Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রফতানি আয়ে গোঁজামিল পরিহার করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দেশের সামগ্রিক রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ তৈরী পোশাক খাত থেকে আসে। এ কারণে তৈরী পোশাক খাতের রফতানি আয়ে গোঁজামিল বা শুভঙ্করের ফাঁকি দেশের রফতানী আয়ের হিসাবে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো যে হিসাব প্রকাশ করে থাকে শুধুমাত্র রফতানী আয়ের অংকটিকে বড় করে দেখানো হলেও কাঁচামাল আমদানি তথা ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে তা অনেকটা অনুল্লেখ্যই থেকে যাচ্ছে। ফলে রফতানী আয়ের সাথে আমদানি ব্যয়ের ব্যাপক ফারাক বেড়ে গেলেও এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। গতকাল একটি সহযোগি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়ম বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তৈরী পোশাক রফতানি খাতে আয় হয়েছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো’র এই হিসাবে ব্যাক টু ব্যাক এলসি’র মাধ্যমে বিদেশে চলে যাওয়া মোট ১, ৫৯৪৭১ কোটি টাকার হিসাব দেখানো হয়নি। অর্থাৎ পোশাক খাতের ওভেনে রফতানী আয় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬ কোটি টাকা দেখানে হলেও বিগত অর্থ বছরে প্রকৃত আয় ছিল মাত্র ২৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। আর নিটওয়্যার খাতের ব্যাক ব্যাক এলসি পরিমান তুলনামূলক কম হওয়ায় ১ লাখ ৪২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা রফতানী আয়ের বিপরীতে প্রকৃত আয় ছিল ৯৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর মানে হচ্ছে তৈরী পোশাক শিল্পের সিংহভাগ রফতানী আয় আসছে মূলত নিটওয়্যার খাত থেকে।

প্রকৃত তথ্য আড়াল করে দেশের রফতানী আয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক শ্লোগানবাজি ও পরিসংখ্যানের চালবাজি চলছে। নেপথ্যের নেতিবাচক দিকগুলোকে আড়াল বা অগ্রাহ্য করার কারণে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে না। ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও স্বনির্ভরতা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও গত অর্থ বছরে তৈরী পোশাক খাতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আকার দেখেই বোঝা যায়, এ খাতে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এ জন্য পোশাক কারখানা মালিকদের জন্য আইনগত বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহারের উপর উপযুক্ত প্রণোদনা দেয়ার বিষয় কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত ওভেনে ব্যাক টু ব্যাক এলসি’র কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে কেনার শর্ত দেয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যমান বাস্তবতায় ওভেনে ব্যাক টু ব্যাক এলসির খরচ বাদ দিলে প্রকৃত আয় হয় শতকরা ২০ শতাংশ। এ অবস্থায় আমাদের তৈরী পোশাক রফতানী খাত এখনো শ্রেফ দর্জিগিরির পর্যায়েই রয়ে গেছে। এ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেশীয় কাঁচামাল ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে তৈরী পোশাক রফতানী খাতকে প্রকৃত অর্থে একটি আত্ম নির্ভরশীল খাত হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ শিল্পের মানোন্নয়নের পাশাপাশি এ খাতের বিনিয়োগ সুরক্ষার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

একদিকে রফতানি আয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ক্রমবর্ধমান গতির কথা শোনা যাচ্ছে, অন্যদিকে বাণিজ্য ঘাটতির আকার বেড়ে চলেছে। এ এক বিপরীতমুখী প্রবণতা। এ কারণে আমাদের পরিসংখ্যানের হিসাব নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায়। বিগত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে(জুলাই-মে) দেশের সামগ্রিক রফতানি আয়ের হিসাব দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ৭১৮ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১৮৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ৪৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। টাকার অংকে যা ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর আগের(২০১৭-১৮) অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ আরো বেশি ছিল বলে জানা যায়। গত অর্থ বছরে সেবা খাতে বেতন ভাতা বাবদ বিদেশি শ্রমিকদের প্রদান করা হয়েছে ৯৫৯ কোটি ডলার, আর এ খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৬৩৪ কোটি ডলার। একইভাবে রেমিটেন্স প্রবাহেও নেতিবাচক প্রবণতা চলছে। নানামুখী নেতিবাচকতা ও ঘাটতি দেশের অথর্নীতিতে ঋণাত্মক প্রবণতা হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতির জন্য মেগা প্রকল্পের জন্য আমদানি ব্যয়বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান হারে তা চলতে পারে না। বিশেষত রফতানীমুখী শিল্পের কাঁচামাল ও এক্সেসরিজে আমদানি নির্ভরতা এবং সরকারী ব্যয় নির্বাহে ব্যাংকিং খাতের উপর নির্ভরশীলতা বেসরকারি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পক্ষান্ত বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন সহায়তার সুযোগ ঠিকতম কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। এই মুহূর্তে বৈদেশিক বিনিয়োগ-সহায়তা তহবিলে প্রতিশ্রæত প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে থাকলেও তার যথাযথ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিগত অর্থবছরে বিভিন্ন সরকার ও দাতা সংস্থার তরফ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের নতুন প্রতিশ্রæতি পাওয়া গেলেও খরচের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। বাজেট বাস্তবায়ণের হার কমিয়ে ধরার পরও তা থেকে বাস্তবায়ণ করা গেছে ৬.২ বিলিয়ন ডলার। বরাদ্দ বাজেট বাস্তবায়নে অস্বচ্ছতা, অনিয়ম-লুটপাট আরেক শুভঙ্করের ফাঁকি। এর মধ্য দিয়ে একদিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে মানুষের আয়বৈষম্য বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা। এহেন বাস্তবতার পরিবর্তন ছাড়া মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রফতানি


আরও
আরও পড়ুন