Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বপ্নের শহর ইস্তাম্বুলে

সৈ য় দ শা ম ছু ল হু দা । | প্রকাশের সময় : ২৭ জুন, ২০১৯, ১২:৩৭ এএম

মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বিশেষ অধ্যায় দখল করে আছে তুরস্কের ইতিহাস। আর তুরস্কের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ইস্তাম্বুল। অটোমান সাম্রাজ্যই বলি আর উসমানী খিলাফত এর কথাই বলি ঘুরে-ফিরে যে নামটি আমাদের সামনে চলে আসে সেটা হলো ইস্তাম্বুল। সেই ইস্তাম্বুল দেখার স্বপ্ন ছিল সীমাহীন। মহান আল্লাহ তায়ালার হাজারো শুকরিয়া, তিনি এতো তাড়াতাড়ি সেই স্বপ্নপূরণ করে দিবেন তা কল্পনা করতেও পারিনি।
“ইস্তাম্বুল ফাউন্ডেশন ফর সাই্ন্স এন্ড কালচার” এর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে একদল উলামা ও বুদ্ধিজীবীকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমার শ্রদ্ধেয় মুরুব্বি, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জগতের অন্যতম রাহবার, বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট (বিআইএম) এর সম্মানিত সভাপতি, আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী দা.বা. এর সৌজন্যে উলামাদের সেই তালিকায় আমার নামটিও আসে। একটি বড় কাফেলার সাথে স্বপ্নের দেশ তুরস্ক, ইস্তাম্বুল, কোনিয়া, রুম ঘুরে দেখবো তা ভাবতেই যেন মনটা কেমন আনচান করে উঠলো। ভাবতে ভাবতেই আমাদের সকলের ভিসাও হয়ে গেলো। খুব স্বল্প সময়ের ভেতর তুরস্ক সফরের জন্য সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ১৯শে এপ্রিল ২০১৯ ভোর ৬.২৫এ আমাদের ফ্লাইটের সময় নির্ধারিত হলো।
সফরের আনন্দ ও উত্তেজনায় ১৮ এপ্রিল রাতটি যে কীভাবে পার হয়ে গেলো তা যেন কিছুই টের পেলাম না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাদের সফরের ১৮ জন সাথী ১৮ এপ্রিল রাত দুটোর মধ্যে সবাই হযরত শাহজালাল রহ. বিমানবন্দরে হাজির হয়ে গেলাম। বিমানবন্দরেই সব সাথীদের সাথে পরিচয় হলো। কে কে যাচ্ছেন আমাদের কাফেলায় তা সময়ের বাস্তবতায় ও দ্রুততার কারণে এর আগে জানা সম্ভব হয়ে উঠেনি। আমি বিমানবন্দরে রাত ১টায় পৌঁছলেও সাথে বিমানের টিকেট, পাসপোর্ট কিছুই না থাকায় অন্যসাথীদের অপেক্ষায় থাকলাম। রাত দুটোয় মুহতারাম নদভী সাহেব বিমানবন্দরে ১নং গেইটে পৌঁছলেন। মুহতারাম তার ভাগ্নে সিবগাতুল্লাহ রাশেদকে দিয়ে আমার কাগজপত্র ৬ নাম্বার গেটে পাঠিয়ে দিলে আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিমানবন্দর লাউঞ্জে প্রথম দেখা হয় অন্যসাথীদের সাথে। দেখা হয় বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদাররেসীন এর সম্মানিত সেক্রেটারী জেনারেল, মাওলানা শাব্বির আহমদ মুমতাজি সাহেবের সাথে। তার নেতৃত্বে জমিয়তুল মুদাররেসিন এর ৮ জন সফরে যাচ্ছেন। অন্যসাথীগণ হলেন দারুন নাজাত কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আ.ক.ম আবু বকর সাহেব, ময়মনসিংহ জমিয়তুল মুদাররেসীন এর সভাপতি ড. ইদ্রিস খান, যশোর জেলা জমিয়ত সভাপতি, আমিনিয়া আলীয়া মাদ্রাসার উপধ্যক্ষ মাওলানা নুরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ জেলা জমিয়ত সভাপতি, মাওলানা আতিকুর রহমান, বিশ্বনাথ কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা মুফতি নোমান আহমদ, রাজবাড়ী জেলা জমিয়ত সভাপতি মাওলানা আবুল ইরশাদ মোহাম্মদ সিরাজুম মুনীর ও প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা হাসান মাসুদ। অপরদিকে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী সাহেবের অন্য সাথীগণ হলেন, শায়খ যাকারিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, সেই মাদ্রাসারই শিক্ষক মাওলানা মুফতি রিদওয়ানুল কবির, ড. মাওলানা খলীলুর রহমান খান আল আযহারী, জাগ্রত কবি মুহিব্বুর রহমান খান, সিবগাতুল্লাহ রাশেদ, ময়মনসিংহের একটি ইসলামী সংস্থার প্রধান মাওলানা আসাদুজ্জামান আসাদ, তাঁরই সহকারী মাওলানা আবুল কাসেম, উত্তরার বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আতিক খান ও আমি সৈয়দ শামছুল হুদা, সেক্রেটারি বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট।
১৯ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ প্রথম প্রহরে বিমানবন্দরের সকল কার্যক্রম সমাপ্ত করে তার্কিশ এয়ারলাইন্স এর ৭১৩নং ফ্লাইটে আমরা সকলেই আরোহন করলাম। কোনপ্রকার বিরতি ছাড়াই তার্কিশ সময় ১টা ১৩ মিনিটে তুরস্কের নবনির্মিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরণ করলাম। প্রায় ৭হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে যখন তুরস্কের আকাশ দেখলাম, তখন হৃদয়াকাশে ইতিহাসের অনেক কিছুই স্বপ্নের মতো ভেসে উঠতে লাগলো। তুরস্কের এই নবনির্মিত বিমানবন্দরটি কতবার যে ইউটিউবে দেখেছি, তার হিসাব নেই। আমি আজ সেই বিমানবন্দরে সরাসরি পা রাখতে যাচ্ছি ভেবে শরীর ও মন শিহরে উঠলো। আল্লাহর তায়ালার শুকরিয়া জানালাম। আলহামদুলিল্লাহ।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে যেই বন্দরটি সেটা কি আর সহজেই পার হওয়া যায়! যেদিকেই চোখ যায়, এর বিশালত্ব দেখে শুধুই প্রাণ ভরে উঠে। আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ছোঁয়ায় সবকিছুই যেন অন্যরকম লাগছে। যে দিকেই চোখ যায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিমান থেকে নেমে আমরা আঠারো জন একটি জায়গায় একসাথে হলাম। সফরের আমীর ও মুরুব্বি নদভী সাহেবের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে চললাম। জনাব নদভী সাহেব ইমিগ্রেশনে থাকা অফিসারকে সালাম দিলেন। আমরা সকলেই হাসতে হাসতে ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম। বিমানবন্দরে ডলার ভাঙ্গালাম। একশ ডলার সমান পাঁচশত সতের লিরা আমরা পেলাম।
অতঃপর আমরা যখন লাগেজের দিকে এগিয়ে চলছি, তখন সিবগাতুল্লাহ রাশেদ বললো, মেজ মামাকে তো দেখছি না! আমাদের একবারও এটা ধারণায় আসেনি যে, ইনভাইটেশন লেটারে নামের বানান বিভ্রাটে তিনি ইমিগ্রেশন পার হতে পারেননি। তিনি একেবারেই পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন। কোন কারণে তিনি ইমিগ্রেশন পার হতে পারেননি। এ জন্য একটা কষ্টকর পরিবেশ তৈরী হলে। তারপরও সকলেই যেহেতু দীর্ঘসফরের কারণে ক্লান্ত, তাই জনাব নদভী সাহেব পরামর্শ দিলেন- ওর একটা ব্যবস্থা হবে, সকলের কষ্ট করার দরকার নেই। আমাদেরকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করার জন্য যারা এসেছিলেন তাদের সাথে আপাতত: আমাদের নির্ধারিত জায়গায় চলে যাওয়াটাই মনে হয় ভালো।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে আমরা ইস্তাম্বুলের উসকুদার জেলার গোজলতেপে মহল্লার আতাইকি রোডের দিকে ছুঁটে চললাম। রাস্তার দু’ ধারের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে তুরস্কের উন্নতির কিছুটা আঁচ করা সম্ভব হচ্ছিল। এত সুন্দর এই দেশ, এত সুন্দর এর রাস্তাঘাট, এত উন্নত এদের উন্নয়ন পরিকল্পনা তা ভাবতে ভাবতে, দেখতে দেখতেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত জায়গায় চলে আসলাম। ইস্তাম্বুলের উচুঁ-নীচু রাস্তা পার হয়ে এমন একটি জায়গায় আমরা পৌঁছে গেলাম- যে জায়গাটি বসফরাসের পাড়ে, একটি উচুঁ পাহাড়ে অবস্থিত। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে সুলতান সেলিম ব্রীজ দেখা যায়, দেখা যায় বসফরাস, দেখা যায় বসফরাসের দুই পাড়ে অবস্থিত ইউরোপ ও এশিয়ার দুই অংশের ইস্তাম্বুলকে। আমরা যে অংশটিতে গিয়ে দাঁড়ালাম সেটি হলো এশিয়ার শেষ অংশ। অপর পাড়েই ইস্তাম্বুলের ইউরোপ অংশ। প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। কী চমৎকার দৃশ্য তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। একেই বলে নয়নাভিরাম দৃশ্য। আমরা গাড়ী থেকে নামলাম। এই প্রথম এরদোয়ানের সুযোগ্য নেতৃত্বের ছুঁয়ায় বদলে যাওয়া উন্নত তুরস্কের কোন বাড়ীতে প্রবেশ করা। সত্যিই অসাধারণ একটি দোতল বাড়ী। উন্নত ইউরোপের উন্নয়নের ছোঁয়ায় সবকিছুই যেন বদলে গেছে। বাড়ীর ভেতর ও বাহিরের পরিচ্ছন্নতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তুরস্কের রাস্তাঘাট, তুরস্কের বাড়ী-ঘর সবকিছুই যেন মনের মতো করে সাজানো। ফুলের সমাহার দেখে চোখ ফেরানো দায়। অত:পর রাতের বেলা যখন স্থানীয় দায়িত্বশীলদের জানানো হলো যে, আমাদের একজন সম্মানিত মেহমানকে অহেতুক ইমিগ্রেশন পার হতে দেয়নি, তখন তারা তরিৎ উদ্যোগ নিলেন এবং ডেপুটি হোম মিনিস্টার ড. খলীল সাহেবের জন্য রাতের খাবার, শীতের পোশাক নিয়ে তাড়াতাড়ি বিমানবন্দরে গাড়ীসমেত লোক পাঠিয়ে দিলেন। রাতের শেষ প্রহরের দিকে জনাব খলীল সাহেব আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন। এর মাধ্যমে সাথীদের সকল পেরেশানী দূর হয়ে গেলো। এবারও আমরা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। শুরু হলো আমাদের স্বাভাবিক প্রোগ্রাম।
প্রতিদিন সকালে তুরস্কের ধর্মীয় পুর্নজাগরণের অন্যতম রাহবার, আধ্যাত্মিক নেতা বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী রহ. এর রচনাবলীর সাথে পরিচিতিমূলক সংক্ষিপ্ত দরস হতো। অতঃপর উক্ত সংস্থার নিজস্ব গাড়ীর মাধ্যমে ইস্তাম্বুলের প্রিয় জায়গাগুলো একে একে ঘুরে দেখা শুরু হয়। প্রথম দিনেই সফর করি, হযরত ইউশা আ. এর কবর। জায়গাটির নাম ইইশা তেপে। আনাদুলু খাবাক, মহল্লা বেইখুুঁজ। বসফরাসপ্রণালী ঘেঁষে পাহাড়ের ওপর হযরত ইউশা আ. এর এই মাকবারায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জিয়ারতে আসে। তুরস্কের ঐতিহ্য অনুসারে মাজারের পাশে চমৎকার একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ইউশা আ. এর কবর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইউশা আ. এর তুরস্কে আসা না আসা সম্পর্কে সঠিক কোন ইতিহাস পাওয়া না গেলেও এখানে প্রায় ৩৫-৪০ ফিট দৈর্ঘ্য ও প্রায় ৪-৫ ফিট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি কবরস্থান রয়েছে। যাকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষ আসছে। জিয়ারত করছে। আগন্তুক মহিলা ও পুরুষরা দুআ-দুরুদ পড়ছে। সিরিয়ার হালব শহরের নিকটবর্তি মারবাশ নামক স্থানেও এমনি একটি কবর রয়েছে বলে জানা যায়। ১৭৫৫ সালে মুহাম্মদ সাঈদ পাশা এই কবরের পাশে একটি চমৎকার শৈলীর মসজিদ নির্মাণ করেন। কোন এক অগ্নিকান্ডে মসজিদটি ভেঙ্গে পড়লে ১৮৬৩ সালে সুলতান আব্দুল আজিজ কর্তৃক মসজিদটি পুনঃনির্মিত হয়। ধারণা করা হয় এটি ইউশা আ. এর কবর। এটিকেই মানুষ জিয়ারত করতে আসে। উল্লেখ্য যে, তুরস্কে কোন মাজারেই কোন প্রকার শিরক ও বিদআত চোখে পড়ে না। এখানে কোন মাজারকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্খিত কোন ধান্দাবাজির সুযোগ নাই। এসব কারণে এদেশে নকল মাজার গড়ে উঠে না।
এরপর সেখান থেকে চলে যাই তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অন্যতম কীর্তি চামলিজা বুয়ুক জামি, চামলিজা, উসকুদার এ। চামলিজা’ এলাকার নাম। এখানে সবগুলো মসজিদই সাধারণত: এলাকার নামে গড়ে উঠে। যদিও এ মসজিদটির মূল উদ্যোক্তা এরদোয়ান, কিন্তু তার নামে কোন কিছু এখানে নেই। মসজিদে প্রায় একসাথে ৬৩ হাজার লোক নামায আদায় করতে পারবে। বিশাল আয়তনের এই মসজিদটিতে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে প্রাচীন ঐতিহ্যের সমন্বয় সাধন করা হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ভীড় করছে।
পরদিন সফর ছিল বিখ্যাত সাহাবী আবু আইয়ূব আল আনসারী রা. এর কবর জিয়ারত। এলাকাটির নামকরণ হয় আইয়ুবী থানা হিসেবে। এই মাজার নিয়েও মজার কাহিনী রয়েছে। ১৪৫৩ সালে উসমানী খলিফা মুহাম্মদ আল ফাতেহ রহ. যখন কন্সটান্টিনোপল জয় করেন, তারপর এখানে মাজারটি গড়ে উঠে। এখানে আরো অসংখ্য কবর রয়েছে। পাহাড়ের ওপরে অসংখ্য কবর যেমন রয়েছে তেমনি সমতল ভুমিতেও অনেকগুলো কবর রয়েছে। জানা যায় যে, মুহাম্মদ আল ফাতেহ এলাকাটি বিজয় লাভ করার পর তার উস্তাদ আকসামউদ্দীন রহ. স্বপ্নে দেখেন যে, এখানে আইয়ুব আল আনসারী রা. এর কবর রয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর এখানে বর্তমান মাজারটি গড়ে তোলা হয়। কবরের পাশেই চমৎকার ডিজাইনে একটি মসজিদ তৈরী করা হয়। আমরা সে মসজিদে জোহরের নামায আদায় করি। ইস্তাম্বুলের সবকটি মসজিদে নারী পুরুষের একই সাথে আলাদা আলাদা জায়গায় নামায পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এরপর সেখান থেকে আমরা চলে যাই, ইস্তাম্বুল বিজয়ের সেই ঐতিহাসিক স্থান যাকে গোল্ডেন হর্ন বলা হয়, কাশেমপাশায় অবস্থিত গোল্ডেন হর্নে আমরা পৌঁছি। সেখানে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করি। তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী খাবার এখানে পরিবেশন করা হয়। এখানে আমাদের সাথে গাইডের কাজ করেন জনাব আদম ভাই। তিনি বুঝিয়ে দেন কীভাবে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতেহ এই কাশেমপাশার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে গোল্ডেন হর্ণে সেই সময়ে জাহাজগুলো সাগরে ভাসিয়েছিলেন। আর এর মাধ্যমে হাজার বছরের বাইজেনটাইন সভ্যতার পতন ঘটে। উত্থান ঘটে ইসলামী শক্তির। আরবীতে যাকে বলা হয় কুসতুনতুনিয়া, সেই জায়গাটির নামকরণ করা হয় ইসলামবোল। ইসলামবোল থেকেই ইস্তাম্বুল। সেখান থেকে আমাদের কাফেলা চলে যায় জাহাজে চড়ে বসফরাস দেখতে। জাহাজে করে বসফরাস ঘুরে দেখার জন্য আমরা সকলেই জাহাজে উঠি। নির্দিষ্ট ভাড়ার বিনিময়ে আমরা ঘুরে দেখি ইস্তাম্বুলের সৌন্দর্যের সমাহার বসফরাসের দুই পাড়। শত শত বছরের স্থাপনাগুলো দেখতে খুবই চমৎকার লাগছিল। এটা যেহেতু সাগরের সাথে সংযুক্ত, তাই এখানে ঢেউ ছিল। আকাশে পাখি উড়ছিল। পর্যটকরা পাখিদের খাবার দিচ্ছিল। জাহাজের সাথে সাথে পাখিগুলোও উড়ে উড়ে আসছিল। যে দৃশ্যটি অসাধারণ। খুবই চমৎকার দৃশ্য এটি। বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা জাহাজে আরোহন করে।
জাহাজ থেকে নেমে একটু ভিন্ন ধরণের প্রোগ্রাম ছিল। আমাদেরকে তুরস্কের ঘরোয়া পরিবেশটা কেমন দেখানোর জন্য কাফেলার সদস্যদের ৪ ভাগে ভাগ করা হলো। প্রতি গ্রুপে ৫ জন করে। আমরা তরুনরা একটি গ্রুপে। বড়রা অন্যগ্রুপে ভাগ হয়ে এক একটি কাফেলা গাড়ীতে করে ৪টি বাসার দিকে চলে যাই। আমরা বেশ অনেকপথ পাড়ি দিয়ে একটি আবাসিক এলাকায় পৌঁছি। তুরস্কের উচুঁ-নীচু রাস্তা পাড়ি দিয়ে রাতের খাবার গ্রহনের জন্য যে বাড়িটিতে পৌঁছলাম, তার মালিক আমাদেরকে পেয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। তার চোখে-মুখে আনন্দটা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়লো, তাতে মনে হলো আমরা যেন তার কত দিনের আপন। অনেক দিন পর দেখা। তিনি তুর্কিভাষায় হাস্যোজ্জ¦ল মুখে কথা বলেই যাচ্ছিলেন। তিনি তুর্কি জাতিয়তাবাদি হওয়ায় নিজে অন্য কোন ভাষা না জানলেও ১০/১২ বছর বয়সি তার ছেলে উমর সে কিছুটা ইংরেজি বুঝে, তার মাধ্যমেই বাবার কথাগুলো আমাদের সাথে শেয়ার করছিল। আমাদেরকে খুব আপন করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাসায় প্রবেশ করে অবাক হলাম। তাদের বাসার ভেতরটা এত নিখুঁতভাবে সাজানো না দেখলে বিশ্বাসই করা যাবে না। আমি অযু করার জন্য গায়ের শীতবস্ত্রটি খুলে সোফার ওপর রেখে বাথরুমে ঢুকলাম, এসে দেখি কাপড়টি নেই। এতটুকু সময়ও তারা সোফায় কাপড়টি পড়ে থাকা পছন্দ করেনি। সাথে সাথে সেটা নির্দিষ্ট ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছে। তারা কতটা শৃংখলাপূর্ণ জীবন যাপন করে এটুকুতেই বুঝা যায়। খুব আপন করে আমাদের তুর্কি খাবার খাওয়ালেন। রুটি, পনির, জয়তুন, সালাদ, সামান্য রাইস, পিঠা ও হালকা মিষ্টান্ন। তুর্কির ঐতিহ্যবাহী স্যুপও ছিল। খাবার শেষে সে কি গল্প! কথা যেন শেষ হতেই চায় না। আর এর ফাঁকে ফাঁকে তুর্কি অভ্যাসমতো চায়ের কাপে ঝড় উঠছিল। কাপ শেষ হয়ে গেলেই আবার ভরে দেওয়া হচ্ছিল। আমরাতো অভ্যস্থ হলাম একবার কাপ শেষ হয়ে গেলেই শেষ, কিন্তু না, তুর্কিরা কিন্তু তা না, তারা খাবার যতটুকুই খাক, খাবার শেষে আড্ডার মধ্যে চায়ের কাপ শেষ হবে না। সারা বিশ্বে তুর্কিরাই চা পানে সেরা। অতঃপর অনেক রাত করে আমরা আমাদের আবাসস্থলে ফিরে আসলাম।
পরদিন সফরের জন্য যাওয়া হলো তুরস্কের ঐতিহ্যের সেই সূতিকাগার যেখানে একসাথে অনেককিছুই রয়েছে। একই জায়গায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তোপকাপি প্যালেস, আয়া সোফিয়া ও সুলতান আহমদ খঅন মস্ক বা যাকে বøু মস্ক হিসেবে ডাকা হয়। তুরস্কের জন্য এই জায়গাটি খুবই মর্যাদার, গুরুত্বপূর্ণ। তোপকাপি প্যালেসেই উসমানী সুলতানগণ বসবাস করতেন। আর আজ সেটাকে যাদুঘরে রুপান্তরিত করা হয়েছে। সেখানে ইসলামের ইতিহাসের অনেক স্মৃতি বিদ্যমান, বিশেষ করে রাসুল সা, এর দাঁড়ি মুবারক, তরবারী, মা ফাতেমার পোশাক, চার খলিফার ব্যবহৃত তরবারী ইত্যাদিসহ অনেক মূল্যবান জিনিস রয়েছে এখানে। এর সাথে এখানে রয়েছে উসমানী খলিফাদের ব্যবহৃত অনেক আসবাবপত্র। তোপকাপি প্যালেসে ঢুকতে ৬০ লিরা দিয়ে টিকেট কাটতে হয়। এখান থেকে সমস্ত ইস্তাম্বুল, বসফরাস ও মারমারা সাগরের দিকে নজর রাখা সম্ভব। এখান থেকে বের হয়ে খ্রীষ্টানদের গর্বের ধন আয়া-সোফিয়ায় আমরা আসরের নামায পড়লাম। আয়া সোফিয়ার মূল অংশটি এখনো যাদুঘর হিসেবেই রয়ে গেছে। এর একটি কর্ণারে নামায পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আয়া সোফিয়ায় পা রেখে ইতিহাসের অনেক পেছনে চলে গেলাম। হাজার হাজার বছর ধরে এই জায়গাটি কত মানুষের আশা আকাঙ্খার স্বপ্ন জাগিয়ে গিয়েছে তার শেষ নেই। খ্রীষ্টানরা মনে করেছিল আয়া সোফিয়ার কোনদিন পতন ঘটতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সেটাকেও সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ এর হাতে পদানত করে প্রমাণ করলেন, পৃথিবীতে অপ্রতিরোধ্য বলতে কিছু নেই। এরপর সামান্য একটু এগিয়েই সুলতান আহমদ মসজিদ। সেখানে মাগরিবের নামায পড়লাম। মসজিদের ভেতরে বাইরে হাজার হাজার পর্যটক। বর্তমানে মসজিদটিতে সংস্কার কাজ চলছে। রাতের মিনার গুলো আলো ঝলমল করছিল।
২৩ এপ্রিল আমরা গেলাম তুরস্কের কোনিয়া প্রদেশে। সেখানে শুয়ে আছেন বিশ্বকবি জালাল উদ্দীন রুমি রহ.। ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় ৭০০ মাইল দূরে অবস্থিত তাঁর মাজার। অভ্যন্তরীণ বিমানে করে সকালে গেলাম, রাতের বিমানে ফিরে আসলাম। রুমি রহ. এর কবরের অনতিদূরে শামসুদ্দিন তাবরেজি রহ. এর কবর। দুই কবরের পাশেই দুটি বিশাল আকৃতির সুলতানি আমলের দুটি মসজিদ। কোনিয়ায় বিমান থেকে নেমে প্রথমেই আমরা গেলাম রেসালায়ে নূরের একটি অফিসে। এত চমৎকার অফিস যা না দেখলে ধারণাও করা যেতো না। আমাদেরকে সকালের নাস্তা সেখানে খাওয়ানো হয়। অতঃপর রুমি রহ. এর মাজার দেখা হয়। বিশাল আকারের এই স্মৃতিস্তম্ভে রয়েছে ইসলামের অনেক ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন হাতে লেখা নকশা। আল্লামা রুমি রহ, এর কবিতার হাতে লেখা অনেক কপি। তাঁর ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র। তারমধ্যে তাঁর পাগড়ি, জামা, জুব্বা, আসবাবপত্র ইত্যাদি রয়েছে। রুমির কবর প্রাঙ্গণে প্রবেশের সাথে সাথে এক ধরণের আধ্যাত্মিক গজলের আওয়াজ শোনা গেল। খুব মৃদু আওয়াজে আল্লামা রুমি রহ, এর কবিতা পাঠ চলে। ফেরার পথে দুপুরে একটি স্থানীয় হোটেলে ঐতিহ্যবাহী তুর্কী খাবার গ্রহন করা হয়। সেখান থেকে পুনরায় রেসালায়ে নূর এর অন্য একটি অফিসে আমাদেরকে চা চক্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অফিসটির বাইরে ফুলবাগানের চতুর্পাশ্ব ঘিরে চেয়ার দিয়ে বসানো হয়। গোলাকার পরিবেশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করা হয়। খোলা মাঠে দস্তরখানে বসে চা-মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। এখানে আসরের নামায পড়েই আমরা বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে যাই। সন্ধ্যা ৮টার দিকে বিমানে আরোহন করি। উল্লেখ্য যে, এখানে বেলা ৮টার পরে সুর্য অস্ত যায়। বাংলাদেশ থেকে দিন ৩ঘন্টার বড়। মাগরিব হয় বেলা ৮.৩০ টার দিকে। কিন্তু ফজর নামায ঠিকই ভোর ৫.১৫তে আদায় করতে হয়। অর্থাৎ এই সময়ে রাত খুব ছোট হয়ে থাকে। শীতের তাপমাত্রা ৬-৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
২৪ এপ্রিল তুরস্কের গ্রান্ড মার্কেটে যাওয়া হয়। বিশেষকরে জমিয়াতুল মুদাররেসীন এর মুহতারাম সেক্রেটারী সাহেব শিক্ষামন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও বিশিষ্ট মেহমানদের জন্য উপঢৌকন কেনেন। এছাড়া যার যার ইচ্ছেমতো ইস্তাম্বুলের ঐতিহ্যবাহী গ্রান্ডমার্কেট থেকে কেনাকাটা করেন। সন্ধ্যায় ইস্তাম্বুল ফাউন্ডেশন ফর সাইন্স এন্ড কালচার এর প্রধান কার্যালয়ে আমাদেরকে রাতের খাবারের দাওয়াত দেওয়া হয়। পাশাপাশি রাতে আমাদের নিয়ে ইস্তাম্বুলের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে বিদায় অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী রহ. যে ক’জন সাথী এখনো জীবিত আছেন তাদের একজন। শায়খের নাম আহমদ ফিরিঞ্জি। সভায় সভাপতিত্ব করেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী রহ. সমগ্র রচনাবলী যিনি আরবীতে রূপান্তরিত করেন এবং উক্ত ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব এহসান কাসেম সালেহী। এছাড়া ইস্তাম্বুলের সাবেক একজন এমপিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভায় মেহমানদের পক্ষে আল্লামা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ ও সাব্বির আহমদ মুমতাজি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন। আলোচনাশেষে আমাদেরকে রাতের খাবারে আমন্ত্রণ জানান।
২৫ এপ্রিল সকাল থেকে বিদায় সুর বেজে উঠে। চোখের পলকেই দিনগুলি পার হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আসলাম, দেখলাম, চোখের পলকেই আবার বিদায়ের সুর বেজে উঠলো। সকাল ১০টায় আমরা আমাদের ক্ষণিকের এই প্রিয় আবাস ত্যাগ করতে হলো। রাতেই কর্তৃপক্ষের কাছে একটি বিষয় জানানো হয়েছিল। সেটা হলো, বর্তমান তুরস্কের সবচেয়ে বড় শায়খ, এরদোয়ান যাদের দুআ নিয়ে চলেন, সেই শায়খ হযরত মাহমুদ আফেন্দী। একজন বয়োবৃদ্ধ আলেমে দ্বীন। বয়সের কারণে যিনি এখন আর ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। বয়সের ভারে ন্যূজ হয়ে পড়েছেন, সেই শায়খের দরবারে ক্ষণিকের সাক্ষাত আমাদের তুরস্ক সফরকে পূর্ণতা দিবে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের পথে আমাদেরকে ড্রাইভার একটি উচুঁ পাহাড়ের ওপর নিয়ে দাঁড় করালেন। শায়খের আবাসস্থল দেখে মুগ্ধ হলাম। শায়খের আবাসের পাশেই চমৎকার একটি মসজিদ, দরসগাহ ও খানকাহ। বলা হয়ে থাকে, মাহমুদ আফেন্দী তুরস্কের সেই শায়খ যিনি তুরস্কে ইসলাম বিদায়ের করুণ দিনগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। কথিত আছে, তিনি একাধারে একটি মসজিদে ২৬ বছর নামায পড়িয়েছেন যেখানে একজন মুসুল্লির দেখাও পাননি। সেখান থেকে আজ তুরস্ক ধীরে ধীরে আবার তার সেই হারানো ঐতিহ্যের দিকে ফিরে আসছে। এখন মসজিদে মুসুল্লি ভরপুর থাকে। শায়খের বাসার ভেতর সুনসান নিরবতা, এখানের বিশেষ পোশাকে সজ্জিত খাদেম, পাগড়ি, জুব্বা ইত্যাদি খুবই আকর্ষণ করছিল। শায়খের দরবারে বিভিন্ন দেশ থেকে মেহমানগণ অপেক্ষা করছেন, আমরাও। অবশেষে হুইল চেয়ারে করে শায়খ আসলেন। শায়খ আসার আগেই খাদেমগণ হুশিয়ার করে দিলেন, কেউ সীট থেকে উঠবেন না, দাঁড়াবেন না, মুসাফাহার চেষ্টা করবেন না, কোন ছবি তুলবেন না। তিনি হুইল চেয়ারে করে আসলেন, তাঁর আগমনে সিরিয়ান এক আলেম কিছু আরবী কাসিদা পাঠ করলেন। আমাদের কয়েকজন শায়খের কাছে নিজেদের পরিচয় দিলেন। তিনি শুধু শুনলেন। মুচকি হাসলেন ও দোয়া করলেন।
এখান থেকে সোজা আমরা বিমানবন্দরের দিকে রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যা ৮টার দিকে তার্কিশ এয়ারলাইন্স এর ৭১২নং ফ্লাইটে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। ২৬ এপ্রিল ভোর ৫.২৫ মিনিটে ঢাকার শাহজালাল রহ. আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। একটি সুন্দর সফরের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে কোটি শুকরিয়া।

লেখক : সম্পাদক
বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন