Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নগরবাসী : অব্যবস্থাপনায় ময়লার ভাগাড়

প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সায়ীদ আবদুল মালিক : রাজধানীজুড়ে ময়লা-আবর্জনা। যত্রতত্র ময়লায় ভাগাড়। জনসচেতনতার অভাব আর দায়িত্ববানদের অবহেলা ও কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনায় গোটা রাজধানীই যেন ময়লা-আবর্জনার বৃহৎ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাট, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকা- সর্বত্রই ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। নর্দমার নোংরা ময়লা-পানি ঢুকে পড়ছে বাড়িঘরেও। চারদিকের উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকছে। প্রতিটি বাড়ির ফাঁকে, খোলা জায়গায়, গলিপথে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। যে কারণে নগরবাসীকে এখন চলাফেরা করতে হয় নাক টিপে। নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনার উৎকট গন্ধ নাগরিক জীবনকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেললেও এর বিন্দুমাত্রও টের পান না নগর কর্তারা।
রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকার দু’সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, ঘনবসতির এ শহরে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছে দু’সিটি কর্পোরেশনই। অভিযোগের পর অভিযোগ, বর্জ্য অপসারণে কর্পোরেশনের উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য দেখেছেন না সেবাগ্রহী নগরবাসী।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সিটি কর্পোরেশন যে বর্জ্য সংগ্রহ করে তার পুরোটাই বুলডোজার, টায়ারডোজার ও পেলোডার ব্যবহার করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সংগৃহীত বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও জৈবসার উৎপাদন করা সম্ভব। আহরিত বর্জ্য যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিণত হতে পারে মূল্যবান সম্পদে। কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ডাম্পিং ব্যবস্থার অভাবে বর্জ্য আজ বোঝায় পরিণত।
গৃহস্থালী বর্জ্যর পাশাপাশি রয়েছে হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্যও। রাজধানীর গৃহস্থালী বর্জ্য থেকে হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য আলাদা করা হয় না। এগুলো ফেলা হয় ডাস্টবিন, রাস্তাঘাটসহ যেখানে সেখানে।
সম্প্রতি ইকোনোমিষ্ট ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট চলতি বছরের গ্লোবাল লাইভঅ্যাবল ইনডেক্স প্রকাশ করেছে। তাদের হিসেব মতে বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে বসবাসের জন্য অযোগ্য শহরের তুলনায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা অবস্থানে রয়েছে ১৩৯তম।
নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার স্থান না থাকায় বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি থেকে ময়লাবাহী ভ্যানগাড়ি চালকরা ময়লা সংগ্রহ করে তা প্রধান সড়কের পাশে, কিছু আবাসিক এলাকায় বাড়িঘরের পাশে, বাসস্ট্যান্ডে, বাজারে, হাসপাতালে এমনকি স্কুলের সামনের খালি জায়গাতেও ফেলা হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘদিনের এই সমস্য থেকে ঢাকাবাসীকে রক্ষা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে দুই সিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এর কারণ হিসেবে ময়লা ফেলার জায়গা জটিলতা ও জনবল স্বল্পতাকে দায়ী করা হয়।
দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, বর্জ্য অপসারণে পর্যাপ্ত জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে
না থাকায় সঠিকভাবে শহরের বর্জ্য অপসারণ করা যাচ্ছে না। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন বিপন কুমার সাহা বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অপ্রতুল জনবল। এত স্বল্প জনবল দিয়ে নিয়মিত বিপুল ময়লা পরিষ্কার করা অসম্ভব। রাজধানীর কুড়িল-বিশ্বরোড ফ্লাইওভার থেকে নেমে ৩০০ ফুট সড়কের শুরুতেই একটি ময়লার ভাগাড় গড়ে তোলা হয়েছে। এতে এই এলাকার সামনে দিয়ে চলাচলকারী পথচারীদের কটু দুর্গন্ধ সহ্য করতে হয়। অবস্থা এতই খারাপ যে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী ট্রাকগুলো প্রতিদিন যখন ময়লা বহন করে নিয়ে যায় তখন বেশ কয়েক ঘণ্টা সে এলাকার বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। এ ছাড়া ট্রাকগুলো থেকে ময়লা বহনের সময় প্রতিদিনই রাস্তায় ময়লা পড়া স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিন দখা যায়, নগরীর অভিজাত এলাকা উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ বংশাল, লালবাগ, ইসলামপুর, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ী, ধলপুর, মুগদাপাড়া, মানিকনগর, আহম্মদবাগ, কলাবাগান, রামপুরা, মালিবাগ, মৌচাক, সিদ্ধেশ্বরী, খিলগাঁও, বাসাবো, গ্রিনরোড, কাঁঠালবাগান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, ধোলাইখাল, বাড্ডা ও নতুনবাজারে রাস্তার উপরই যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হচ্ছে। এতে আশপাশে তীব্র দুর্গন্ধে পথচারীদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতাল ও মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের প্রবেশমুখেই সিটি কর্পোরেশনের ময়লা স্থানান্তর কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। রোগী ও পথচারীদের দুর্ভোগের কারণে বহুদিন ধরেই এই হাসপাতালটির সামনে থেকে ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে নিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতা চাইলেও ময়লা স্থানান্তর কেন্দ্রটি সরিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগ হচ্ছে না।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল ৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, হাসপাতালের সামনে ময়লা রাখার বিষয়টি অত্যন্ত বিব্রতকর। কিন্তু স্থান না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়ে কর্পোরেশন এখানে ময়লা রাখছে। তিনি বলেন, আশা করছি আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা হাসপাতাল ও বাজারের সামনে থেকে সব ময়লা স্থানান্তর কেন্দ্রগুলো সরিয়ে নিতে পারব।
পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যে, ঢাকা শহরের গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনাসহ অন্যান্য বর্জ্যরে ৬০ শতাংশ সরানোর দায়িত্ব পালন করে সিটি কর্পোরেশন। বাকি ৪০% প্রতিষ্ঠানটি জনবল স্বল্পতাসহ নানাবিধ কারণে সরাতে অক্ষম। আর এ ময়লাগুলো পরবর্তীতে সেই নির্দিষ্ট এলাকার পার্শ্ববর্তী ড্রেন ও নালা-নর্দমায় পড়ে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। পরিবেশ সংগঠনগুলোর আরও অভিযোগ এই যে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মেনে চলছে না। জরিপে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ বর্জ্যই রাস্তার ওপর খোলা ডাস্টবিন, নর্দমা বা আশপাশের ডোবা-নদীতে ফেলা হচ্ছে। আর চিকিৎসা বর্জ্যগুলোর মধ্যে আছে রোগীর ব্যবহৃত সুই, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ওষুধের ব্যবহৃত শিশি, ব্যবহৃত স্যালাইনের প্যাকেট, টিউমার, রক্তের ব্যাগ, রাসায়নিক দ্রব্যসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাজাত ময়লা-আবর্জনা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ফলে পুরো শহরই ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, গৃহস্থালি বর্জ্যরে পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতাল বর্জ্যও একই সঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এগুলো সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে সংক্রামক ও ক্ষতিকর বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ছে হেপাটাইটিস ‘বি’, হেপাটাইটিস ‘সি’, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়ার মতো রোগ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নগরবাসী : অব্যবস্থাপনায় ময়লার ভাগাড়
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ