Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অবৈধ ভিওআইপি’র নেতৃত্বে টেলিটক

প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফারুক হোসাইন : অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর অভিযান, জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ও বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সীম নিবন্ধনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু সরকারের কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। বন্ধ হচ্ছে না লাভজনক এই ব্যবসা। বরং দিনে দিনে আরও সোনার ডিম দেয়া হাঁসের মতোই রূপ নিচ্ছে এটি। আর অবৈধ এই ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। সব সময়ই এই অপারেটরটির সিম ব্যবহার করে করা হচ্ছে অবৈধ কল টার্মিনেশন। তবে প্রতিবারই টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে কেবল চিঠি দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এমনকি বিটিআরসিকে অন্যান্য অপারেটরদের পক্ষ থেকে প্রমাণ দেয়া এবং কমিশনের অভিযানে হাতে নাতে ধরা পড়লেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছে টেলিটক। অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণেই বারবার অনিয়ম করলেও সরকার টেলিটকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা আঙুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত সময়ের মতো গত কয়েকদিনেও অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশনে ব্যবহৃত সিমের অধিকাংশই টেলিটকের। কমিশন বলছে, অবৈধ কল টার্মিনেশন রোধে সিম বক্স ডিটেকশন সিস্টেমে অবৈধ পথে আসা ৯৫ শতাংশ কলই চিহ্নিত করেছে। তবে এর অধিকাংশ কলই করা হয়েছে টেলিটকের সিম ব্যবহার করে। বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে জানা যায়, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর গত ১ জুন থেকে ৪ জুন পর্যন্ত চার দিনেই সিম বক্স সিস্টেমের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত মোট ৭ হাজার ৭০৯ টি সিম চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে টেলিটকের সিমই রয়েছে ৭ হাজার ৬১৩টি। এছাড়া গ্রামীণফোনের দুইটি, রবির দুইটি, বাংলালিংকের ১১টি এবং পিএসটিএন অপারেটর র‌্যাংকসটেলের সংযোগ ব্যবহার করা হয়েছে ৪২টি কলে।
বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, বিদেশ থেকে প্রতিদিন বৈধ পথে আসা কলের সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি, অন্যদিকে অবৈধ পথে আসা কলের পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি। গত মে মাসেই অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বন্ধ না করায় টেলিটককে ৫০ লাখ ২৪ হাজার টাকা জরিমানা করে বিটিআরসি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত এক হাজার ২৫৮টি সিম শনাক্ত হয়। এর মধ্যে টেলিটকেরই ছিল এক হাজার ২৫৬টি সিম। এসব সিম নির্ধারিত চার ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বন্ধ না করায় এ আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিম সংশ্লিষ্ট অপারেটর চার ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে টেলিটক ওই সময়সীমা তো নয়ই, বরং অনেক সিম ৮৪ দিন পর্যন্ত চালু রেখেছিল বলে জানা যায়।
বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, অবৈধ কল টার্মিনেশন ধরার জন্য সাধারণত দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এর একটি হলো মিউচি বা সাইগস ডিটেকশন পদ্ধতি অন্যটি সেল্ফ রেগুলেশন লজিক পদ্ধতি। বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক অপারেটর ৩ ঘণ্টা পর পর দিনে ৮ বার সেল্ফ লজিক পদ্ধতিতে অপারেট করবে। যার মাধ্যমে অবৈধ কল টার্মিনেশনের ব্যবহৃত সিমগুলো শনাক্ত করা যায়। আর সাইগস পদ্ধতিতে কোন সিম অবৈধ কল টার্মিনেশনে ব্যবহৃত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ধরা পড়বে এবং ব্লক হয়ে যাবে। অন্য অপারেটরগুলো অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিম চিহ্নিত এবং বন্ধ করলেও টেলিটক সব সময়ই এই নির্দেশনা অমান্য করেছে। নিজেদের এই অনিয়মকে অন্য অপারেটরের ষড়যন্ত্র বলেও হালাল করার চেষ্টা করছে।
এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিটিআরসির এক অভিযানে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত টেলিটকের সাড়ে চার লাখ সিম চিহ্নিত করা হয়। যার মাধ্যমে দৈনিক তিন কোটি মিনিট অবৈধভাবে ভিওআইপি করা হয়। এ অনিয়ম দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান ওই অভিযানে অংশ নেয়া বিটিআরসির কর্মকর্তারাও। তারা এ অনিয়মের ব্যাপারে টেলিটকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেন। তবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা কিংবা কল টার্মিনেশনের কারণে ২০১৪ সালের জুন মাসে টেলিটকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বেসরকারি তিন মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবি আজিয়াটা। বিশেষ করে বিদেশি কলকে দেশিয় কল হিসেবে দেখিয়ে ওইসব অপারেটরের আর্থিক ক্ষতির কথাও বলা হয়। ওই সময় ২৮ মে থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত ৩৮ হাজার ৬১৩টি টেলিটক সিম চিহ্নিত করে বিটিআরসি। আবার গতবছর জুলাই মাসেই টেলিটকের বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপি’র অভিযোগ করে তিন অপারেটর। তারা এর প্রমাণসহ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে অভিযোগ করে। সে সময় বেসরকারি অপারেটরগুলোর অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল বিটিআরসি। এমনকি ওই সময় এক মাসে পাঁচবার অভিযান চালিয়ে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টেলিটক সিম অবৈধ ভিওআইপি’তে ব্যবহারের কারণে বন্ধ করে দেয় কমিশন। জুনে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবি’র পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, টেলিটক অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে বিদেশি কল এনে তা স্থানীয় কল হিসেবে দেখিয়ে অন্য অপারেটরদের কাছে টার্মিনেশন করছে। গতবছর মে মাসের তুলনায় জুন মাসে টেলিটক থেকে গ্রামীণফোনে স্থানীয় কল বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বাংলালিংক ও রবির ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ৪০ ও ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে টেলিটকের গ্রাহকসংখ্যায় তেমন কোনো পরিবর্তন না এলেও কল বৃদ্ধির এই হার উদ্বেগজনক। এছাড়া আরও বলা হয়, অন্যান্য অপারেটরের ক্ষেত্রে একটি স্থানীয় কলের স্থায়িত্ব যেখানে গড়ে দেড় মিনিট, সেখানে টেলিটকের একটি স্থানীয় কলের গড় সময় প্রায় চার মিনিট। তিন বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের আলাদা বিশ্লেষেণ বলা হয়, টেলিটকের এক সিমে গড়ে অবৈধ কল আসছে তিন থেকে ছয় হাজার মিনিট। বেসরকারি অপারেটরদের একটি সিমে এই হার গড়ে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ মিনিট। আবার টেলিটকের অনেক সিমের ক্ষেত্রে শুধু আউটগোয়িং কলই আসছে, কোনো ইনকামিং কল নেই। সাধারণ হিসেবে কেউ যদি ১০ বার ফোন ধরেন, তাহলে তাঁর অন্তত একবার ফোন করার কথা। ভিওআইপি পদ্ধতিতে আসা বিদেশি কলকে স্থানীয় মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে লোকাল কল হিসেবে দেখানোয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ রাজস্ব হারায়, আর লাভবান হয় শুধু যে পক্ষ কলটি আনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বয়ং টেলিটক অবৈধ ভিওআপি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার কারণে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এ অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। সব প্রচেষ্টাই আটকে দিচ্ছেন টেলিটকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। টেলিটকের সিম ব্যবহার করেই তারা দিনের পর দিন এ অনিয়ম করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আহমেদকে ফোন করলেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অবৈধ ভিওআইপি’র নেতৃত্বে টেলিটক
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ