শীর্ষে থেকেই চট্টগ্রামে ইমরুল-পেরেরা

দর্শকহীনতা, স্যান্টোকির অবিশ্বাস্য নো বল, প্রেসবক্সে খাবারে বিষক্রিয়ায় সাংবাদিক অসুস্থ- এই নিয়েই একদিন আগেই শেষ
অবিশ্বাস্য, শ্বাসরুদ্ধকর, নাটকীয় কিংবা রোমাঞ্চকর- কোনো বিশেষণেই কী মানানসই গতকালের বিশ্বকাপ ফাইনালের জন্য? লর্ডসের হোম অব ক্রিকেটে যাদের নজর ছিল তারা নিশ্চয় এক শব্দে বলবেন, ‘না’। শুধু ফাইনাল কেন, এমন ম্যাচই যে আগে কখনো দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব!
ফাইনাল মানেই যেন একপেশে লড়াই। গতকালের আগ পর্যন্ত এমনটিই ছিল ফাইনালের চিরায়ত দৃশ্য। এতদিনের সেই আক্ষেপই যেন কাল কড়াই গণ্ডাই মিটিয়ে দিল ক্রিকেটের তীর্থস্থান লর্ডস। অবিশ্বাসের মোড়কে জমানো শ্বাসরুদ্ধকর আর নাটকীয় সেই ম্যাচের রং বদলেছে ক্ষণে ক্ষণে। বলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেন্ডুলামের সুতোয় দুলেছে ম্যাচের ভাগ্য। ক্রিকেট যে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা এর এক আদর্শ বিজ্ঞাপণ যেন!
নির্ধারিত সময়ে নিউজিল্যান্ডের ৮ উইকেটে করা ২৪১ রানের জবাবে ইংল্যান্ড অল আউট হয়েছে ঠিক ঐ ২৪১ রানেই। সুপার ওভার গড়ানো ম্যাচেও ভাগ্য নির্ধারণ করা যায়নি। ইংল্যান্ডের ১৫ রান তাড়া করতে গিয়ে নিউজিল্যান্ডও করেছে ঠিক ১৫। শেষ পর্যন্ত শিরোপা নির্ধারণ হয়েছে ম্যাচে চার-ছক্কার হিসাবে। যেখানে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড।
চতুর্থ বারের প্রচেষ্টায় এমনই এক ঐতিহাসিক ম্যাচ উপহার দিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলেছে ইংলিশরা। টানা দ্বিতীয়বার ফাইনাল থেকে নিউজিল্যান্ডকে ফিরতে হলো খালি হাতে। কিন্তু আসলেই কী খালি হাতে ফিরেছে কেন উইলিয়ামসনের দল? ইংল্যান্ড জিতেছে ঠিকই, নিউজিল্যান্ড কি হেরেছে? এমন প্রশ্ন রেখেই শেষ হলো আইসিসি বিশ্বকাপের ১২তম আসর।
নিউজিল্যান্ড সমর্থকদের সবচেয়ে বেশি পোড়াবে ৪৯তম ওভারে ট্রেন্ট বোল্টের সেই ক্যাচ, কিংবা শেষ ওভারের সেই ওভার থ্রো বাউন্ডারি। বাউন্ডারি থেকে বেন স্টোকসকে তালুবন্দি করেও ভারসম্য রাখতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে বাউন্ডারি লাইনে পা পড়ে যায় বোল্টের। বুঝতে পেরে যতক্ষণে বল গাপটিলের হাতে তুলে দেন তখন দেরি হয়ে গেছে। আউটের বদলে ছক্কা! শেষ ওভারে ১৫ রানের হিসাব মেলাতে গিয়ে প্রথম দুই বলে সিঙ্গেল নেননি স্টোকস। ৪ বলে ১৫ রানের সামনে নির্ভার দেখাচ্ছিল উইলিয়ামসনদের। পরের বলে ছক্কা হাঁকানোর পরও ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৩ বলে ৯ রান। এমন সময় ওভার থ্রো থেকে আসে সেই বাউন্ডারি। গ্যালারিতে নিউজিল্যান্ড সমর্থকরা তখন যেন নিশ্চল। পঞ্চম বলে ডাবল নিতে গিয়ে রান আউট আদিল রশিদ। শেষ বলে দৌড়ে দুই রানের হিসাব মেলাতে গিয়ে রান আউট কার্ড উড। ম্যাচ টাই!
এর আগে ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারে আঘাত হেনে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় নিউজিল্যান্ড। রয় যখন জেমস নিশামের দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত হয়ে সাজঘরে ফেরেন দলের স্কোর তখন ২৪ ওভারে ৮৬। জনি বেয়ারস্টো (৩৬), জেসন রয় (১৭), জো রুট (৭), মরগানরা (৯) আগের ম্যাচগুলোয় মিডিল অর্ডারদের তেমন একটা পরীক্ষায় ফেলেননি। সেই পরীক্ষায় দারুণভাবে উতরে গেলেন স্টোকস ও বাটলার। তাদের ১১০ রানের জুটিতেই ম্যাচে ফেরে ইংল্যান্ড। চাপের মুখে ৬০ বলে ৫৯ করে বাটলার যখন ফেরেন জয়ের জন্য তখন ইংলিশদের দরকার ৩১ বলে ৪৫ রান। এরপর থেকে ম্যাচের ভাগ্য দুলেছে পেন্ডুলামের সুতোয়। ৯৮ বলে ৫ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ৮৪ রান করা স্টোকসই হয়েছেন ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়।
এর আগে দিনের শুরুতেই ইংল্যান্ড অধিনায়ককে মনস্তাত্তি¡ক আঘাত হানেন নিউজিল্যান্ড দলপতি। লন্ডনে সকালে হয়েছে এক পলশা বৃষ্টি। এরপর লর্ডসের আকাশে মেঘের ফাঁকে উঁকি দিয়েছে রোদ। প্রথমে বল করা দলের পক্ষেই ছিল কন্ডিশন। কিন্তু উইলিয়ামসন বেছে নিলেন ব্যাট। আগের তিন ফাইনালে কোন বারই যে রান তাড়া করতে গিয়ে জিততে পারেনি ইংল্যান্ড! কিংবা পরে ব্যাটিং করার চাপটা হয়ত নিতে চাননি উইলিয়ামসন। তাছাড়া এবারের বিশ্বকাপ তো বটেই লর্ডসের অতীত ফাইনালও ছিল প্রথমে ব্যাট করা দলের পক্ষে। দিন শেষে এসব হিসাব পাল্টে দিয়ে ইহিতাস গড়েছে ইয়ন মরগানের দল।
প্রথমের স্বপ্নে বিভোর ইংল্যান্ডের শুরুটা এদিনও ছিল উড়ন্ত। নতুন বলে ক্রিস ওকস আর জোফরা আর্চারের মত টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা বোলিং জুটিকে সামলানো ছিল গাপটিল ও হেনরি নিকোলসের বড় চ্যালেঞ্জ। গতির সঙ্গে লাইন লেন্থ ও সুইংয় আদায় করে কিউইদের শুরু থেকেই চাপে রাখেন ওকস ও আর্চার। ভালো কিছুর আশা দিয়ে এদিনও ব্যর্থ গাপটিল (১৯)। শুরুর ১০ ওভারে ৩৩ রানে ১ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে বø্যাক ক্যাপ বাহিনী। এমন দশায় আবারও দলের হাল ধরতে হয় টুর্নামেন্ট জুড়ে দলকে পথ দেখানো উইলিয়ামসনকে।
নিকোলসের সঙ্গে দলপতি গড়েন ইনিংস সর্বোচ্চ ৭৪ রানের জুটি। ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে লিয়াম প্লাঙ্কেটের শিকার হন উইলিয়ামসন (৩০)। ১৫ রানের ব্যবধানে নিকোলসও (৫৫) বোল্ড হন প্লাঙ্কেটের বলে। মন্থর উইকেটে রানের জন্য লড়াই করতে হয়েছে বাকি ব্যাটসম্যানদেরও। ইনিংসে ফিফটি মাত্র নিকোলসের। ৩১ বলে রস টেইলরের ১৫ রানের লড়াকু ইনিংস শেষ হয় আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে। উডের বল লেগ স্টাম্পের অনেক উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ইংলিশদের জোরালো আবেদনে আঙ্গুল তুলে দেন দক্ষিণ আফ্রিকান আম্পায়ার মারাইস এরাসমাস। এরপর জেমি নিশাম ও কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে নিয়ে দুটি ত্রিশোর্ধো জুটিতে নেতৃত্ব দেন টম লাথাম। মিড অনে নিশামের ক্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ ক্যাচের রেকর্ডটা বাড়িয়ে নেন জো রুট (১৩)। আগের সর্বোচ্চ ছিল রিকি পন্টিংয়ের (১১টি, ২০০৩)।
লম্বা সময় ক্রিজে থেকেও রানের পালে হাওয়া লাগাতে পারেননি ডি গ্র্যান্ডহোম (২৮ বলে ১৬)। ৫৬ বলে ৪৭ রানের পথে ইনিংসের একমাত্র ছক্কা হাঁকান লাথাম। ৫ উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ৫ ওভারে ৩০ রান যোগ করতে পারে নিউজিল্যান্ড। তিনটি করে উইকেট নেন ওকস ও প্লাঙ্কেট, একটি করে আর্চার ও উড।
তাদের মত দারুণ বোলিং করেন ফার্গসন, নিশাম, ডি গ্র্যান্ডহোমরাও। কিন্তু ভাগ্য যে এদিন তাদের নিয়ে নির্মম উপহাস করল। আর তাতেই রচিত হলো মহাকাব্যিক এক ফাইনালের।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।