Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইন্তেকাল

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান, জাতিয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার ভুগছিলেন। মত্যুকালে তার বয়েস হয়েছিল ৮৯ বছর। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী রংপুরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোর তারুণ্যে বেড়ে উঠেন পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে। সেখান থেকেই এসএসসি পাস করেন এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। গত ২৭ জুন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৪ঠা জুলাই আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেয়ার ১০ দিনের মাথায় ১৪ জুলাই সকাল ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। সাড়ে তিন দশকের বেশী নময় ধরে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দেশের অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নানা বিতর্ক, সমালোচনা সত্তে¡ও তিনি একদিকে বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্রময় রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারি, অন্যদিকে বিপরীতমুখী বিতর্ক ও সমালোচনার পরও শেষ পর্যন্ত তিনি একজন সফল রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছেন। ১৯৮১সালের ৩০ মে কতিপয় বিপথগামি সেনা অফিসারের হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর এক বছরের মাথায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। এরপর প্রথমে সামরিক শাসক হিসেবে অত:পর জাতীয় পার্টি গঠণ ও স্বনিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি ৯ বছর দেশ পরিচালনা করেছেন। আশির দশক জুড়ে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের চুড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতনের আগ পর্যন্ত তিনি একজন সফল রাষ্ট্রপতি হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেছেন। অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উপজেলা পরিষদ গঠনের মত স্থানীয় প্রশাসনিক সংস্কার তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হিসেবে স্বীকৃত।

এরশাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বহুমাত্রিক চরিত্রের অবসান ঘটল। রক্তপাতহীন সামরিক ক্যু’র মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন জারির পর ব্যাপক গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ ৬ বছর কারাবরণ শেষে রাজনীতিতে সফলভাবে পুর্নবাসিত হওয়া এরশাদের অন্যতম ক্যারিশমা। বিশ্ব রাজনীতিতেও এমন উদাহরণ বিরল। নয় বছরের শাসনে জাতির সামনে এরশাদের একটি মিশ্র ইমেজ গড়ে উঠলেও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এরশাদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সময় এবং পরবর্তি প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে এরশাদ দেশের মানুষের প্রত্যাশা ও চাহিদাকে মূল্য দিতে চেষ্টা করেছেন। জাতীয় পার্টির একই সঙ্গে সরকারের অংশীদার হওয়া বিরোধিদলে থাকার পত হঠকারি সিদ্ধান্ত এবং দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের প্রশ্নে এরশাদকে দ্বিধাগ্রস্ত ও রহস্যময় ভ‚মিকায় দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত সংসদীয় রাজনীতির শুণ্যতা পুরণে এরশাদ এক প্রকার অনুঘটকের ভ‚মিকা পালন করে গেছেন।

ব্যক্তির মৃত্যু হলেও একজন সফল রাজনীতিকের কখনো মৃত্যু হয়না। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন, রাজনৈতিক ভ‚মিকা ও সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে মতানৈক্য থাকবেই। কোনো রাজনৈতিক চরিত্রই সমালোচনা ও মতভিন্নতার উর্দ্ধে থাকতে পারে না। দেশের ইতিহাসে এরশাদের অবস্থান যাই হোক, বিশেষ সময়ে জাতির প্রয়োজনে এরশাদের ভ‚মিকাকে মুছে ফেলা অসম্ভব। এরশাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় এসেও তার উপজেলা পরিষদ বা অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি কেউ অগ্রাহ্য করতে পারেনি। গত সাড়ে তিন দশক ধরে এরশাদের জাতীয় পার্টি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকা এরশাদের এসব র্কীতির স্বীকৃতি হিসেবেই গণ্য হতে পারে। রাজনৈতিক ভাগ্য বিপর্যয় এবং চরম সময়কে ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করা এরশাদের রাজনৈতিক অর্জনে অন্যতম শিক্ষা। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশত্যাগ না করে আদালতের রায় মেনে নিয়ে কারাবরণ করা এবং কারাগারে থেকে একাধিক বার রংপুরের ৫টি আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এরশাদ রাজনৈতিক কৃতিত্ব ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে তিনি বেঁচে থাকতেই জাতীয় পার্টিকে অটুট রাখতে পারেননি। একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির ভাগ্যে কি আছে তা নিয়ে আগে থেকেই ব্যাপক জল্পনা রয়েছে। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থেই জাতীয় পার্টির ঐক্য ও শৃঙ্খলা অটুট থাকা প্রয়োজন। এরশাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি যেন আরেক দফা ভাঙ্গন ও অনৈক্যের নিগড়ে পতিত না হয় জাতীয় পার্টির বর্তমান নেতৃত্বকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা হুসেই মুহম্মদ এরশাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন