Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সন্দেহের দোলাচলে ২২ আগস্টের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

সাধারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি, উস্কানি দিচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও কিছু কিছু এনজিও

বিশেষ সংবাদদাতা, কক্সবাজার | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৯, ৬:৪৯ পিএম

সাধারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হলেও কিছু কিছু এনজিও এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রত্যাবাসন বিরোধী উস্কানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে আবারো দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে শঙ্কা।

তবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার নুরুল আলম নেজামী বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে। আগামী ২২ই আগস্ট বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শেষ করেছি। এখন শেষ পর্যায়ে কাজ চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো এ কার্যক্রম আরো বাড়ানো হবে।

রোববার সকাল সাড়ে ১১টার সময় কক্সবাজারে শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালামের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রত্যাবাসন টাক্সফোর্সের কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি একথা বলেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালাম, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, অতিরিক্তি আরআরসি শামসুদৌজা নয়ন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএম সরওয়ার কামাল সহ সেনাবাহিনী ও জাতিসংঘের শরনার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর প্রতিনিধিরা।


উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা রয়েছে ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭ জন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা সমস্যাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তিরণ হলেও এত বিশাল রোহিঙ্গাদের চাপ বাংলাদেশের পক্ষে বেশাদিন সহ্যকরা সম্ভব নয়। তই শুরু থেকেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এজন্য মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাসহ আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। পাশাপাশি নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্যও রোহিঙ্গাদের মাঝে মোটিবেশ অব্যাহত রয়েছ।

নিজ দেশে ফিরে যেতে অধীর আগ্রহী সাধারণ রোহিঙ্গা শরনার্থীরা। ইতিমধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা নিজ উদ্যোগে রাখাইনে ফিরেও গেছে। গত নভেম্বরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্যাম্প গুলোতে প্রত্যাবাসন বিরোধী উগ্রপন্থী ও উস্কানি দাতাদের উস্কানীমূলক কর্মকান্ডে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়েযায়। এখানে প্রত্যাবাসন বিরোধী উস্কানীর পেছন কিছু কিছু এনজিওর ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের নিবৃত করা সম্ভব না হলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বারবার হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আগামী ২২ আগষ্ট ৩ হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে প্রথম ধাপে স্থল ও নৌ পথে গ্রহণ করতে প্রস্তুতি নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। গত জুলাই মাসের দু’দফায় মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ মিন্ট থু এর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেশন টিম কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন এবং রোহিঙ্গা নর-নারীদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেন। এসময় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যেতে অনুরোধ জানানো হয়। ওই টিমের সদস্যরা দুই দিনে কয়েক দফায় ক্যাম্প গুলোতে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনায় অংশ নেন। মিয়ানমার সফরকারী টিমের সঙ্গে যুক্ত হন আসিয়ানের ৫ সদস্যর প্রতিনিধি দল। রাখাইনে রোহিঙ্গারা ফিরে কি কি সুবিধা ভোগ করবে, জীবন জীবিকা কিভাবে নির্বাহ হবে ও অন্যান্য অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন ডেলিগেশন টিম। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের লিফলেটও বিতরণ করা হয়।

রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দুল আমিন জানান, মিয়ানমার টিমের সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গারা নিজ জন্মভূমিতে ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। কুতুপালং ২নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা এআরএস পিএইচ সভাপতি (আরকান রোহিঙ্গা ফর সোসাইটি হিউম্যা রাইট্স)’র নেতা মহিবুল্লাহ বলেন, তাদের মৌলিক অধিকার পূরণ হলে একজন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশে থাকবে না। স্ব-ইচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যাবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা মুসলমান হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।

বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা জেবর মুল্লুক জানান, বর্ডার খোলা ফেলে যেভাব এসেছে সেভাবে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী। কিন্তু জানমালের নিরাপত্তার অভাবে কেউ মুখ খুলে বলতে পারছে না। কারণ ইতিপূর্বে এ ধরণের ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা বেশ কয়েক জন রোহিঙ্গা নেতা হত্যার শিকার হয়েছে।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৯ এর মাঝি মোছা আলী ও নুরুল আমিন বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার কথায় তারা খুশি হয়েছে। কারণ তারা নিজ দেশে গিয়ে বসতবাড়ীতে বসবাস করতে পারবে। উখিয়ার থাইংখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মৌলভী হাফেজ আমির হোসেন জানান, রাখাইনে যারা মুলা দেখিয়ে দেশান্তরিত হতে কাজ করেছিল, তারাই ক্যাম্প গুলোতে এখন নানা নির্যাতন জুলুম করছে। এখানে (ক্যাম্পে) ছেলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নারীদের কোনো ইজ্জত নেই। জিম্মিদশায় প্রতিনিয়ত নারীর সম্ভ্রম হানি হচ্ছে। তাই অধিকাংশ রোহিঙ্গা যে কোনো ভাবে রাখাইন ফিরে যেতে আগ্রহী।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মোঃ ইলিয়াছ ও নুর মোহাম্মদ জানান, রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে যারা হুমকি, খুন, গুমের সঙ্গে জড়িত তারা সকলের চেনা জানা। তাদের নানা হুমকি উপেক্ষা করে নিজ উদ্যেগে অনেক রোহিঙ্গা গোপনে রাখাইন ফিরে যাচ্ছে।

ক্যাম্প গুলোতে সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে গত ৯ আগষ্টও ২১ জন রোহিঙ্গা নারী, শিশু, পুরুষ মিয়ানমার ফিরে গেছে বলে তারা জানান। তবে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বলেছে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ও নাগরিকত্বের স্বীকৃতির নিশ্চয়তা এবং তাদের উপর সংঘটিত নির্যাতনের বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজী নয়। এ অবস্থায় ফিরে না যেতে চাইলে এই দফার চেষ্টাও ফলপ্রসূ হবে কি না তা এখনও অনিশ্চিত।

একই ভাবে গত বছরের ১৫ নভেম্বর উভয় দেশের ব্যাপক প্রস্ততি থাকার পরও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায়নি। এ সময় কতিপয় দেশি বিদেশি এনজিওর গোপন ষড়যন্ত্র ও উস্কানি পেয়ে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বাধার মুখে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম পণ্ড হয়ে যায়। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, মিয়ানমার নিয়মিত তাদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের যাচাইকৃত তালিকা দিচ্ছে।

২২ আগষ্ট মিয়ানমার সম্প্রতি ছাড়পত্র দেয়া ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম মৈত্রী সেতু ও টেকনাফের নাফ নদীর কেরুনতলীর প্রত্যাবাসন ঘাট দিয়ে ওই সব রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে। রোহিঙ্গাদের জন্য ওখানে একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে এবং আধা সেমি পাকা ৩৩টি ঘর ও নির্মাণ করা হয়েছে। ওখানে ৪টি চৌচাগার রয়েছে। এদের দেখাশুনার জন্য ১৬ আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে একটি বৈঠক রোববারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২২ আগষ্ট রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নিকারুজ্জামান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা পালন করতে সবসময় প্রস্তুত আমরা আছি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ