না। কেবল শুনে যাই। বলতে গেলে সবাই এক সঙ্গে ঝেঁকে ধরবে। চুপ করে থাকলে আলাপ বেশিদূর গড়ায় না। তারপরও ওরা বলে যায়। নীলাকে জড়িয়ে যা-তা বলে। মুখে কিছুই আটকায় না। বলতে বলতে এক সময় থেমে যায়। আমি, তরুণ, মিজান, জাভেদ, বিপ্লব, বাবু- এই ছয়জন বন্ধু চক্রের সদস্য। এই চক্রে মাঝে মাঝে নীলাও আসে। আমিই নিয়ে আসি। সবাই আকারে ইঙ্গিতে আমাকে নিয়ে ওকে অনেক কথা বলে। নীলা কৌশলে এড়িয়ে যায়। সবার ধারণা ওর সঙ্গে আমার ফাটাফাটি প্রেম। কিন্তু আমি জানি, ওর সঙ্গে আমার শুধুই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এর বেশি কিছু নয়। নীলা এর বেশি এগুতে দেয় না। ওর সাথে আমার সম্পর্ক আত্মীয়তার সূত্রে। ছোট চাচীর বড় ভাইয়ের মেয়ে। একমাত্র মেয়ে। বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। ফলাফলের অপেক্ষায়। মাঝে মাঝেই আমার সঙ্গে বেড়াতে বের হয়। রিকশায় বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাই। যতক্ষণ সঙ্গে থাকে ও-ই অনর্গল বলে যায়। আমি শুধু হু-হা করে যাই। চুপ করে শুনি। ও সঙ্গে থাকলে কেন জানি আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করে আমি কিছু বলছি না। বিরক্ত হয়ে ঝাঁজের সঙ্গে বলে- শুধু আমি বলছি, তুমি কিছু বলছ না যে?
-আমিও যদি বলি তাহলে শুনবে কে? দু’জনে এক সঙ্গে কথা বললে কারোটাই তো শানা হবে না। তার চেয়ে তুমি বল আমি শুনি। তাছাড়া আগুনের সঙ্গে কথা বলার ভাষা আমার জানা নাই। আগুন বাংলা ভাষা বোঝে কিনা তাও তো জানি না। এজন্য চুপ করে আগুনের উত্তাপ নেই! নীলা আমার কথা বুঝল কিনা জানি না। হয়তো বুঝেছে। হয়তো বোঝেনি। কথাগুলো বলার পর মনে হলো কথার মধ্যে এতো প্যাঁচ না দিলেও চলতো। সরাসরি বলে ফেলাই ভালো ছিল। বেশি প্যাঁচাতে গিয়ে পুরো কথা বলা হয় না, কেবল প্যাঁচিয়েছি। মনে মনে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো। মনে হলো আমি একটা হাফফিনিশড মানুষ। খুব স্বাভাবিকভাবেই নীলা বললো, আগুনের সঙ্গে কথা বলার ভাষা শেখ না কেন! তা না হলে চিরজীবন আগুনই তোমাকে পুড়িয়ে যাবে। তুমি পোড়াতে পারবে না।
-আসলে তুমি যতক্ষণ পাশে থাক, ততক্ষণ আমার কণ্ঠ বন্ধ হয়ে থাকে। নিজেকে ভেড়া মনে হয়। কেবল মনে হয় আশপাশের লোকজন বলছে, ঐ যে হরিণের সঙ্গে একটা ভেড়া যাচ্ছে। তখন যদি কথা বলতে যাই, আমি নিশ্চিত, ছাগলের কণ্ঠের মতো আওয়াজ বের হবে। নীলা খিলখিল করে হেসে ওঠে। ঝড়ের সময় লম্বা লম্বা গাছের মাথাগুলো যেমন সামনে পিছনে দোলে, নীলাও হাসতে হাসতে সামনে পিছনে দুলছে। ওর নরম মসৃণ বাহু আমার বাহুর সঙ্গে ঘঁষা খাচ্ছে। কখনো আমার ওপর পুরো শরীরের ওজন এসে পড়ছে। ভেতরটা শিরশির করে ওঠছে। হাসতে হাসতেই বললো, তুমি ভেড়া বুঝলাম। কিন্তু ভেড়ার মুখ দিয়ে ছাগলের ডাক বের হয় কি করে!
-বের হয়! বের হয়! তোমার মতো আগুন পাশে থাকলে ভেড়ার ডাক হাঁসের ডাকের মতো হয়ে যায়। আগুনে ভেড়া, ছাগল, হাঁস সবই ঝলসে যায়।
নীলার সঙ্গে দেখা হলে এ ধরনের অযাচিত কথা-বার্তা হয় বেশি। তারপর এক সময় বাসায় পৌঁছে দেই।
ঠিক করলাম আজ আর আড্ডায় যাব না। অনেক দিন নীলার সঙ্গে দেখা নেই। ওর সঙ্গে দেখা করি। বাসায়ই ছিল। মাত্র গোসল করেছে। অবেলায় কেন গোসল করলো বুঝলাম না। ওর বাবা-মা এলেন। ওর মা হাহাকার করে উঠলেন। অনুযোগের সুরেই বললেন, এত দিনে বুঝি মনে পড়লো? এমন আহলাদিত হয়ে বললেন, যেন আমি বিশেষ কেউ। এ রকম হাহাকারের জবাবে ঠিক কী ধরনের বাক্য ব্যবহার করলে সঠিক উত্তর হয় বুঝতে পারলাম না। তারপরও বললাম- একদম সময় হয় না আন্টি। অফিসে এতো চাপ থাকে যে, কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় না। আজও আসা হতো না। এদিকে অফিসিয়াল একটা কাজ ছিল। ভাবলাম, আপনাদের সঙ্গে দেখা কের যাই। এতগুলো মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে বারবার কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। নীলার চোখে চোখ পড়ে। মিটমিট করে হাসছে। পায়ের তালুতে চুলকানি শুরু হয়েছে। জুতোও খুলতে পারছি না। চুলকাতেও পারছি না। শুধু ফ্লোরে জুতোর তলা ঘষে যাচ্ছি। কাজ হচ্ছে না। নীলার রহস্যময় হাসি আর চুলকানিতে অস্বস্তি লাগছে। নার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। বারবার মনে হচ্ছে ঢাহা মিথ্যাটা ঠিকমতো উপস্থাপন করা হয়নি। ধরা পড়ে গেছি। এই এক সমস্যা, কোন কিছু গুছিয়ে বলতে পারি না। গুছিয়ে কথা বলা যে কত বড় শিল্প, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এটাও টের পাচ্ছি, আমি একটা হাফ-ফিনিশড মানুষ। নীলার মতো আগুনের মোকাবেলা হাফ-ফিনিশড মানুষ করতে পারে না। আমি নিশ্চিত, নীলা এখন আমার ভেতরের পুরোটাই দেখছে। কি ভাবছি, চিন্তা করছি, সহজেই পড়তে পারছে। সব জানছে। আমি ওর নিকট স্বচ্ছ কাচের মতো। ওর কঠিন দৃষ্টিতে লোহাও গলে যায়। আর আমি তো সামান্য হাফ-ফিনিশড মানুষ।
ওদের ড্রইং রুমটা চার কোণাকৃতির। ফুটবল মাঠের মতো। চারপাশে আধুনিক সোফাসেট। দু’পাশে দুটো লম্বাকৃতির। অপর দু’পাশে দুটো করে চারটা। মাঝে যথেষ্ট ফাঁক। যেন দুইপাশের দুই গোলপোস্ট। আমি বসেছি বাঁ পাশের গোলপোস্টের একটিতে। নিজেকে গোলকিপার মনে হচ্ছে। গোলকিপার দাঁড়ায় পোস্টের ঠিক মাঝামাঝি। ব্যাঙের মতো হাঁটু ভেঙ্গে। আমার অবস্থা পোস্টের একপাশে। ইঁদুরের মতো। যে কেউ ইচ্ছা করলে একের পর এক গোল দিয়ে যেতে পারে, আমার ঠেকানোর উপায় নেই। অবশ্য তরুণ হলে কোনো সমস্যা ছিল না। চালু ছেলে। আমার মতো বলদ না। একপাশে থাকলেও ডাইভ দিয়ে ঠিকই বল আটকে দেবে। পায়ের তলায় সবুজ রংয়ের ঘাসের মতো কার্পেট। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। না করারই কথা। বেকুবদের কোনো খেয়াল থাকে না। কার্পেটে এমন সবুজ হয়, ভাবা যায় না। জীবনেও এমন সবুজ দেখিনি। হঠাৎ মনে হলো সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকি। এক দৃষ্টিতে সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকলে নাকি চোখের জ্যোতি বাড়ে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকারও উপায় নাই। আংকেল আর আন্টি সোফায় বসে আছেন। যেন গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন। খেলোয়াড় দু’জন। আমি আর নীলা। নীলা স্ট্রাইকার। আমি গোলকিপার। একের পর এক গোল দিয়ে যাচ্ছে। ঠেকাতে পারছি না। পারার কথা না। পোস্টের এক পাশে বসে থাকলে কি ঠেকানো যায়! ঠেকাতে হলে মাঝামাঝি দাঁড়াতে হয়। একেবারে মুখোমুখি। আন্টি কথা বলেই যাচ্ছেন, আমি শুধু জ্বি জ্বি করে যাচ্ছি। প্রতি কথাই জ্বি বলছি। যেন জ্বি হুজুর। হওয়াটাই স্বাভাবিক। নীলার মা বলে কথা! তবে তার কোনো কথাই এখন কানে ঢুকছে না। আমি এখন ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত। নীলার গোল ঠেকানোর উপায় খুঁজছি। নীলার দিকে চোখ যায়। মিটিমিটি হাসি লেগেই আছে। মারাত্মক লজ্জায় পড়ে গেলাম। আংকেল এতক্ষণ চুপ ছিলেন। তিনি সাধারণত গল্প জমানোর আগে আট মিনিট চুপ হয়ে বসে থাকেন। ধ্যান করেন। ঠিক আট মিনিট পর যখন শুরু করেন তখন আর থামেন না। বলতেই থাকেন। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। প্রতিবারই দেখেছি আট মিনিট পর কথা শুরু করেন। থামাথামি নাই। মজার বিষয় হচ্ছে, গল্পের বাইরে স্বাভাবিক সময়ে তিনি আমাকে চেনেন না। পারতপক্ষে কথা বলেন না। আংকেল কথা শুরু করেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, চাকরি-বাকরি কেমন চলছে? বললাম, ভালো। তিনিও বললেন, খুব ভালো! এখন যে অবস্থা চলছে তাতে যোগ্য লোকের কোনো স্থান নেই বুঝলে! বুঝলাম, এখন তিনি নিজের কথা বলা শুরু করবেন। সহসা থামবেন না। বললেন, অযোগ্য হয়ে যাও। অযোগ্য, বুঝলে! এ যুগে চলতে হলে তোমাকে অযোগ্য হয়ে যেতে হবে। তোমার অযোগ্যতাই যোগ্যতা। যেখানেই যাও না কেন, দেখবে সব অযোগ্য লোক বসে আছে। কচুটাও বোঝে না। তারপরও মহাজ্ঞানীর ভান করে বসে থাকে। এদের সামনেই তোমাকে মাথানত করতে হবে। উপায় নেই! কাজ করতে হলে তোমাকে তাই করতে হবে। কাজেই তোমার যোগ্য হয়ে লাভ কী! তার চেয়ে অযোগ্যই হও। অযোগ্য হয়েই মাথানত কর। এতে কোনো কষ্ট পাবে না। কোনো গøানি থাকবে না। কারণ তুমিও অযোগ্য। সেও অযোগ্য। যোগ্য হয়েছে তো মরেছো! আংকেল যেভাবে তুমি তুমি করে কথাগুলো বলছেন, তাতে মনে হলো আমাকে বলছেন। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। অযোগ্যর মন যোগ্য যোগ্য আর কী! তার কথায় নিজেকে অযোগ্যই মনে হতে লাগলো। অথচ এখন যদি বলি, আংকেল, নীলাকে বিয়ে করতে চাই। নিশ্চিতভাবেই তিনি বসা থেকে ¯িপ্রংয়ের মতো তিড়িং করে তিন হাত লাফিয়ে ওঠবেন। তখন ওনার এতক্ষণের এই দীর্ঘ বক্তব্য মিথ্যা হয়ে যাবে। নিজের নব আবিষ্কৃত থিওরি ভুলে বলবেন, যোগ্য হও, যোগ্য হও! সমস্যাটা এখানেই। আমরা অন্যকে যে উপদেশ দেই, তা নিজে কখনই পালন করি না। করবও না। উপদেশ দিতে ভালো লাগে। দেয়ার পর আরাম বোধ হয়। এ জন্যই আগ্রহ সহকারে অকাতরে তা বিলিয়ে দেই। আন্টি আগেই ভেতরে চলে গিয়েছিলেন। আমার বিষয়টি সম্ভবত আঁচ করতে পেরে আংকেলকে ডেকি নিয়ে গেলেন। ফুটবল মাঠে এখন আমি আর নীলা। নীলা আমার পাশের পোস্টে বসেছে। দু’জন দু’প্রান্তে। মানব পোস্ট হয়ে বসেছি। এখন যে কেউ এসে গোল দিতে পারে। ওর চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। চুলের গোড়া থেকে পানি চুঁইয়ে পড়ে আগায় এসে মোটা হয়ে ফুলে ছোট মুক্তার দানার মতো হয়। তারপর নিঃশব্দে ঝরে যায়। যেন চুল থেকে মুক্তা ঝরছে। এই মুক্তা আবার ওর পিঠেও পড়ছে। সাদা কামিজের কিছু অংশ ভিজে গেছে। সেখান দিয়ে কালো অন্তর্বাস ফুটে উঠেছে। নীলা এমনিতেই ফর্সা, তার ওপর কালো অন্তর্বাস! এ দৃশ্য যে কোনো পুরুষকে কাবু করার জন্য যথেষ্ট। আমি শান্তশিষ্ট বলদ হলে কি হবে! চোখ ডেঞ্জারাস। কোনো কিছু এড়ায় না। আমি একটা মিনমিনা শয়তান। মুখে কথা না ফুটলেও চোখ ঠিকই পিঁপড়ার মতো গুটিগুটি পায়ে মেয়েদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে হেঁটে বেড়ায়। দু’জনই চুপ হয়ে বসে আছি। অস্বস্তি লাগছে। মনে মনে রাগ হচ্ছে। ও কেন কথা বলছে না। অন্য সময় হলে তো এতাক্ষণে কথার খই ফুটতো। সহজে থামতো না। দেখলাম ও এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর শান্ত অথচ কী গভীর দুটো চোখ আমার দিকে তাক করা। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। বারবার মনে হচ্ছে, ও আমার ভেতরের সব চিন্তা একটা একটা করে জানছে। ওকে ঝাপটে ধরে যে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে, এটাও জেনে ফেলছে। উহ্ কী লজ্জা! হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল, অফিসের কাজে এসেছিলেন বুঝি? স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন। দীর্ঘ নীরবতা ভাঙ্গার উদ্বোধনী কথা। কিন্তু ওর প্রশ্নের শেষে বুঝি শব্দটিতে খটকা লাগলো। মনে হলো মিথ্যা বলা ধরে ফেলেছে। ইচ্ছা করেই বিব্রত করতে চাইছে। বলেই ফেললাম- না, তোমাকে দেখতে এসেছি। অনেক দিন দেখিনি তো! ভাবলাম দেখে আসি।
-কেমন দেখলেন।
-ভাল! বলেই মনে হলো, এ আবার কেমন কথা! ও আজ এমন কাটাকাটা কথা বলছে কেন? এনিথিং রং?
নীলা চুপ হয়ে আছে। কথা বলছে না। চুপ করে থাকা ওকে মানায় না। ও হচ্ছে ঝর্ণা। ঝর্ণার মতো অবিরাম ঝরবে। ঝর্ণা থেমে গেলে কি ভালো লাগে? ঝর্ণা ঝরবে, আমি দেখবো। কোনো কথা বলবো না। ঝর্ণা আর আমার চোখ কথা বলবে। ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলার ভাষা আমার নেই। চোখ আছে। চোখও এক ধরনের ঝর্ণা। থেমে থেমে ঝরে। দুঃখে, আনন্দে। কাজেই ঝর্ণাই ঝর্ণার ভাষা বুঝবে। অন্য কেউ বুঝবে না। কেউ না! সেখানে ঝর্ণা যদি থেমে যায়, চোখ কথা বলবে কার সঙ্গে। নীলা মাথা নিচু করে কী যেন চিন্তা করছে। ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কার্পেটের সবুজ ঘাসগুলো খোঁচাচ্ছে। গম্ভীর! অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। ওকে কখনো গম্ভীর দেখিনি। গম্ভীল হলে ও এতো রূপসী হয়! ঠিক হাসের বাচ্চার মতো! বসা থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, -জুনায়েদ ভাই, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
-বলো।
-রুমে চলো।
ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। নার্ভাস হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছি, সিরিয়াস কিছু। বুকটা ফড়ফড় করছে।
-কি হলো! ওঠো! বসে আছ কেন?
উঠলাম। মনে হলো দু’পায়ে একটুও বল নেই। শূন্যে দাঁড়িয়ে আছি। দেহ থেকে মন আলাদা হয়ে গেছে। দেহ আগে। মন পিছে। মন কেবলই বলছে, যাসনে, যাসনে, ওরে যাসনে! তারপরও মনকে জোর করে দেহের সঙ্গে বেধে নীলার পিছু পিছু গেলাম। যেন আসামীকে কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। রুমটা চমৎকারভাবে সাজানো। ঠিক মাঝে একটা সিঙ্গেল খাট। পুরু বিছানা। উত্তর-পশ্চিম কোণে ড্রেসিং টেবিল। সামনে অসংখ্য বিদেশী কসমেটিকস। কতো কী! সবগুলোর নামও জানি না। শুধু চিনলাম লিপস্টিক, নেলপালিশ আর শ্যাম্পু। চিরুনিই আছে কয়েক রকমের। চিকন দাঁত, মোটা দাঁত, আবার কাঁটাযুক্ত ডান্ডার মতো। দখিনের জানালার পাশে বেতের রকিং চেয়ার। সেখান থেকে আকাশ অনেকটা দেখা যায়। খাটের বিপরীতে সোফাসেট। জানালার পর্দা নীল। দেয়ালের রং নীল। খাটের বেডশিট ধবধবে সাদা। মনে হচ্ছে নীল আকাশ একটুকরো মেঘ। এই মেঘের উপর নীলা ঘুমোয়। আমি বসেছি সোফাসেটে। অবস্থা খুবই করুণ। দু’হাঁটু একটার সঙ্গে আরেকটা শক্ত হয়ে লেগে আছে। নীলা রকিং চেয়ারে দুই হাতজোর করে থুঁতনিতে ঠেকিয়ে দোল খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আকাশের কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। দোল খেতে খেতে বললো,
-জুনায়েদ ভাই, তোমাকে যে কথাগুলো বলা দরকার.... না, থাক! আরেক দিন বলবো। থেমে যায়।
ব্যাকুল হয়ে বললাম,
-বলো, বলো! আজই বলো! এখনই বলো!
- না থাক! এমন জরুরী কিছু না।
ওর এ ধরনের হেয়ালি আমাকে অসহিষ্ণু করে তোলে। পাশাপাশি অভিমানীও করে তোলে। বললাম,
-যদি আজ, এক্ষুণি, না বলো তবে মনে রেখ, তোমার সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। আর কোনো দিন দেখা করবো না।
কথাগুলো বলেই মনে হলো হ্যাংলার মতো হয়ে গেল। যেন আমার না দেখা করাতে ওর কিছু যায় আসে। ছোটবেলার খেলবো না টাইপের হয়ে গেল। তবে নীলা জানে, কম কথা বললেও আমি সামান্য জেদী। মিনমিনাগুলো ভেতরে ভেতরে যেমন জেদী হয় তেমন। যা বলি, যা করি, আয়ত্তের মধ্যে থাকলে হাতছাড়া করি না। ভেতরে প্রচন্ড ধড়ফড় চলছে, থামছে না। নীলা চেয়ার ছেড়ে উঠে সামনে দাঁড়ালো। ওর সেই ভয়ংকর দৃষ্টি আমার ওপর। মনে হচ্ছে, গলে যাচ্ছি। গলে গলে পানি হয়ে যাচ্ছি। পানি ঝরে শার্ট ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ কোলে বসে দু’হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। পাতলা গোলাপি ঠোঁট দু’টো ঠোঁটে চেপে ধরে। ওর চুল তখনও একটু একটু ভেজা। চুলগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দু’জনের মুখ ঢেকে যায়। ওর বুক আমার বুকে। ঠোঁটে ঠোঁট। বুকে বুক। পায়ে পা। কেবলই মনে হচ্ছে, নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। দম নিতে পারছি না। প্রচন্ড একটা মধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেতরের সবটুকু নিঃশ্বাস শুঁষে নিচ্ছে। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,
নীলা! আমি কি পুড়ছি? ও বললো, চুপ। কোনো কথা নয়। তারপর আবার আমার নিঃশ্বাস শুঁষে নিতে থাকে। হালকা থেকে হালকা হচ্ছি। ভেতর ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। চমৎকার সুবাস পাচ্ছি। এমন সুবাস জীবনে পাইনি। কতক্ষণ এ অবস্থায় ছিলাম জানি না। যখন নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হলো ঠোঁটের একপাশ জ্বালা করে ওঠে। জিভ দিয়ে চেটে নোনতা স্বাদ পেলাম। বুঝলাম সামান্য কেটে গেছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে। আরও বুঝলাম প্রেম শুরু হয়েছে। আমার সব বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। টের পেলাম বাসায় ফিরে। চেতনাও ফিরেছে বাসায় আসার পর। তার আগ পর্যন্ত রোবট হয়ে ছিলাম। মনের মধ্যে এ কী হলো? কেন হলো? কিভাবে হলো? এ কী করে সম্ভব? বিস্ময় আর অসীম আনন্দের পরিবর্তে এসব প্রশ্ন আমাকে রোবট বানিয়ে রেখেছিল। বিছানায় শোয়ার পর নীলার সুবাসের টুকরোগুলো ক্ষণে ক্ষণে ভেতরে ঢুকছিল। বুঝলাম প্রেম সার্থক হলো। আমি সফল। নীলা তার ঝর্ণার ভাগ আমাকে দিয়েছে। ওর ভেতর যে ঝর্ণা ঝরছে, তা দু’টুকরো করে এক টুকরো আমার ভেতর বসিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে এক ঝর্ণা ছাড়া আরেক ঝর্ণা ঝরবে না। ঝর্ণার সঙ্গে পাখির ডাক, বাঁশির সুর, ফুলের বাগান, প্রজাপতি, নীল আকাশ, সাদা মেঘ, নুড়িপাথর, ঝিরঝিরে বাতাস দিয়েছে। সবগুলোই অর্ধেক। বাকি অর্ধেক ওর কাছে। প্রথমবারের মতো মনে হলো নীলা পাশে শুয়ে নেই। আমার উপর শুয়ে আছে। হৃৎপিন্ড জড়িয়ে ধরে আছে। ওর চোখে-মুখে আহলাদ। আজ আর ওর সঙ্গে দুষ্টুমি করব না। আঙুল কামড়ে দেব না। গালে গাল ঘঁষবো না। পায়ের ভেতর পা দেব না। ব্লাউজের বুতাম খুলবো না। ব্রার স্ট্রিপ টানব না। ও আজ আমার শরীরের উপর ঘুমাবে। গভীর ঘুম। ও ক্লান্ত!
নিজেকে পূর্ণ মনে হচ্ছে। ভেতর থেকে আপনা আপনি সুর বেরুচ্ছে। রিকশায় অফিস যেতে যেতেই গুণগুণ করে গাইছি। পৃথিবীটা দারুণ! কালার ফুল! আলোকিত! সবকিছুই ভালো লাগছে। আহ্, কী সুন্দর! আশ্চর্য! সুবাস তখনও শরীরে লেগে আছে। মনে হচ্ছে, নীলা গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝে আছে। নীলা!
- হু! ওঠো! অফিস এসে গেছে।
- আমিও অফিসে যাব। তোমাকে এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে পারবো না। আমাকে নিয়ে চলো। প্লিজ!
নীলা অফিসের গেট পর্যন্ত সঙ্গে ছিল। পিয়ন এসে বললো, স্যার! নীলা নামে একজন ফোন করেছিল। আপনাকে ফোন করতে বলেছে। অবাক হলাম! এখন বাজে ১০টা। এতো সকালে কেন ফোন করেছে! বুঝলাম, প্রেম শুধু আমাকেই ধরেনি। ওকেও ধরেছে। নিশ্চিত রাতে ঘুম হয়নি। ব্যাকুল হয়ে আছে, কথা বলার জন্য। মনে দুষ্ট বুদ্ধি এলো। ফোন করবো না। ধরাও দেব না। ওকে তৃষ্ণার্ত করে তুলবো। গভীর তৃষ্ণা! যখন সহ্য করতে পারবে না, বৃষ্টি হয়ে একদিন হাজির হবো। অভিমান করবে। কাঁদবে! বলবে, যাও! তোমার সঙ্গে কথা নেই। যতো বোঝাতে যাবো, বুঝতে চাইবে না। অভিমান আরও গাঢ় হবে। ফুলে উঠবে। ফর্সা মুখ লাল হবে। নাক ফুলে লাল হবে। তারপর আদর করব। শিশুদের মতো বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিল দিয়ে বলবে তুমি নিষ্ঠুর, পাষাণ! কেন কষ্ট দিলে। আমার অর্ধেক ঝর্ণা ওর অর্ধেকের সঙ্গে মিশে যাবে। পূর্ণ হবো দু’জন।
নীলার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। অফিসে প্রচন্ড কাজের চাপ! নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ নেই। কখনো রাতেও অফিসে থাকতে হতো। মার্কেটিংয়ের চাকরি। বাইরে কাজ বেশি। ঢাকার বাইরেও সিলেটে যেতে হয়েছে। অফিসে ফিরে শুনতাম ফোন করেছিলো। মোবাইলে ফোন দিত না। আমাদের প্রেমটা সেকেলে। এখনকার মতো মোবাইল প্রেম না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলা নীলার পছন্দ না। টিএন্ডটি ফোনে কথা বলা এবং সপ্তাহে একবার দেখা করা। এমনই আমাদের প্রেম। অফিসে ফিরে যখন শুনতাম নীলা ফোন দিয়েছিল, তখন মনটা ভালো হয়ে যেত। ভাবতাম ও পুড়ছে, অদৃশ্য আগুনে। তৃষ্ণা গভীর হচ্ছে। সাত দিন চলে গেছে। কাজের চাপ কমেছে। এবার যোগাযোগ করা যায়। অফিসেই ছিলাম। ফোন ধরলাম। খুব শীতল কণ্ঠে বলল,
-তুমি কি আজ একটু আসতে পারবে? বুঝলাম কঠিন অভিমান করেছে। মনে মনে খুশি হলাম। -কখন? কোথায়?
-রমনা গ্রীনে। বিকেল পাঁচটায়।
-ঠিক আছে। আসছি।
পাঁচটা পাঁচে হাজির হলাম। লোহার ছাতার নিচে নীলা বসে আছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে। পাশে গিয়ে বসলাম।
-পার্কের গাছগুলো খুব বেশি সবুজ মনে হচ্ছে না? মনে হচ্ছে, সব গাছ আজ লাজুক বধূ হয়ে সেজেছে!
-আমিও তো সেজেছি। তোমার চোখে পড়েনি।
-তোমার কারণেই তো প্রকৃতি আজ এমনভাবে সেজেছে। তুমি সুন্দর, প্রকৃতি সুন্দর! সব! সব সুন্দর! কথা শেষ হয় না। কোকের গ্লাস হাতে এক হ্যান্ডসাম যুবক এসে হাজির। নীলা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বলল,
-তোমাকে পরিচয় করে দেই।
-চিনি তো!
-চেন?
-হ্যাঁ! তোমার কাজিন সোহেল না?
-না-হ্!
চুপসে গেলাম।
-ও তিমির! বিজনেস ম্যান। হাত মিলালাম। তিমিরের হাতের থাবা বিশাল। আমার পুরো হাত ওর থাবায় হারিয়ে গেছে। হঠাৎ নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হলো। মনে হলো ওদের দু’জনের মাঝে আমি এসে পড়েছি। অথচ মনে হওয়া উচিত ছিল, আমার আর নীলার মাঝে তিমির এসে পড়েছে। কেন এমন মনে হচ্ছে! ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। তারপরও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে কথা বলছি। বারবার মনে হচ্ছে, নীলা তিমিরে হারিয়ে গেছে। কুচিন্তা মাথায় আসছে। তিমির উঠে দাঁড়ায়। স্মার্টলি বলল, আপনারা বসুন! একটা জরুরি কাজ আছে। এখনই ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। তিমির চলে গেল। নীলা জিজ্ঞেস করল, কেমন? ওর ‘কেমন’ কথা হৃদয়ে বাজল। কষ্ট হতে লাগল। খুব কষ্ট। ওর এ কথায় বুঝে গেছি নীলা হারিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে গিয়েও কণ্ঠ অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছি, ও যাতে আমার অস্বাভাবিকতা বুঝতে না পারে। তারপও প্যাঁ আওয়াজ তুলে শব্দ বের হলো।
- চমৎকার! দারুণ হ্যান্ডসাম!
- হ্যান্ডসাম ঠিক না। একটু লম্বা! তবে হ্যান্ডসাম ইনকাম করে। ঢাকায় দুটো বাড়ি আছে। খুব স্বাবলীলভাবে নীলা কথাগুলো বলে যায়। প্রতিটি কথা আমার ভেতরকে এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে। আমার মর্মে আঘাত হানছে। নিষ্ঠুরভাবে অপমানিত হচ্ছি। তিমিরের ধারে কাছে আমি নেই। আমি সাড়ে পাঁচ ফুট, তিমির ছয় ফুট। আমার স্যালারি বেয়াল্লিশ হাজার। তিমিরের আয় লাখের উপর। আমার বাড়ি নেই। তিমিরের একটা না, দুটো বাড়ি। আমার বয়স ২৬। তিমিরের ৩২। সবদিক দিয়েই তিমির লম্বা। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছি। এই হাসির ওজন অনেক। ভারে চোয়াল নিচের দিকে ঝুলে মুখ বারবার হা হয়ে যাচ্ছে। আর এক সেকেন্ডও ওর সামনে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও হা হয়ে বসে আছি। শুধু নীলা বুঝতে দিতে চাচ্ছি না যে, সহ্য করতে পারছি না বলে চলে যাচ্ছি। কঠিন পরীক্ষায় পড়ে গেলাম। মনে হচ্ছে, গায়ে আগুন ধরে গেছে। আগুনে পুড়ে যাচ্ছি। নীলা বলল, আইসক্রীম খাব! তার অর্থ আরও কিছুক্ষণ বসতে হবে। ও কি জেনে বুঝে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, পোড়াচ্ছে! বললাম, নাও না! যা খেতে মন চায় খাও। ওর আচরণ স্বাভাবিক। জড়তা নেই। চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে। চাপা আনন্দ চোখে মুখে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর ফর্সা দেহের শিরায় শিরায় টকটকে লাল রক্তের নাচন। পুরো পনের মিনিট লাগাল আইসক্রিম খেতে। দুঃখের রাত নাকি দীর্ঘ হয়। আমার কাছে বিকেলের এই পনের মিনিটকে মনে হলো পনের কোটি বছর।
-চলুন যাওয়া যাক!
-তোমার সঙ্গে তো গাড়ি আছে! তুমি চলে যাও। আমার জরুরি একটা কাজ আছে। আজ যেতে পারব না। বলেই আর দাঁড়ালাম না। হাঁটা দিলাম। দূর থেকে দেখলাম, নীলা থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত সিএনজিতে উঠে পড়ি। ভাল লাগছে না। কিছুই ভাল লাগছে না। বুকের ভেতর একটা বিশাল কালো পাথর গরম হয়ে উঠছে। পাথরটা ঠেলে নিঃশ্বাসের সঙ্গে বের হতে চাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। আমার হাত পা, চোখ, কান, ঠোঁটেও কষ্ট পাচ্ছে। প্রত্যেকেই কাঁদছে। এদের নিজস্ব কান্না আছে। আমার কষ্টে এরাও কাঁদছে। কিন্তু আমি কাঁদব না। নিজেকে ঠিক রাখার জন্য মনে মনে বারবার উচ্চারণ করছি, হিরোজ ডাই নেভার, দে লিভ ফর এভার। হিরোরা মরে না। বেঁছে থাকে। তারা নিজেকে ভাঙ্গে। অন্যকে গড়ে। চোখের সামনে এক সীমাহীন মাঠ ভেসে ওঠে। মাঠের মাঝে আমি একা। হঠাৎ চতুর্দিক থেকে বিশাল বিশাল পাথর ছুটে আসতে শুরু করে। একেকটি পাথর উড়ে আসছে আর ঘুষি দিয়ে তা ভাঙ্গছি। কখনো ডান হাতে। কখনো বাঁ হাতে। কখনো পা দিয়ে। কখনো কনুই, হাঁটু দিয়ে পাথরগুলো চূর্ণ করছি। মাথা দিয়েও ভাঙ্গছি। নিজেকে ভাঙ্গছি। দু’হাত শূন্যে তুলে ‘না’ শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করছি। চিৎকার খন্ড-বিখন্ড হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে অসীম সীমান্তে মিশে যায়।
বাসায় ফিরে মনে হলো, আমি যে ওকে ভালবেসেছি, ভালবাসার কথামালা সাজিয়েছি, তা ওর শোনা দরকার। এ জন্য শোনা দরকার, ভালবাসা ওর নিকট পণ্য হতে পারে, একজনকে ভালবাসার লোভ দেখাতে পারে। একজনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্যকে দিয়ে দিতে পারে। আমার কাছে তা নয়। ভালবাসা আমার কাছে আলোর মতো। চাইলেই একস্থান থেকে অন্যস্থানে নেয়া যায় না। ওর মোবাইলে ফোন দিলাম।
-কাল কি কিছুক্ষণের জন্য দেখা করতে পারবে?
-কেন?
-জরুরি কিছু কথা ছিল।
-এখন বলো!
-ফোনে বলা যাবে না। মুখোমুখি বলা দরকার।
-ঠিক আছে। কখন?
-বিকেল পাঁচটায়। রমনা গ্রীনে।
সময় মতোই নীলা এসেছে। আমার তাড়া বেশি তাই আগেই বসেছিলাম। দ্রুত মুক্তি পাওয়া দরকার। নিজে নিজে যে কল্পনার বাঁধনে জড়িয়েছিলাম, তা ছিন্ন ভিন্ন করা দরকার। আজও ওকে ভয়াবহ সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে, আজ হারাব বলেই ও এতো সুন্দর হয়েছে। অসহনীয় সুন্দর আমার সামনে। আসহনীয় আগুন আমার ভেতর। এ আগুন হাজার পৃথিবী পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। অথচ আমি বুক চেপে রেখেছি। জিজ্ঞেস করলাম কি খাবে?
-আইসক্রিম। আইসক্রিমের মতোই ঠান্ডা আর শীতল লাগছে ওকে। কত সহজ আর স্বাভাবিক! বিপরীত চিত্র আমার। পুড়ছি, ছাই হচ্ছি। হৃদয়ে রক্তের ঝর্ণা বইছে। বুঝতে পারিনি ও আমাকে যে অর্ধেক ঝর্ণা দিয়েছিল তা নির্মল ছিল না। তা ছিল রক্তের ঝর্ণা। আইসক্রিম খেতে খেতে বলল,
-কি যেন বলবেন বলছিলেন?
-হ্যাঁ, বলব। আজ সব বলব।
একটু থামলাম। কথা ঠিকমত বের হচ্ছে না। তারপরও বললাম,
-আচ্ছা নীলা! আমি যে তোমাকে ... আমি যে তোমাকে ভালবাসি তা কি তুমি জান?
-জানি।
-তুমি তো জানবেই, আমি যে তোমার সামনে স্বচ্ছ কাচ। ক্রিস্টাল ক্লিয়ার।
-কি হবে এসব জেনে?
ভয়ংকর শোনাল ওর একথা। তারপরও বললাম,
-অনেক। অ-নে-ক কিছু হবে নীলা। অ-নে-ক কিছু হবে। তুমি জান না... তুমি জান না কীভাবে কতভাবে তোমাকে ভালবেসেছি। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে একটি একটি করে মোমবাতি তোমার নামে জ্বেলে গেছি। একটি ‘নী’ হলে অপরটি হয়েছে ‘লা’। এভাবে জ্বালাতে জ্বালাতে যখন পৃথিবীর প্রান্ত শেষ হয়ে গেছে। মোমবাতি নিয়ে উঠে গেছি আকাশে। ঐ যে আকাশে প্রতিদিন যে তারা উঠে, ওগুলো তারা নয়। তোমার নামে জ্বেলে রাখা আমার প্রদীপ। যখন মিটমিট করে জ্বলে তখন ওগুলো তোমাকে ডাকে। তুমি জান না নীলা, এতদিন জানি তোমার আলোয় আলোকিত ছিলাম। যেদিন তিমিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে মুহূর্তে নিজেই নিভে গেলাম। মনে হয়েছিল, আমার ভেতর মিলিয়ন মিলিয়ন পাওয়ারের আলো মুহূর্তে দপ্ করে নিভে গেল। দিশেহারা হয়ে গেলাম। কত স্বপ্ন! আমার কত স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গেল। মনে হলো, কেন বাঁচব? শুধু কি বাঁচতে হবে বলেই বাঁচব? বড় একা মনে হলো। আমার কেউ নেই, কিছু নেই। চিৎকার দিলাম। মহাচিৎকার। চিৎকার ছুটে গেল পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে, দিগন্তে দিগন্তে। প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কাছেই ফিরে এলো। অথচ কেউ এলো না। আমি একা। বড়ই একা। কখন যে চোখ পানিতে পূর্ণ হয়েছে, টের পাইনি। বর্ষার যেমন নদীর দু’ক‚ল কানায় কানায় পূর্ণ হয়, আমার চোখের পানি কানায় কানায় পূর্ণ হলো। দেখলাম নীলাও একটু নড়ে উঠল। ইমোশনাল হয়ে গেল।
-আমাকে এভাবে কেউ কোনোদিন ভালবাসেনি। তুমি এভাবে ভালবাস, ভাবিনি কখনো।
-আমার ভালবাসার ধরণ এরকমই নীলা। এভাবেই ভালবাসি। এভাবেই ভালবাসতে শিখেছি। নীলা দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়।
-জুনায়েদ ভাই।
-বলো।
-আপনি আমার ভাল একজন বন্ধু। আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করবেন?
-নেভার...নেভার। আই কান্ট ডু ইট। কখনোই তা করতে পারব না। আমি মহামানব নই। একজন সাধারণ মানুষ। বলব না, তুমি সুখী হও! স্বামী সংসার নিয়ে সুখে দিন কাটাও। তারা মুখে বলে। অন্তরে বিশ্বাস করে না। আমি কষ্টে থাকব। তুমি সুখে জীবনযাপন করবে, এ কামনা কখনোই করতে পারি না। চলো উঠি।
নীলাকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় চলে এলাম। নিজেকে চরম অপমানিত মনে হলো। অপমানের দাগ দেখা যায় না বলে এর ভয়াবহতা কেউ দেখে না। আমার দাগও কেউ দেখছে না। শুধু আমি দেখছি। বারবার মনে হচ্ছে, অর্থের কাছে হেরে গেলাম। অর্থের কাছে আমার ভালবাসার করুণ মৃত্যু হলো। খুব অসহায় লাগছে, খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। এখন আমি চাইলেই তিমির হতে পারি না। কখনো সম্ভব নয়। পৃথিবীতে ভালবাসা বলে কিছু নেই। ভালবাসা প্রকাশের চিরন্তন কথা আই লাভ ইউ এখন অচল। বলতে হবে, আই মানি ইউ। লাভ লাইজ মানি। টাকার ভেতর ভালবাসা ঘুমায়। আমার ছোট বোন মীরা কথায় কথায় একদিন বলেছিল ভাইয়া, মেয়েদের তুমি কখনো চিনতে পারবে না। এখন মেয়েরা অত্যন্ত চতুর ও সচেতন। তারা হাতের পাঁচ হিসেবে একজনকে হাতে রাখে। তার সঙ্গে প্রেমির অভিনয় করে। তারা হাতের পাঁচ নিয়েই ঘর বাঁধে। তুমি জান না ভাইয়া, মেয়েরা এমনই হয়। ওর কথা মানতে পারলাম না। মনে হলো, মেয়েরা এমন হয় না। নীলার মতো মেয়েরা এমন হয়। কাজেই নীলাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আমি অন্তত এক নীলাকে হত্যা করতে পারি। পকেট থেকে রিভলবার বের করে নীলার দুই ভ্রুর ঠিক মাঝখানে গুলি করে দিলাম। মেরে ফেললাম নীলাকে। মনে মনে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন