Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধনকুবের পুলিশ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কট

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দেশ ও জাতি বহুমাত্রিক এক কঠিন সঙ্কটজালে আটকা পড়েছে। আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে এই সঙ্কটের সুত্রপাত হলেও এখন আঞ্চলিক রাজনীতি-অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভিত্তির উপর শক্ত আঘাত হানতে শুরু করেছে। সরকারের যে যাই বলুন, দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে এগুচ্ছে এমনটা সম্ভবত এখন আর প্রমান করা যাচ্ছে না। বৈদেশিক ঋণ এবং বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমে বাড়তে বাড়তে আমাদের অর্থনীতি এখন আন্তর্জাতিকভাবে ঋণাত্মক হয়ে উঠেছে। সরকারী হিসাবেই বিগত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় দেড়লাখ কোটি টাকা। শুধু পরিসংখ্যানগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশের সব মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি বা সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নির্দেশ করে না। নিরাপত্তা হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে মানুষের এক নম্বর চাহিদা ও প্রত্যাশা। এ সময়ে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। দেশে নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মই এই সংস্কৃতিতে আক্রান্ত হয়েছিল। এ নিয়ে রাজনীতি অপরাজনীতি ও বেøইমগেইম যাই হোক না কেন, কাঙ্খিত মাত্রায় না হলেও পরবর্তি দুই দশকে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক প্রকার স্থিতিশীলতা তৈরী হয়েছিল। নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের অনাস্থা ও সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় এমন প্রকট আকার ধারণ করতে আর কখনো দেখা যায়নি। লাখ লাখ মানুষ রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় বিনা বিচারে কারান্তরীণ এবং আদালতে দৌড়ঝাঁপের এমন সময় আগে আর কখনো আসেনি। ৫ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত মানুষের পাশবিক লালসার শিকার হওয়ার মতো ঘটনা আগে আর কখনো হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। স্কুল-কলেজ, মাদরাসার একশ্রেণীর শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চ শিক্ষিত, ক্ষমতাধর অথবা তাদের ছত্রছায়া প্রাপ্ত ব্যক্তিদের রিরংসা ও বলাৎকারের শিকার, মানুষকে কুপিয়ে মারা, পুড়িয়ে-পিষে মারার এমন বিভৎস কান্ড আগে কখনো ঘটেনি। এতসব নেতিবাচক ঘটনা ও প্রবণতার পরও জাতির আশাবাদি হওয়ার মত এখনো অনেক কিছুই হয়তো আছে। একেকটা ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর সমাজে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের প্রতিবাদ ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া থেকে আশাবাদি হয়ে ওঠার শক্তি পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায়, ঘটমান বাস্তবতা সমাজের প্যারাসাইট বা ভাইরাসমাত্র। বেশিরভাগ মানুষ এসব ঘটনা ও বাস্তবতাকে মেনে নিচ্ছে না, তাদের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বলে দিচ্ছে, এই অপঘাত-প্যারাসাইট নির্মূলে তারা বদ্ধ পরিকর। সকলের সম্মিলিত শুভচিন্তা ও শান্তিকামী সাহসী মানুষের প্রতিরোধে এককদিন এই অশুভ শক্তি ও প্রবণতার বিনাশ অনিবার্য।

ঘটমান বাস্তবতায় নেপথ্যের কুশীলবদের কিছু দশ্যমান আর অনেক কিছুই অদৃশ্য।‘দরজাটারে বন্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি!’ গত এক দশক ধরে দেশে মানুষ গুম হচ্ছে। এর অনেকটা রাজনৈতিক এবং বাকিটা পেশাদার সামাজিক অপরাধি চক্রের সাথে যুক্ত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকধারি সদস্যদের মধ্যে নানা মাত্রার অপরাধির সংখ্যা হাজার হাজার। বছরে ১০-১৫ হাজার পুলিশ সদস্য বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার পরও তাদের অপরাধ প্রবণতা কমছেনা। বলাবাহুল্য, গুরুপাপে লঘুদন্ডের কারণেই এই প্রবণতা রোধ হচ্ছে না। যেখানে সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার জন্য একশ্রেণীর মানুষ আপনজনদের হত্যা করতেও কুষ্ঠিত হয়না, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধিরা আইনের পোশাক ও রাষ্ট্রীয় অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষকে ফাঁদে ফেলে বিপদের ভয় দেখিয়ে এবং বিপদগ্রস্ত করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার পথ বেঁছে নিচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লেনদেনের বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, ডিআইজি মিজান বা ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার নেপথ্যে কত মানুষকে হয়রানি ও অমানবিক নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছে তার খোঁজ কেউ কি নেবে? কয়েক বছর আগে হঠাৎ একদিন ঢাকার সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছিল, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। ঘটনার বিবরণটি ছিল এমন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী(কর্মকর্তা) ভোরবেলায় কাজে যাওয়ার সময় পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে কোনো রকম জিজ্ঞাসাবাদ না করেই বেধড়ক পিটিয়ে রক্তাক্ত আহত করার সময় ‘মাছের রাজা ইলিশ দেশের রাজা পুলিশ’ বলে অহমিকা প্রকাশ করে। এর কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা প্রকাশ্য পুলিশি নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনায় গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেশের সব মানুষ খারাপ নয়, সব পুলিশও খারাপ নয়, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে কিছু কালোর সাথে বেশিরভাগ ভালো মানুষ পেরে উঠে না। রাজনীতি যদি পুলিশ নির্ভর হয়, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে যদি কালো আইন দিয়ে, বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি আইনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ক্ষমতাসীন রাজনীতির আজ্ঞাবহ হয়ে অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে র‌্যাব-পুলিশের আচরণ হয়ে পড়ে দেশের দখলদার রাজার মত এবং সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েন একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের হাতে জিম্মি অসহায় প্রজা। বিশ্বের সব দেশেই পুলিশ বাহিনী আছে, যারা বিপদে আপদে প্রতিদিন সব নাগরিকের পাশে দাঁড়ায়, জীবন বাজি রেখে মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ বজায় রাখতে কাজ করে যায়। সবদেশেই পুলিশের হাতে বৈধ অস্ত্র থাকে। এই অস্ত্র ব্যবহৃত হয় দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের জন্য। আক্রান্ত হলে প্রয়োজনে আত্মরক্ষার জন্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেশের মালিক জনগণ, আর পুলিশ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী হিসেবেই স্বীকৃত। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশে এখন গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে। শহরের কিশোর-তরুনরা এখন ফিল্মী স্টাইলে গ্যাংস্টার হতে চাইছে। অপরাধ জগতের নতুন প্রবণতা হিসেবে গড়ে ওঠা এই গ্যাং গ্রæপগুলোকে ব্যবহার করছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। আইনের শাসন ও নাগরিকের নিরাপত্তার প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের নিয়ামানুবর্তিতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আধুনিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠিগত স্বার্থ ও সম্পদ অর্জনের মোহে রাষ্ট্রীয় আইন, মানবাধিকার ও নাগরিকের অধিকারের প্রশ্নে এই দুই গ্রæপের অনীহা ও বেআইনী তৎপরতার কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। আইন হাতে তুলে নিয়ে রাস্তায় পিটিয়ে সন্দেহভাজন মানুষ হত্যার ঘটনাগুলো আইনের শাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার প্রতিফলন।

সিলেটের ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিক আবারো সচিত্র সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার এক পর্যায়ে তার বাসা থেকে নগদ ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ইতিপূর্বে ভৈরবে রেলপুলিশের হাতে প্রায় অর্ধকোটি নগদ টাকা এবং প্রায় ৫ কোটি টাকার ডকুমেন্টসসহ চট্টগ্রামের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস ধরা পড়ার পরতৎকালীন চট্টগ্রামের ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিকসহ এই চক্রের ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতি ও সম্পদের অনেক তথ্য বের হতে থাকে। সে সময় পার্থ গোপালকে সিলেটে ডিআইজি প্রিজন হিসেবে এবং চট্টগ্রামের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিককে যশোরে বদলি করা হয়। আইনের রক্ষাকবচ ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, অনিয়ম, মানুষকে জিম্মি ও হয়রানি করার তথ্য ফাঁস হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা, জেলজরিমানার বদলে শ্রেফ বদলি করেই পুলিশ বিভাগ দায়িত্ব শেষ করার কারণেই বিভাগীয় শাস্তিতে পুলিশের অপরাধ প্রবণতা কমছে না। তারিক সাঈদ, পার্থ গোপাল, সুশান্ত কুমার, ডিআইজি মিজানরা এভাবেই দিনে দিনে বিষবৃক্ষের মহীরূহে পরিনত হয়েছেন। তাদের দেখেই বেপরোয়া পুলিশ সদস্যরা নিজেদেরকে ‘দেশের রাজা’ ভাবতে শুরু করেছে। বেশ কিছু পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সে সব অভিযোগের তদন্ত করে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশনের তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে এখন ডিআইজি মিজান ও পার্থ গোপালদের জিজ্ঞাসাবাদ, টাকা আটক এবং বিচারের সম্মুখীন হতে দেখে মানুষ কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতে পারে। সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে শত শত কোটি টাকা এবং বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ ও সেকেন্ড হোমের মালিকদের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও নামে-বেনামে সাবেক ও বর্তমান আমলা, মন্ত্রী-এমপি, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার ও শিল্পপতিরাও রয়েছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। শেয়ারবাজার লুন্ঠনের হোঁতাদের বিচার না হওয়ায় তারা বার বার কারসাজি করে বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিদের বার বার নি:স্ব করে দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। জনগনের ট্যাক্সের টাকায় উন্নয়ন বাজেটের বেশিরভাগ অনিয়ম-দুর্নীতি ও যোগসাজশের লুণ্ঠনে বেহাত হয়ে যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করে সর্বনি¤œ মানের রাস্তা ও ব্রিজ নির্মিত হয় বাংলাদেশে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সংস্কার ও উন্নয়নের টাকা লোপাট করে হাওরে নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না বলেই অপচয়-লুটপাট, শুভঙ্করের ফাঁকি বন্ধ হয়না। যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি, অপরাধ প্রবণতা, সামাজিক অবক্ষয়, বিচারহীনতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শারিরীক মানসিক অসুস্থতা, অশান্তি-অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই দেশ এগিয়ে চলেছে। এ নিয়ে আমাদের গর্বের, গলাবাজির কোনো শেষ নেই।

দেশে নাকি গুজবের রাজত্ব চলছে। গণমাধ্যমের চাইতে গুজবকেই যেন বেশি বিশ্বাস করছে মানুষ। অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী এমপি ও সিটি কপোর্রেশনের মেয়রদের কেউ কেউ গুজবের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে টেনে এনে জনগনের আস্থা হারাচ্ছেন। ছেলে ধরা, গলা কাটা নিয়ে গুজব ও বø্যাক প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে একটা চক্র। রহস্যজনকভাবে সন্তানের হারিয়ে যাওয়া, শিশুদের গলাকাটা লাশ ও কাটামুন্ডু নিয়ে সন্দেহভাজন যুবকদের ধরা পড়তে দেখে মানুষ গুজবকেই বিশ্বাস করতে শুরু করলে তার দায় অনেকটাই দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর বর্তায়। গুজবে কান দেবেন না বললেই মানুষ কান বন্ধ করে বসে থাকে না। তবে ছেলে ধরা গুজবে বেশ কয়েক জন নিরীহ নিরপরাধ মানুষের নির্মম মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনায় এ বিষয়ে গুজবে কান দেয়া মানুষের কিছুটা হলেও টনক নড়েছে। ছেলে ধরা গুজবে গণপিটুনিতে রাজধানীর বাড্ডায় ৪ বছরের শিশু তুবার মা রেণু আক্তার নিহত হওয়ার পর রাতারাতি অবস্থা অনেকটাই পাল্টে গেছে। তাই বলে মহামারি আকারে বেড়ে ওঠা ডেঙ্গু রোগির সংখ্যাকেও গুজব বলতে হবে? কতটা গুজব আর কতটা সত্য তা খুঁজে বের করে জনগনকে আশ্বস্ত করতে না পারা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক বড় ব্যর্থতা। পুলিশসহ মন্ত্রী, সচিব-আমলারা জনগণের বন্ধু ও সেবক। আমাদের সংবিধান এবং ভোটের রাজনীতিতে এমন স্বীকৃতি হর হামেশাই শোনা যায়। যদিও বাস্তব চিত্র তার বিপরীত। গত সোমবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত এক কিশোর শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে জরুরী উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনতে অর্ধ লাখ টাকা খরচ করে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেছিল স্বজনরা, তারা ট্রিপল নাইনে ফোন করেও জরুরী সেবা চেয়েছিল। কিন্তু মাদারিপুরে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিবের জন্য ফেরিটি ৩ ঘন্টা অপেক্ষমান রেখে ৬ষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র তিতাস ঘোষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার অভিযোগ এনেছেন তার পরিবার ও স্থানীয়রা। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘাটে পৌছানোর আগেই ফেরিটি ঘাটে ভিড়েছিল। আশঙ্কাজনক রোগি নিয়ে অনেক অনুরোধ করেও ফেরির লোকদের মন গলানো যায়নি। তারা রাত ৮ টা থেকে অপেক্ষা করতে করতে পৌনে ১১ টায় ফেরি ছাড়ার পর মাঝ নদীতেই মৃত্যু হয় তিতাসের। রাত ৮ টায় ফেরি ছাড়লে এগারোটার মধ্যে ঢাকায় পৌছা হয়তো সম্ভব ছিল। এ ঘটনা থেকে আমাদের আমলাতন্ত্র ও সমাজ মানসের নির্মমতার একটি চিত্র ফুঁটে উঠে। ছেলে ধরা সন্দেহে শিশুর মাকে হত্যা করা, গরুর গোশত খাওয়া বা রাখার সন্দেহে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা, জয় শ্রীরাম না বলার অপরাধে পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘটনাগুলো থেকে ভারত ও বাংলাদেশে সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও মনোবিকলন ও পাশবিক চরিত্র ফুটে ওঠে। মিথ্যা দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ঘৃনা ও হিংসা দিয়ে অহিংসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভয়, আতঙ্ক ও ঘৃনাকে পুঁজি করে সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা অসম্ভব। মিথ্যা মামলা ও বিনা বিচারে লাখ লাখ মানুষের হয়রানি, দুর্ভোগ। দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার, ব্যাংক জালিয়াতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন, পুঁজিবাজারের ধস, গুম-খুন, শিশু ধর্ষণ, আগুনে পুড়িয়ে নুসরাত হত্যা, রাস্তায় কুপিয়ে বিশ্বজিৎ-রিফাতদের হত্যা, ছেলে ধরা গুজব, গলাকাটা লাশ, গণপিটুনিতে শিশুর মাকে হত্যা, ফেরিতে তিতাসের মৃত্যু এবং মশক নিধনের ব্যর্থতার কারণে ডেঙ্গুর মহামারির মত ঘটনাবলী একই সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার সুত্রে গাঁথা। আইনের শাসনের ব্যত্যয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষণ এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুণ:প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুলিশ


আরও
আরও পড়ুন