Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করতে হবে

সৈয়দ ইবনে রহমত | প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

সতর্ক নাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরে মানব জাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এইডসের মতো ভয়ঙ্কর কোনো রোগ, মহামারি বা ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধের কারণে নয়, বরং মানব জাতির বিলুপ্তির কারণ হবে মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক। ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকজনিত সংক্রামকব্যাধি থেকে প্রতিদিন পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষায় একমাত্র ভরসা অ্যান্টিবায়োটিক। অথচ, অপ্রয়োজনীয় এবং যথেচ্ছ অপব্যবহারের কারণে মানবদেহের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে ফেলছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসায়নিক গঠন বদলে দেয়ার মতো শক্তিশালী এনজাইম নির্গত করে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতাকেই নিঃশেষ করে দিচ্ছে। ফলে সামান্য কোনো রোগ সারাতে ওষুধে কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বহনকারী রোগীর দেহে, তিলে তিলে মৃত্যুই তার শেষ পরিণতি। এখানেই শেষ নয়, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বংশ বিস্তার করে এবং তাদের অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্য ব্যাকটেরিয়ার দেহে স্থানান্তর করতেও সক্ষম। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট তথা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া যাকে চিকিৎসরা ‘সুপারবাগ’ বলে থাকেন, এরা রোগীর মলমূত্র, হাঁচি, কাশি এবং স্পর্শের মাধ্যমে অন্যদের দেহে প্রবেশ করে তাদেরও নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। সুপারবাগের এই চেইন আক্রমণ থামিয়ে মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার কোনো প্রযুক্তি বা ওষুধ বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। বিষয়টির ভয়াবহতা নিয়ে গত ৫ জুলাই চট্টগ্রামে একটি বৈজ্ঞানিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: বাস্তবতা, ভয়াবহতা ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে মুখ্য আলোচক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেছেন, মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যৎ অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। আগামীতে এমন অবস্থা দাঁড়াবে যেখানে সেলফ ভর্তি অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে, কিন্তু কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০ লাখ মানুষ অপচিকিৎসক কিংবা অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির পরামর্শে অথবা নিজের ইচ্ছায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকে। এভাবে বছরে সাড়ে ৩৬ কোটি মানুষ বিভিন্ন দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে থাকে। অন্যদিকে বছরে মাত্র ৫ কোটি মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে। এভাবে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হতে থাকলে, ভবিষ্যতে কেউই নিরাপদ থাকবে না। আমাদের দেশে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ওষুধের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ অননুমোদিত। এসব দোকান প্রেসক্রিপশান ছাড়া ওষুধ বিক্রি করে। এদের কারণে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার সমগ্র বিশ্বকে ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলছে।

গত এপ্রিলে বিবিসি বাংলা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগ। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনেও একই পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বিএসএমএমইউর আইসিইউতে ভর্তি হওয়া আনুমানিক ৯০০ রোগীর মধ্যে ৪০০ জনই মারা গেছে। আর মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য এক অশনি সংকেত। তার চেয়েও ভয়াবহ সংবাদ হচ্ছে, সুপারবাগের আক্রমণে মারা যাওয়া রোগীরা তাদের সংস্পর্শে আসা বহু সংখ্যক আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, এমনকি তাদের চিকিৎসাসেবাদানকারীদের শরীরেও একই জীবাণু ছড়িয়ে গেছেন; যা তাদের থেকে আবার অন্যদের শরীরে প্রবেশ করতে থাকবে। আর সুপারবাগ যার শরীরে একবার প্রবেশ করবে মৃত্যুর ক্ষণ গণনা ছাড়া তার জন্য বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। এই অবস্থার জন্য মূলত আমরাই দায়ী। সামান্য জ্বর কিংবা সর্দির মতো ছোটখাট অসুখ হলেই আমরা ফার্মেসিতে গিয়ে কয়েকটা অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট কিনে নিয়ে আসি। দুটো খাওয়ার পর একটু ভালোবোধ করলেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেই। দুটো ট্যাবলেট খাওয়ায় হয়তো শরীরে থাকা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ব্যাকটেরিয়া মারা যায় কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ পূর্ণ না করার কারণে বেঁচে যায় বাকী ২০ থেকে ৩০ ভাগ ব্যাকটেরিয়া। এভাবে বেঁচে যাওয়া ব্যাকটেরিয়া রোগীর গ্রহণ করা অ্যান্টিবায়োটিক চিনে ফেলে এবং নিজের ডিএনএ পরিবর্তন করে চিনে ফেলা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। দেখা যায়, পরের বার একই অ্যান্টিবায়োটিক আর রোগীর শরীরে কাজ করছে না। এখন এই ব্যাকটেরিয়াওয়ালা মানুষটি যদি অন্যদের সামনে বসে তাহলে তার নিঃশ্বাস-হাঁচি-স্পর্শে অন্যদের শরীরেও সেই রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়াটি চলে আসে। কেউ একজন নিজের শরীরে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেওয়ার পর ক্রমান্বয়ে তা কোটি কোটি মানুষের দেহে সঞ্চারিত হয়ে সেই অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে দিচ্ছে। এভাবে একের পর এক নতুন ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবন হচ্ছে আর আমাদের ভুলের কারণেই সেই নতুন আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তথা সুপারবাগ জন্ম নিচ্ছে আমাদের দেহে। চিকিৎসকদের লেখা বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, গনোরিয়াসহ কিছু সাধারণ সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় একসময় পেনিসিলিন অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ ছিল। পেনিসিলিন যখন অকার্যকর হয়ে গেল, তখন বাজারে আসে টেট্রাসাইক্লিন। টেট্রাসাইক্লিন অকার্যকর হতেও বেশি সময় লাগেনি। তারপর আসে ক্লোরোকুইনোলন গ্রুপের সিপ্রোফ্লক্সাসিন, নালিডিক্সিক অ্যাসিড, ল্যাভোফ্লক্সাসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক, সেটাও এখন অকার্যকর। বর্তমানে কিছু কিছু জীবাণুকে ধ্বংস করতে প্রয়োগ করা হচ্ছে সেফট্রিয়াক্সন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন কম্বিনেশন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে। তাও কত দিন কার্যকর থাকবে বলা মুশকিল।

অন্যদিকে যে হারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ঘটছে, সে হারে প্রতিনিয়ত উন্নত মানের অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবন হচ্ছে না। বাজারে থাকা সবচেয়ে ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনেম পেটেন্টড হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। এরপর থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে বন্ধ্যা সময় পার হচ্ছে, কিন্তু অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যাকটেরিয়া ইতোমধ্যে মেরোপেনেম প্রতিরোধী ক্ষমতাও অর্জন করে ফেলেছে। ফলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মতো আর কোনো অস্ত্রই চিকিৎসকদের হাতে নেই। এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই ইউরোপ, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেকোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে চিকিৎসক স্বল্পতা এবং সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আইন মেনে চলার বিষয়ে অনিহাসহ নানা কারণেই এই নিয়ম কার্যকর করা যাচ্ছে না। তাই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাব এ অঞ্চলেই বেশি। আর বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের ক্ষেত্রে এই ভয়ের মাত্রাটা যে কোন পর্যায়ের তা ধারণা করাও সম্ভব না। কারণ এদেশে কে কোন কোন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বহন করছে তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরিও নেই। সীমিত সংখ্যক হাসপাতাল বা ল্যাবে ব্লাড কালচার করে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করার ব্যবস্থা আছে। সেসব হাসপাতাল বা ল্যাবে প্রতিদিন যাদের ব্লাড কালচার করা হচ্ছে তাদের দেহে কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যাচ্ছেই। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যাচ্ছে শতভাগ, ফলে তাদের আর বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। এই অবস্থায় রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া আর একটি অ্যান্টিবায়োটিকও যাতে ক্রয়বিক্রয় করা না যায় সেটি এখনই নিশ্চিত করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ মানুষ বসবাস করেন গ্রামাঞ্চলে, যেখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই, হাসপাতাল নেই, ব্লাড কালচার করে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করার সুযোগ নেই; শহরগুলোতে সীমিত ব্যবস্থা থাকলেও সব মানুষের পক্ষে সে সুযোগ গ্রহণ করার সামর্থ্য নেই, যাদের সামর্থ্য আছে তাদের অনেকে আবার সচেতনতার অভাবে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজেরাই ফার্মেসি থেকে যেমন খুশি অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাচ্ছে। আবার অনেক সময় ডাক্তাররাও ভুল করে অ্যান্টিবায়োটিক সাজেস্ট করে থাকেন, এটা যেমন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হয়ে থাকে, তেমনি উন্নত দেশের ডাক্তাররাও একই ভুল করে যাচ্ছেন। ফলে উন্নত দেশগুলোও অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহার ও অযৌক্তিক ব্যবহারে খুব একটা পিছিয়ে নেই। ২০১৩ সালে জার্নাল অব দ্য অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল কেমোথেরাপিতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর শ্বাসনালির সংক্রমণে চার কোটি মানুষকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। চার কোটির মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে অপ্রয়োজনেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহীতার বেশির ভাগই হয় মূলত ভাইরাস সংক্রমণের শিকার। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না। এভাবে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্সের অন্যতম কারণ। অনেক সময় নিম্নমানের এবং মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণেও রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হচ্ছে।

সরাসরি ওষুধ গ্রহণের কারণেই যে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করছে তা কিন্তু না। আমাদের শরীরে এখন অপ্রয়োজনী অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করছে নানা মাধ্যমে। আমাদের খাদ্য চাহিদার অন্যতম উপাদান হচ্ছে প্রাণিজ আমিষ। আর প্রাণিজ আমিষের উৎস মাছ, গরুর গোশত, খাসির গোশত, মুরগীর গোশত, ডিম ইত্যাদি। খামারগুলোতে যাতে মোড়ক না লাগে তার জন্য প্রতিদিন সকালে-বিকালে পানিতে মিশিয়ে মুরগীকে খাওয়ানো হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। সুস্থ অবস্থায় যখন মুরগীগুলো প্রতিদিন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে, তখন তাদের দেহে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো সে অ্যান্টিবায়োটিককে সনাক্ত করে নিজের জেনেটিক কোড বদল করে সেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে নিচ্ছে। এসব রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া মুরগীর মলমূত্রের মাধ্যমে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। মুরগীর ডিম এবং গোশতের মাধ্যমে তারা সরাসরি আমাদের শরীরেও প্রবেশ করছে। একইভাবে মাছের পুকুরে ব্যবহার হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক, গরু-ছাগলের শরীরেও পুষ করা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। ফলে মাছ, গোশত সব কিছুর মাধ্যমেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে অ্যান্টিবায়েটিক। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুধের মধ্যেও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগলের খামারে, মাছের পুকুরে ব্যবহার হওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের একটা অংশ বায়ু, মাটি এবং পানির মাধ্যমে ফসলের সাথেও মিশে যাচ্ছে। এভাবে ফলমূল, খাদ্য শস্য থেকে শুরু করে প্রাণিজ আমিষ- সবকিছুতেই অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি আমাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকার মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। পরিস্থিতি আজ এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠছে যে, তার থেকে পরিত্রাণের যেন আর কোনো উপায় নেই। প্রথম অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার ফ্লেমিং জীবাণুর বিরুদ্ধে পেনিসিলিনের নাটকীয় কার্যকারিতার পাশাপাশি মানবসভ্যতাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে ১৯২৭ সালে বলেছিলেন, সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন অপব্যবহারের কারণে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারাবে, ফলে এক অসম যুদ্ধে মানুষ পরাজিত হবে এবং মৃত্যুবরণ করবে। মানব জাতির বিলুপ্তির সেই সন্ধিক্ষণটি যেন দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অথচ, আমরা রয়েছি নির্বিকার। এমন একটি ভয়ঙ্কর পরিণতির মুখোমুখি হয়েও আমরা সচেতন হচ্ছি না, সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে মাঝে মাঝেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রাষ্ট্রগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেও কার্যকর তেমন কিছুই হচ্ছে না। উন্নত দেশগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের নেগেটিভ দিকগুলো নিয়ে মোটামুটি সচেতনতা থাকলেও যথাযথ প্রচার না থাকায় দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ এ ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে। গত ৫ জুলাইয়ের সেমিনারটির কথাই ধরা যাক। বিষয়টির গুরুত্ব অনুযায়ী এটি সেদিনের সকল অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টেলিভিশন, রেডিওতে হাইলাইট হওয়ার কথা। পরের দিন সকল প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হওয়ার মতো দাবি রাখে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দু’ একটি গণমাধ্যম ছাড়া অন্য কোথাও এ সংবাদটি ছাপাই হয়নি। আসলে এর জন্য এককভাবে গণমাধ্যমকেও দায়ী করে লাভ নেই, কারণ তাদের সামনে এর গুরুত্বকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেভাবে তুলে ধরেনি। ফলে তারাও এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আরো ভয়ের কথা হচ্ছে, বিশ্বের উন্নত এবং শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরির গবেষণায়। পৃথিবীকে বহু সংখ্যকবার ধ্বংস করার মতো অস্ত্রের মজুদ গড়ার পরও তারা পরস্পরের সাথে পাল্লা দিয়ে বানাচ্ছে নিত্য নতুন প্রযুক্তি ও অস্ত্র। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে গতিতে সুপারবাগ ধেয়ে আসছে মানব জাতিকে ধ্বংস করার জন্য, সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন এসব অস্ত্র ব্যবহার করার মতো মানুষ পৃথিবীতে আর অবশিষ্ট থাকবে না। তারপরেও রাষ্ট্রগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তথা সুপারবাগ দমনে নতুন উপায় আবিষ্কারের পেছনে সেভাবে অর্থ ব্যয় করতে এগিয়ে আসছে না। অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলোও আগের মতো নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পেছনে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তা অকার্যকর হয়ে যায়, ফলে তাদের বিপুল বিনিয়োগ উঠে না আসার আশঙ্কা থাকে। তাই তারা নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পেছনে অর্থ ব্যয় করার পরিবর্তে বরং পুরনো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আরো কীভাবে বাড়ানো যায় সেই দিকেই বেশি মনোযোগী। ওষুধ কোম্পানিগুলোর এই নীতির কারণেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ঘটছে। কিন্তু এই অবস্থা চলতে দিয়ে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনার মতো অজ্ঞতা পরিহার করতেই হবে। অ্যান্টিবায়েটিকের অপব্যবহার রোধে সচেতন হতে হবে সবাইকে। এটা যেমন প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবাদানকারী থেকে শুরু করে ওষুধ বিক্রেতাসহ প্রতিটি মানুষের কাছে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রকে অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন, ক্রয়বিক্রয় এবং গ্রহণের ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে কার্যকর করে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করতে হবে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো যাতে অন্যান্য খাতের বরাদ্দ কমিয়ে হলেও সুপারবাগ দমনে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহী হয় সে ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কুফল সম্পর্কে অধ্যায় যুক্ত করতে হবে। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেবেল এঁটে দিয়ে যেভাবে এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সচেতন করা হয়ে থাকে, তেমনি প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেটের গায়ে এর অপব্যবহারের কুফল সংযুক্ত করে দিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কুফল থেকে মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য আরো যেসব সম্ভাব্য পদক্ষেপ নেয়া যায় তার সব কিছুই যত দ্রুত সম্ভব নিতে হবে।



 

Show all comments
  • Manik Mia ১৪ জুলাই, ২০১৯, ৪:২৭ পিএম says : 0
    ধন্যবাদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন