Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রোযার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান

মহান স্রষ্টা বিশ্ব সৃষ্টির পর এক সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি অনুযায়ী তা যথাযথভাবে পরিচালনা, সংরক্ষণ, প্রতিপালন ও নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। এ কারণে সমগ্র বিশ্বে কোথাও কোন অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলা নেই। সবকিছু সুষ্ঠু-সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ব-জগতের কোন কিছুই স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। অনুরূপভাবে, মানুষ সৃষ্টির পরও মহান স্রষ্টা মানুষকে দুনিয়ায় সঠিকভাবে চলার জন্য একটি নিয়ম বা বিধান নাযিল করেছেন। এ বিধানের নাম ইসলাম। ইসলাম প্রচলিত অর্থে কোন ধর্ম নয়, এটা এক সামগ্রিক জীবন-ব্যবস্থা। এ জীবন-ব্যবস্থা শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য মহান স্রষ্টা যুগে যুগে দেশে দেশে অসংখ্য নবী-রাসূলের মাধ্যমে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর এ বিধান পরিপূর্ণ করেছেন এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য কিয়ামত পর্যন্ত তা একমাত্র অনুসরণীয় বিধান হিসাবে মনোনীত করেছেন।
ইসলামের মূল শিক্ষা তৌহিদ বা একত্ববাদ। যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সবকিছু সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য বিধান দিয়েছেন। এ বিধান অনুযায়ী চললে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়, সৌরজগত বা বিশ্বজগতের যে কোন কিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা তা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি। মানুষের জীবনকে সুন্দর ও কল্যাণময় করার জন্য স্রষ্টা যে বিধান দিয়েছেন, তা অনুসরণ করলে মানবসমাজেও শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপিত হতে পারে এবং জীবন কল্যাণময় হয়ে উঠতে পারে। আল্লাহর বিধান সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে আসমানী কিতাবে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নবী-রাসূলের মাধ্যমে কিতাব নাযিল হয়েছে। আখিরী বা সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স.)-এর উপর সর্বশেষ নাযিলকৃত গ্রন্থ আল-কোরআন। আল-কোরআনে বর্ণিত মহান স্রষ্টার নির্দেশনা পালন ও আখিরী নবীর জীবনাদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই মানবজাতি প্রকৃত শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি পেতে পারে।
আল্লাহর বিধানের পাঁচটি মূল স্তম্ভ। ঈমান, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত। তবে এখানে সবগুলো স্তম্ভ সম্পর্কে নয়, শুধুমাত্র রোযা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব। আরবিতে ‘সওম’ বা ‘রোযা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন : “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)।
এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, মানবজাতির শুরু থেকে প্রত্যেক জাতির উপর রোযা রাখার বিধান ছিল। আজো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি প্রাচীন ও বড় বড় ধর্মে উপবাস করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রিস্টান এরা সকলেই বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাদের স্বস্ব ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী উপবাস ব্রত পালন করে থাকে। ইহুদীদের উপবাস হলো প্রায়শ্চিত্ত করার উদ্দেশ্যে। ইহুদীগণ নিজেদেরকে মুসা (আ.)-এর অনুসারী হিসাবে দাবি করে। মুসা (আ.) সিনাই পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করেছিলেন আল্লাহর সাথে দীদার বা সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে। সিনাই পর্বত বর্তমান মিশরে অবস্থিত। মুসা (আ.)-এর জন্ম মিশরে। সিনাই পর্বতের চূড়ায় আরোহণের পর আল্লাহর নির্দেশে তিনি সেখানে একাদিক্রমে চল্লিশ দিন রোযা রাখেন। আল্লাহ সুবহানুতায়ালা পরম পবিত্র ও মহান। তাই তাঁর দীদার লাভের জন্য মুসা (আ.) দীর্ঘ চল্লিশ দিন রোযা রেখে দেহ, মন ও আত্মার পবিত্রতা সাধন করেন। এর দ্বারা বুঝা যায়, রোযা দেহ-মনের পবিত্রতা সাধনের উপযুক্ত মাধ্যম।
এক হাদীসে আছে, রোযাদারদেরকে পরকালে মহান রাব্বুল আলামীন যে সমস্ত নেয়ামত দান করবেন তার মধ্যে একটি হলো আল্লাহর দীদার। মুসা (আ.) দুনিয়ায় আল্লাহর দীদার লাভের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। আল্লাহ্ তাঁর নবীর বাসনা পূরণের জন্য তাঁকে সিনাই পর্বতে আরোহণ করার নির্দেশ দেন। সেখানে মুসা (আ.) একাদিক্রমে চল্লিশ দিন পর্যন্ত রোযা রেখে দেহ-মনের পবিত্রতা সাধন ও সংযম ধারণের শক্তি অর্জন করে আল্লাহর দীদার লাভের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। এরপর মুসা (আ.) আল্লাহর নূরের তাজাল্লী দর্শন করেন। সিনাই পর্বত থেকে তিনি ফিরে এসে দেখেন, তাঁর অনুসারীগণ তৌহিদের শিক্ষা ভুলে মূর্তিপুজা শুরু করে দিয়েছে। মুসা (আ.) তাঁর অনুসারীদের বিপথগামী হওয়া দেখে ক্ষুব্ধ হন। তিনি তাদের অনেক ভর্ৎসনা করেন এবং তওবা করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেন। তাঁর অনুসারীরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত চিত্তে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর মুসা (আ.) তাঁদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এক নাগাড়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত রোযা রাখার নির্দেশ দেন। এভাবে মুসা (আ.)-এর অনুসারীদের উপর রোযা ফরয করা হয়।
ঈসা (আ.)-এর অনুসারীদের (খ্রিস্টান) মধ্যেও রোযা রাখার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল বা New Testament-এ উল্লেখ আছে : “And when he (Jesus) had fasted forty days and forty nights, he was afterward unhungered” (Mathew- 4: 2). অর্থাৎ ঈসা (আ.) চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত্রি রোযা রেখে তারপর রোযা ভঙ্গ বা ইফতার করতেন। রোযাদারদের সম্পর্কে বাইবেলে ঈসা (আ.)-এর উক্তি এভাবে উল্লেখিত হয়েছে : “Blessed are they which do hunger and thirst after righteousness : for they shall be filled” (Mathew-5 : 6). অর্থাৎ তারাই ভাগ্যবান যারা সৎকর্ম সাধনের পর রোযা রেখে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট ভোগ করে। তাদেরকে অবশ্যই (পরকালে) তৃপ্তি সহকারে আহার ও তৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করা হবে।
রোযা রাখা সম্পর্কে ঈসা (আ.) যে ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন, ইসলামের রীতি-নীতির সাথে তা বহুলাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাইবেলের বর্ণনা : "Moreover when ye fast, be not, as the hypocrites, of a sad contenance : for they disfigure their faces, that they appear unto men to fast. Verily I say unto you, They have their reward. But thou, when thou fastest, anoint thy head, and wash thy face” (Mathew- 6: 26-27).
এভাবে দেখা যায়, ইহুদী ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মাবলম্বীর মধ্যেই পূর্ব থেকে রোযার বিধান চালু আছে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, আহ্লি কিতাব অর্থাৎ ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম এ তিন প্রধান ধর্মেই রোযার বিধান রয়েছে। মহানবীর (সা.) আবির্ভাবের পূর্বে আরব দেশেও উপবাস করার রেওয়াজ ছিল। বিভিন্ন সময় শোক পালনের জন্য, কোন দুর্যোগ-দুর্ঘটনা বা মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা কল্পিত দেব-দেবীর অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় তারা উপবাস করতো। এভাবে অনুশোচনা বা প্রায়শ্চিত্ত করার উদ্দেশ্যে অথবা অকল্যাণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা উপবাস করতো। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুদের মধ্যেও উপবাস করার পদ্ধতি চালু আছে। বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে তারা উপবাস করে থাকে। বিশেষত, বিধবা হিন্দু রমণীগণ উপবাস করে থাকে। এটাকেও বলা যায় এক ধরনের প্রায়শ্চিত্ত। এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয় যে, পৃথিবীর সব বড় বড় ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রোযা বা উপবাসের প্রচলন ছিল বা এখনো কোন না কোনভাবে তা বিদ্যমান রয়েছে।
আখিরী নবীর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা ইসলামের পূর্ণতা সাধন করেছেন এবং সর্বকাল ও সমগ্র মানবজাতির জন্য তা একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ রূপে মনোনীত করেছেন। রোযা পালনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “সম্ভবত এর দ্বারা তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সমর্থ হবে।” (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩ আংশিক)
এ থেকে রোযা রাখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। তাকওয়ার গুণ অর্জন করাই রোযা রাখার প্রধান উদ্দেশ্য। আরবি ‘তাকওয়া’ শব্দের অর্থ ব্যাপক ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এর ভাবার্থ হলো, আল্লাহর উপর দৃঢ় ঈমান এনে তাঁর আদেশ-নির্দেশ যথাযথ মেনে জীবন পরিচালনা করা। তাকওয়ার গুণ অর্জন করার অর্থ ‘ইনসানে কামিল’ বা সত্যিকারের মানবিক গুণে বিভূষিত হওয়া। তাকওয়ার গুণ অর্জনকারীকে মুত্তাকি বলা হয়। এ মানবিক গুণ অর্জন করাই মানবজীবনের প্রকৃত সাধনা। এ গুণ অর্জন করার চেয়ে মহত্তম কোন কাজ পৃথিবীতে নেই। এ গুণ অর্জনের জন্যই রোযা ফরয করা হয়েছে। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোযার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আরও পড়ুন